মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ অপরাহ্ন
উত্তর : বিষয়টি স্পষ্টকরণের জন্য নিম্নে কতিপয় গবেষক, জগদ্বিখ্যাত ফক্বীহ্, সুবিজ্ঞ আলিম ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ উজ্জ্বল নক্ষত্রের বক্তব্য তুলে ধরা হল। যথা: (১) এ সম্পর্কে সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটিকে জিজ্ঞেস করা হয় যে,  কোন কল্যাণমূলক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে যাকাতুল ফিতর জমা করলেই কি আদায় করা হয়ে গেল? উত্তরে তাঁরা বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে যাকাতুল ফিতরের মাল কবজা করাটাই আদায় করা হিসাবে গণ্য হবে না। বরং কবজাকৃত মাল ঈদের ছালাতের পূর্বেই ফক্বীর-মিসকীনদের কাছে হস্তান্তর করা অপরিহার্য।

যদি কোন ফক্বীর-মিসকীন অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে কাউকে দায়িত্বশীল বানিয়ে নিজের অধিকার গ্রহণ করতে পারে অথবা যারা উপস্থিত আছে তাদের মধ্যেই ঈদের ছালাতের পূর্বে সমস্ত মাল বণ্টন করতে হবে (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ৮/৩১৮ পৃ.)। অন্যত্র জিজ্ঞেস করা হয় যে, কল্যাণকর সমিতি বা সংগঠনের প্রতিনিধিরা কি যাকাতুল ফিতরের মাল বিলম্ব করে ইচ্ছানুযায়ী দুঃস্থ-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করতে পারবেন? উত্তরে তাঁরা বলেন, ‘ঈদের ছালাতের পূর্বে হক্বদার বা অধিকারীদের নিকট যাকাতুল ফিতরের মাল পৌঁছানো সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপর অপরিহার্য। বিলম্ব করা জায়েয নয়। কেননা নবী (ﷺ) ঈদের ছালাতের পূর্বেই তা ফক্বীরদেরকে আদায় করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।

সেই জন্য প্রত্যেক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ঠিক ততটাই মাল একত্রিত করা উচিত যতটা তাঁরা ঐ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বণ্টন করতে পারবেন (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৯/৩৭৭-৩৮০ পৃ.)। অন্যত্র সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘ছালাতের মত যাকাতুল ফিতর আদায় করারও একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, আর তা হল- ঈদের ছালাতের পূর্বেই। সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করলে অবশ্যই গুনাহগার হবে। অতএব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিদারদের নিকট অধিকার পৌঁছানো অপরিহার্য। সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপর এটি একটি বিশাল বড় দায়িত্ব ও আমানাত। সুতরাং তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন হওয়া জায়েয নয়। আর যে সংগঠন উদাসীন তাদের উপর ভরসা করা যাবে না’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৯/৩৭০-৩৭৩, ৮/২৫৮-২৬০ ও ৮/২৭১-২৭২ পৃ.)।

(২) শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, ‘ফক্বীর ব্যক্তির সন্ধানে যাকাতুল ফিতর বিলম্বিত করা জায়েয কী?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘জায়েয নয়, বরং ঈদের ছালাতের পূর্বেই যাকাতুল ফিতর বাহির করা অপরিহার্য। যেমনটি রাসূল (ﷺ) বলেছেন। আলেমদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা জায়েয নয় (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১৪/২১৬-২১৮ পৃ.)।

(৩) অনুরূপভাবে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঈদের ছালাতের পর পর্যন্ত যাকাতুল ফিতর বণ্টন করতে বিলম্ব করলে তার ফিতরা ক্ববুল হবে না। কেননা এটি এমন একটি ইবাদত যা নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং কোন শারঈ অজুহাত ব্যতীত বিলম্ব করলে তার ফিতরা ক্ববুল হবে না। পক্ষান্তরে যদি কেউ ভুলে যায় কিংবা ঈদের রাত্রীতে ফক্বীর-মিসকীন না পায় সেটা ভিন্ন কথা’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল লিইবনে উছাইমীন, ১৮/২৭০-২৭৩ ও ১৮/২৬৫-২৬৮ পৃ.; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-১২৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কোন ব্যক্তির জন্য এটি জায়েয যে সে তার ফিতরার খাদ্যদ্রব্য তার প্রতিবেশীর কাছে রাখবে এবং বলবে যে, এগুলো অমুক ব্যক্তির জন্য, যখন সে আসবে তখন আপনি তাকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু তাকে যে কোনভাবে অবশ্যই ঈদের ছালাতের পূর্বে ফক্বীরদের হাতে পৌঁছাতে হবে...’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন, ১৮/২৮৫ পৃ.)।

