বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪২ অপরাহ্ন
উত্তর : আভিধানিক অর্থে তাক্বলীদ বলতে বুঝায়, দলীল এবং প্রমাণ ছাড়া কারো কথা ও কাজের আনুগত্য করা, বিনা দলীলে অনুসরণ করা, চোখ বন্ধ করে কারো পিছনে চলা, চিন্তা-ভাবনা না করে বা বিনা দলীলে কারো অনুসরণ, অনুকরণ (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, পৃ. ৭৫৪; আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ, পৃ. ১৩৪৬; আল-মুনজিদ, পৃ. ৮৩১)। খাত্বীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘তাক্বলীদ হল দলীল ছাড়া কারো কোন কথা মেনে নেয়া’ (আল-ফাক্বীহ্ ওয়াল-মুতাফাক্কিহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬)। হাফিয ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ), হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শরী‘আতে তাক্বলীদের অর্থ হল, এমন কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, যে কথার পক্ষে কথকের কাছে কোন দলীল নেই। এটি শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আর ইত্তিবা হল যার উপর দলীল সাব্যস্ত হয়েছে (জামি‘উ বায়ানিল ইলম্ ওয়া ফাযলিহি, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৭; ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৭)। ইমাম ইবনে কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ফক্বীহদের নিকটে তাক্বলীদ হল, বিনা দলীলে কারো কথা গ্রহণ করা। এই অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী কারীম (ﷺ)-এর কথা এবং ইজমা গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না (রাওযাতুন নাযির ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫০)।

ইবনু হাযম্ আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাক্বলীদ হল, নবী কারীম (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো কথাকে দলীল ছাড়াই গ্রহণ করা। এটির নাম তাক্বলীদ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। আর এটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৬৯)। হাফিজ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য অনুযায়ী তাক্বলীদ কোন জ্ঞান নয় (ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮)। এ ব্যাপারে সালাফদের বক্তব্য নিম্নরূপ :

১. ইমাম আশ-শা‘বী তাবিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এরা তোমার নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা বর্ণনা করে সেগুলো গ্রহণ কর। আর যা তাদের রায় হতে (কুরআন-সুন্নাহর বিপরীতে) বলে সেগুলোকে আবর্জনায় নিক্ষেপ কর’ (আদ-দারিমী, হা/২০৪, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৭, সনদ সহীহ)।

২. ইমাম হাকাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির কথা আপনি গ্রহণ বা বর্জন করতে পারেন’ (ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৩, সনদ সহীহ)।

৩. ইবরাহীম নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সামনে কোন এক ব্যক্তি তাবিঈ সাঈদ বিন জুবায়ির (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য পেশ করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছের মুকাবিলায় সাঈদ বিন জুবায়িরের বক্তব্য দিয়ে তুমি কী করবে? (ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৩, সনদ সহীহ)।

৪. ইমাম মুযানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম শাফিঈ নিজের ও অন্যের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করে বলেন, ‘আমার এমন প্রত্যেক বক্তব্য, যা রাসলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছহীহ হাদীছের বিপরীত হবে (তাকে বর্জন কর)। কারণ নবীর কথা সবচেয়ে উত্তম। আর তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না’ (আল-উম্ম- মুখতাছারুল মুযানী, পৃ. ১; আদাবুশ শাফিঈ ওয়া মানাকিবুহ, পৃ. ৫১, সনদ হাসান)।

৫. ইমাম আবূ দাঊদ সিজিস্তানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) কি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর চেয়ে বেশি হাদীছের অনুসারী? তিনি বলেন, তোমার দ্বীনের ব্যাপারে এদের একজনেরও তাক্বলীদ করবে না’ (মাসায়িলে আবূ দাঊদ, পৃ. ২৭৭)।

৬. ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) একদিন কাজী আবূ ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বললেন, ‘হে আবূ ইউসুফ! তোমার জন্য আফসোস! আমার থেকে যা শ্রবণ করবে তার সবকিছুই লিখে রাখবে না। কারণ আমি আজকে একটি রায় দিই এবং আগামীকাল তা পরিত্যাগ করি। আবার আগামীকাল একটা রায় দিই পরশু তা বর্জন করি’ (তারীখু ইয়াহ্ইয়া ইবনু মাঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৭, ক্রমিক নং-২৪৬১, সনদ সহীহ; তারীখু বাগদাদ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৪২৪)।

৭. ইমাম ইবনু হাযম্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বলীদ করা হারাম’। তাক্বলীদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও আলিম উভয়-ই সমান। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ছাহাবী এবং সকল তাবিঈ-এর ইজমা সাব্যস্ত রয়েছে যে, নবী (ﷺ) ব্যতীত তাদের মধ্য হতে বা তাদের আগের কোন ব্যক্তির সকল কথাকে গ্রহণ করা নিষেধ ও নাজায়েয। যে ব্যক্তি আবূ হানীফা, মালিক, শাফিঈ ও আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ)-এর মধ্য হতে কোন একজনের তাক্বলীদ করে এবং তার জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্য হতে যার অনুসরণ করে তার কোন কথাকে বর্জন করে না, তবে সে জেনে রাখুক যে, সে পুরো উম্মতের ইজমার বিপরীত করে। সে মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথের অনুসরণ করেছে। আমরা এ অবস্থা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। তাছাড়া এ সকল সম্মানিত আলিমগণ নিজেরাই তাঁদের ও অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের তাক্বলীদ করল সে তাদের বিরোধিতা করল (আন-নুবযাতুল কাফিয়া ফী আহকামি উছূলিদ দ্বীন, পৃ. ৭০-৭১, আর-রদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃ. ১৩১-১৩২)।

