উত্তর : শরী‘আতের পরিভাষায় হিজড়া বলা হয় যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টি রয়েছে। অথবা কোনটিই নেই, শুধু পেশাবের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ রয়েছে। সংক্ষেপে একই দেহে স্ত্রী এবং পুংচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় পেশাব করার জায়গা দেখে, প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে সে যদি পুরুষাঙ্গ দিয়ে পেশাব করেছে তাহলে তার উপর পুরুষের বিধান প্রযোজ্য হবে, আর যদি স্ত্রী অঙ্গ দিয়ে পেশাব করে তাহলে তার উপর নারীর বিধান প্রযোজ্য হবে। দু’টি গোপনাঙ্গের মধ্যে সে একটি দ্বারা পেশাব করে আর অপরটি অতিরিক্ত (আল-মুগনী, ৬/২২২; কামূসুল ফিক্বহ, ৩/৩৭৭ পৃ.)। মনে রাখা উচিত যে, হিজড়ারা আর পাঁচটা মানুষের মতই মানুষ, আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। তারাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান, সৎকর্ম, ইবাদত-বন্দেগি ও হালাল-হারাম মেনে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। কারণ আল্লাহ তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। তারা আল্লাহর বিধান পালন করলে যেভাবে ছাওয়াব অর্জন করবে তেমনি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করলেও গুনাহগার হবে। শায়খ ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে সকল হিজড়ার দাড়ি গোঁফ গজানো ও স্বপ্নদোষ জাতীয় নরচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা পুরুষ শ্রেণীভুক্ত হিজড়া। এদের উপর পুরুষের বিধান কার্যকর হবে। সুতরাং এদের জন্য নারীদের বেশ ধারণ করা হারাম। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
لَعَنَ النَّبِيُّ ﷺ الْمُخَنَّثِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالْمُتَرَجِّلَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَقَالَ أَخْرِجُوْهُمْ مِنْ بُيُوْتِكُمْ.
‘নবী (ﷺ) পুরুষ হিজড়াদের উপর (অর্থাৎ যে নারীদের বেশ ধারণ করে) এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন এবং তিনি বলেছেন, ‘ওদেরকে ঘর থেকে বের করে দাও’ (বুখারী, হা/৫৮৮৬; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৩০)। আর যে সকল হিজড়ার মাঝে স্তন, ঋতুস্রাব এবং নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তারা নারী শ্রেণীভুক্ত হিজড়া। এদের উপর মহিলাদের বিধান কার্যকর হবে। সুতরাং এদের জন্য পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। এদের খুনছা গায়ির মুশকিলাহ বলা হয় অর্থাৎ যাদের সহজে চিনতে পারা যায়। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘কোন একদিন এক হিজড়াকে নবী (ﷺ)-এর নিকট আনা হল। তার হাত-পা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গানো ছিল। রাসূল (ﷺ) বললেন, এর এ অবস্থা কেন? বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে নারীর বেশ ধারণ করেছে। রাসূল (ﷺ) তাকে আন-নাক্বী (النَّقِيْعُ) নামক স্থানে নির্বাসন দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা কি তাকে হত্যা করবো না? তিনি বললেন, ছালাত আদায়কারীকে হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে (আবূ দাঊদ, হা/৪৯২৮)। পক্ষান্তরে যে সকল হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষের কোন নিদর্শনই পরিলক্ষিত হয় না, অথবা উভয় ধরণের নিদর্শনই সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়, শরী‘আতের পরিভাষায় তাদেরকে খুনছায়ে মুশকিলাহ বা জটিল হিজড়া বলা হয়। এরাই প্রকৃত হিজড়া (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৯/৪৩৫; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২০/২১-২৩; সুবুলুস সালাম, ২/১৯ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১১৪৬৭০)।
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে, যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সববিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমনি এর ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর এমনই এক বৈচিত্রময় সৃষ্টি লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। এরাও পূর্ণাঙ্গদের ন্যায় সমান মর্যাদার অধিকারী মানব। ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়াটা মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাক্বওয়াই হল মান-মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাক্বওয়া সম্পন্ন’ (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না। বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪)। ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সৃষ্টি হিসাবে প্রত্যেকেই হয় নারী কিংবা পুরুষ। এছাড়া তৃতীয় কোন সৃষ্টি নেই, তাই তাদের কোনভাবেই তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে না (সূরা আন-নাজ্ম: ৪৫; সূরা আন-নিসা: ১)। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না রাখার কারণে আমরা এদেরকে ভিন্ন একটি লিঙ্গ ও সম্প্রদায় হিসাবে আখ্যায়িত করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছি, এমনকি তাদের যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার রয়েছে, সেগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করছি। যুগ যুগ ধরে অবহেলা, অবমাননা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ঘৃণা, তিরস্কার, ভৎর্সনা আর টিপ্পনি খেয়ে এই ছোট জনগোষ্ঠীটি সমাজে বেঁচে আছে। তাই সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সকলকেই প্রচেষ্টা করতে হবে (ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩২০০৮৯)।
শায়খ ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘খুনছায়ে মুশকিলাহ বা জটিল হিজড়া অর্থাৎ যাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না, তাদের উপর জামা‘আতে শামিল হওয়া ওয়াজিব নয়। তবে তারা যদি শামিল হতে চাই তাহলে পৃথক কাতারে দাঁড়াবে, মহিলাদের ক্বাতারের পিছনে’ (আশ-শারহুল মুমতি‘, ৪/১৪০; আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২০/২৫ পৃ.)।
যাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না, তারা নারীদের মতই পর্দা সহকারে ছালাত আদায় করবে। কেননা তাদের মধ্যে নারীসুলভ আচরণ-ই বেশি প্রভাবিত হয়’ (আল- মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২০/২০-২৩; শারহুল মুনতাহা, ১/১৫০)। এ ধরনের হিজড়াগণ হজ্জের সকল বিধি-বিধান নারীদের ন্যায় পালন করবে (ফৎহুল ক্বাদীর ১০/৫৫৩; আল-বাহরুর রায়িক্ব, ৯/৩৩৬ পৃ.)। তারা নারীদের মতই পর্দা বিধান মেনে চলবে (আল-মাসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২০/২৬; রাদ্দুল মুহতার, ১০/৪৪৯ পৃ.)। এ শ্রেণীর হিজড়ারা সাক্ষ্যদান এবং বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রেও নারীদের আওতাভুক্ত। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর সাথে তার সাক্ষ্য একজন নারীর ন্যায় গণ্য হবে (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২০/২৮ পৃ.)। পিতা-মাতার সম্পত্তির মীরাছ পাবে (আল-মুগনী, ৬/২৫৩ পৃ)।
প্রশ্নকারী : মুহাম্মাদ তৈয়ব শাহ, মিরপুর, ঢাকা।