(৪) অনুরূপভাবে শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ)ও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঈদের ছালাতের পূর্বেই যাকাতুল ফিতর দুঃস্থ-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করা অপরিহার্য। ছালাতের পর পর্যন্ত দেরি করা জায়েয নয়’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৯৭৯৩; আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ৮৪/১৩২ পৃ.)।

(১) ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ) যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন। অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হতে ছিয়ামকে পবিত্র করার লক্ষ্যে এবং মিসকীনদের খাদ্য স্বরূপ। যে ব্যক্তি ঈদের ছালাতের পূর্বে তা আদায় করবে সেটা ক্ববুল ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ছালাতের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ দান হিসাবে গৃহীত হবে’ (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৮২৭; সনদ হাসান, ছহীহুল জামি‘, হা/৩৫৭০)। উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় শামসুল হাক্ব আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই হাদীছটি ঐ সমস্ত আলেমের বিপক্ষে দলীল যারা বলেন যে, ঈদের পরেও যাকাতুল ফিতরা আদায় করা বা বণ্টন করা জায়েয’ (আওনুল মা‘বূদ, হা/১৬০৯-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।

(২) ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘রাসূল (ﷺ) প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলিমের উপর ছাদাকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক ছা‘ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের ছালাতে বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৬, ১৫০৭, ১৫০৮, ১৫১০, ১৫১১, ১৫১২; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪-৯৮৬)। ফিতরা আদায়ের উদ্দেশ্যে হল, ঈদের দিনে ফক্বীর-মিসকীন ও অসহায়-দরিদ্রদের একটু সম্পদশালী করে তোলা। যেন তাদেরকে ঈদের দিনেও ভিক্ষাবৃত্তি না করতে হয় (আল-মুগনী, ৩/৯০ পৃ.)।

উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা দেখলাম যে, বিষয়টি সম্পর্কে হাদীছের ভাষা এবং আলেমগণের মন্তব্যগুলো খুবই স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও কিন্তু আমাদের দেশের কিছু আলিম সঠিক বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তাঁরা আদায় করা শব্দটিকে জমা করা অর্থে ব্যবহার করেছেন। অথচ এখানে আদায় করা শব্দটি পৌঁছে দেয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পক্ষান্তরে ঈদের ছালাতের পর বণ্টন করা যাবে মর্মে একটি যঈফ হাদীছকে দলীল হিসবে উপস্থাপন করেছেন। নিম্নে হাদীছটির তাহক্বীক পেশ করা হল: (১)

عن عبدالله بن عمر قال: كان يأمرُنا أن نخرجَها (أي زكاةِ الفطرِ) قبل أن نصليَ ، فإذا انصرفَ قسَمَهُ بينهم وقال : أغْنُوهم عنِ الطلبِ

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে ছালাতের পূর্বেই যাকাতুল ফিতর বাহির করার আদেশ দিতেন। অতঃপর যখন তিনি ছালাত শেষ করতেন তখন তিনি তা তাদের মধ্যে বণ্টন করতেন এবং বলতেন, আজ তাদেরকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্ত করে দাও। হাদীছটি দুর্বল। আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী, হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী, শামসুল হাক্ব আযীমাবাদী, ইমাম শাওকানী, ইবনুল মুলাক্ক্বীন ও ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছটির সানাদে আবূ মা‘শার (أبو معشر) নামক দুর্বল রাবী থাকার কারণে হাদীছটি যঈফ (ইরওয়াউল গালীল, ৩/৩৩২-৩৩৩, হা/৮৪৪; ফাৎহুল বারী, ৩/৪৩৯; আওনুল ‘মাবূদ, ৫/৬; নাইনুল আওত্বার, ৪/২৫৫; আল-খুলাছাহ, ২/৬৬; আল-মাজমূঊ, ৬/১২৬ পৃ.)। (২)