৮. হাফিজ ইবনু হাযম্ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘কারো জন্য জীবিত অথবা মৃত কারো-ই তাক্বলীদ করা বৈধ নয়’ (কিতাবুদ দুর্রাহ ফীমা ইয়াজিবু ই‘তিকাদুহু, পৃ. ৪২৭)।

৯. ইমাম আবূ জা‘ফর ত্বাহাবী হানাফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘গোঁড়া ও নির্বোধ ছাড়া কেউ তাক্বলীদ করে কি?’ (লিসানুল মীযান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮০)।

১০. আইনী হানাফী ও যাইলাঈ হানাফী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ জাহিল হয়। আর সকল কিছুর বিপদ তাক্বলীদ থেকে শুরু হয় (আল-বিনায়া শারহুল হিদায়াহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৭; নাছবুর রায়াহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৯)।

১১. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কেউ যদি এ কথা বলে যে, সাধারণ মানুষের উপর অমুক অমুকের তাক্বলীদ ওয়াজিব। তাহলে এ কথা কোন মুসলিম বলতে পারে না’। আর তিনি নিজেও তাক্বলীদ করতেন না (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২২তম খণ্ড, পৃ. ২৪৯; ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪১-২৪২)। তিনি আরো বলেন, ‘কোন মুসলিমের উপরে আলেমদের মধ্য হতে কোন একজন নির্দিষ্ট আলিমের প্রতিটি কথা মান্য করা বা তাক্বলীদ করা ওয়াজিব নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যতীত অন্য কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাযহাবকে আবশ্যিকভাবে আঁকড়ে ধরা বা প্রতিটি বিষয়ে তার আনুগত্য শুরু করা কোন মুসলিমের উপরে ওয়াজিব নয়’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২০তম খণ্ড, পৃ. ২০৯)। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি একজন ইমামকে নির্ধারণ করে নিঃশর্তভাবে তার আনুগত্য করাকে আবশ্যক আখ্যা দিয়েছে, বিশ্বাসগতভাবে হোক বা আমলগতভাবে, সে ব্যক্তি ভ্রান্ত রাফিযী ইমামিয়্যাদের নেতাদের মত গোমরাহ (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৬৯)।

১২. আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটি বলে দেয়া ওয়াজিব যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসলুল্লাহ (ﷺ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর ভিত্তি করে সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে অবশ্যই বিদ‘আতী এবং আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ। চাই সে সম্বন্ধ মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক’ (আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃ. ১৪৯)।


প্রশ্নকারী : তাজবীর উল হক, চট্টগ্রাম।





প্রশ্ন (৩৬) : আল্লাহকে ‘খোদা’ বলে ডাকা যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৬) : এক রাকা‘আত বিতর পড়লে তাহাজ্জুদ ছালাত সর্বনিম্ন দুই রাকা‘আত পড়া যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৮) : আমি বাংলাদেশ জেলে কারারক্ষী পদে (সৈনিক পদে ভর্তি হয়ে) চাকুরী করি। সাধারণ পদে কিছুদিন ডিউটি পালন করার পর খেলোয়াড় (খেলোয়াড় কোটায়) হিসাবে চাকুরি শুরু করেছি। পেশা হিসাবে এটা করা কি সঠিক হয়েছে? আমি চাইলে অন্য বিভাগেও চাকুরী করতে পারব। - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৯) : ইসলামের দৃষ্টিতে মধ্যমপন্থার মূল্যায়ন কেমন? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৪৯) : আযানের পূর্বে ‘বিসমিল্ল­াহ’ বলা, কুরআনের আয়াত পড়া, ইসলামী গযল বলা, বিভিন্ন দু‘আ পড়া, মানুষকে ডাকাডাকি করা, ফজরের আযানের পূর্বে ‘আছ-ছালাতু খায়রুম মিনান্নাঊম’ বলা যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১৮) : বর্তমানে বহু ঈদগাহে ছালাতের পূর্বেই মুছল্লীদের নিকট হতে ছাদাক্বাহ ও দানের টাকা কালেকশন করা হয়। এটা শরী‘আত সম্মত? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১) : কেউ অন্যের নামে মিথ্যা কথা প্রচার করে থাকলে ক্ষমা নেওয়ার উপায় কী? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৭) : রামাযান মাসের ছিয়ামের ক্বাযা বাকি রেখে, শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম পালন করা যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৯) : জনৈক ব্যক্তি পূর্বে যাকাত আদায় করেনি। এখন বিগত বছরগুলোর যাকাত কিভাবে আদায় করব? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৩৫) : ফরয ছালাতের পর ১৯ বার ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১৯) : মৃতের গোসল করানোর ছহীহ পদ্ধতি কেমন? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৩) : মৃত ব্যক্তিকে ক্ববর দেয়ার কয়েক মাস পর ধসে নিচু হয়ে গেছে। তাতে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু বসবাস করে। প্রশ্ন হল, এখন সেই নিচু ক্ববরগুলোকে ভরাট করা যাবে কী? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ

ফেসবুক পেজ