كان عليه الصلاة والسلام يقسمها بين مستحقيها بعد الصلاة "

‘রাসূল (ﷺ) ঈদের ছালাতের পর ফিতরার মাল অধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন’। বর্ণনাটি যঈফ। আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী, হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী ও ইমাম ছানা‘আনী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছটির সনদে মুহাম্মাদ ইবনু উমার আল-ওয়াক্বিদী নামক দুর্বল রাবী থাকার কারণে হাদীছটি যঈফ (ইরওয়াউল গালীল, ৩/৩৩৪-৩৩৫, হা/৮৪৫; সুবুলুস সালাম, ২/১৮৭ পৃ.)।

অতএব উক্ত আলোচনা থেকে যে কথাগুলো পরিস্ফুটিত হয় তাহল, রাসূল (ﷺ) ঈদের ছালাতের পর বণ্টন করতেন মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলো ছহীহ নয়। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে যঈফ হাদীছ দ্বারা শরী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয় না। অতএব প্রমাণিত হল যে, আদায় করা ও বণ্টন করা একই জিনিস নয়, আর এর শেষ সময় একটাই, আর তা হল, ঈদের ছালাতের আগে আগেই।


প্রশ্নকারী : সেলিম, মাদারীপুর।





প্রশ্ন (১৯) : নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘জ্বরকে মন্দ বল না। কারণ জ্বর গুনাহসমূহকে অনুরূপ দূর করে, যেভাবে হাপর লোহার মরিচা দূর করে’। হাদীছটি কি ছহীহ? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১৯) : রামাযান মাসে ওমরাহ করলে হজ্জের নেকী পাওয়া যায়। এই বক্তব্য কি সঠিক? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৩) : কুরআন তেলাওয়াত করার সময় মসজিদে আযান শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে কোনটি উত্তম হবে তেলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া, না-কি আযানের জবাব দেয়া? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৯) : জনৈক আলেম বলেন, অতিরিক্ত কথা বলা মুনাফিকের লক্ষণ। উক্ত বক্তব্য কি সঠিক? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২০) : কবরের কাছে গিয়ে কোন্ দু‘আ পড়তে হবে? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৩৩) : পুরুষদের ফেয়ারনেস ক্রিম মাখা কি জায়েয? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১০) : ‘কতক ক্বারীকে কুরআন লা‘নত করে’। এ মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ আছে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (৩০): সাহু সিজদার সঠিক পদ্ধতি কী? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৭) : রামাযান উপলক্ষে এক টিভিতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহ্ফ পাঠ করবে ক্বিয়ামতের দিন তাকে এমন একটি নূর দেয়া হবে, যা তার অবস্থান থেকে মক্কা পর্যন্ত আলোকিত করবে’। হাদীছটি কি ছহীহ? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২) : তাহাজ্জুদ বা তারাবীহর মত নফল ছালাতে কুরআন দেখে দেখে পড়া যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (১৮) : যাকাত বা ওশরের টাকা মাদরাসায় দেয়া যাবে কি? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ
প্রশ্ন (২৮) : জনৈক আলেম বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) ফজরের ছালাতের সালাম ফিরিয়ে ঘুরে বসে দু’হাত উঠিয়ে দু‘আ করেছিলেন (ফাতাওয়া নাযীরিয়াহ, ১/৫৬৫ পৃ.; তুহফাতুল আহওয়াযী, ২/১৭১ পৃ., হা/২৯৯ এর ব্যাখ্যা দ্র.)। উক্ত দাবী কি সঠিক? - ফাতাওয়া বোর্ড, মাসিক আল-ইখলাছ

ফেসবুক পেজ