উত্তর : যে পাপ করলে মুরতাদ হয়ে যায় এবং উক্ত পাপ থেকে তওবা করার পূর্বেই মারা গেলে তার জানাযা পড়া যাবে না। যেমন
(১) শিরক অথবা কুফর অথবা স্পষ্ট নিফাক্বের মধ্যে লিপ্ত ব্যক্তি (সূরা আত-তাওবাহ: ৮৪, ১১৩; আল-মাজমূঊ লিন-নাবাবী, ৫/২৫৮; আল-মাওসূ‘আতিল ফিক্বহিয়্যাহ, ৪১/২১ পৃ.)।
(২) ছালাত পরিত্যাগকারী ব্যক্তি (ছহীহ মুসলিম হা/৮২; তিরমিযী, হা/২৬২১, ২৬২২; ইবনু মাজাহ, হা/১০৮০, ৮৯২; মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২০/৯৭; আছ-ছালাতু ওয়া আহকামু তারিকীহা, পৃ. ৬৪)।
(৩) জাদু প্রদর্শনকারী বা গণক ব্যক্তি (ছহীহ বুখারী, হা/২৭৬৬, ৬৮৫৭; মাজমূঊ ফাতাওয়া লি ইবনে বায, ৮/১১১ পৃ.)।
তবে ইসলাম থেকে খারিজ হয় না, এমন পাপ করলে তার জানাযা পড়া জায়েয। যদিও সে কাবীরাহ গুনাহে লিপ্ত ছিল। এ ব্যাপারে আলেমদের ইজমা‘ রয়েছে। যেমন ক্বাযী আয়ায, ইমাম ইবনে আব্দিল বার্র, ইমাম কুরতুবী ও ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘মুসলিম মৃত ব্যক্তির জানাযার ছালাত আদায় করতে হবে, এটি দিবালোকের উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত বিধান। ইসলামের স্বর্ণযুগে কোন মুসলিম ব্যক্তির জানাযার ছালাত ছেড়ে দেয়া হয়নি। তবে কিছু মানুষ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছিলেন, আমি পড়ব না, কিন্তু তোমরা পড়ে নাও। যেমন
(১) এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। রাসূল (ﷺ) এই ব্যক্তির জানাযার ছালাত নিজে আদায় না করলেও তিনি ছাহাবীাদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, صَلُّوْا عَلَى صَاحِبِكُمْ ‘তোমাদের সাথীর জানাযার ছালাত তোমরাই আদায় করে নাও’ (ছহীহ বুখারী, হা/২২৯৫)।
(২) রাসূল (ﷺ) গাণীমতের মাল আত্মসাৎকারী ব্যক্তির জন্যও একই কথা বলেছিলেন (আহকামুল জানায়িয লিল আলবানী, পৃ. ১০৩; আবূ দাঊদ, হা/২৭১০)।
(৩) আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি। শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি কাফির নয়, বরং সে ইসলামের উপরই মৃত্যুবরণ করেছে। সেও আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহপ্রাপ্ত হতে পারে। সুতরাং তার জন্য দু‘আ করা তোমাদের উপর অপরিহার্য। সে ইসলাম বহির্ভূত নয়। বরং সে আল্লাহ তা‘আলার মাশিয়্যাতের (ইচ্ছার) উপর নির্ভরশীল’ (ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩৮৯৩৬৮; ফিক্বাহ বিশ্বকোষ, ৬/২৯১-২৯২ পৃ.)। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপন করে, সে মহাপাপ করে’ (সূরা আন-নিসা : ৪৮)। ইমাম জারীর আত-ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কাবীরা গুনাহগার বা মহাপাপীদের বিষয়গুলো আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। শিরক ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে ক্ষমা করেও দিতে পারেন আবার চাইলে শাস্তি প্রদানও করতে পারেন’ (তাফসীর জারীর আত-ত্বাবারী, ৫/১২৬ পৃ.)।
জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তুফাইল ইবনু আমর আদ-দাওসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী (ﷺ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘.. তিনি স্বপ্নে আত্মহত্যাকারী লোকটিকে ভাল অবস্থায় দেখতে পেলেন, কিন্তু তিনি তার উভয় হাতকে আবৃত দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার রব তোমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? সে বলল, তাঁর নবী (ﷺ)-এর কাছে হিজরাত করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রাসূল (ﷺ) দু‘আ করলেন, اللَّهُمَّ وَلِيَدَيْهِ فَاغْفِرْ ‘হে আল্লাহ! আপনি তার হস্তদ্বয়কেও ক্ষমা করে দিন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬; মুসনাদ আহমাদ, হা/১৪৯৮২)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) উপরিউক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট কাবীরা গুনাহগার বা মহাপাপীরা কাফির নয়। তারা জাহান্নামে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না। বরং তাদের বিষয়গুলো আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাধীন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত’ (শারহুন নববী, ১১/১৬৭ পৃ.)। সুতরাং চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তাদেরও গোসল দিতে হবে, জানাযার ছালাত আদায় করতে হবে এবং মুসলিমদের ক্ববরস্থানে তাকে দাফন করতে হবে। যদি সে কাফির হত, তাহলে পূর্বের বিধানগুলো তার উপর প্রযোজ্য হত না (ফিক্বাহ বিশ্বকোষ, ৬/২৯২ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৬৩৯৩৮)।
তবে অনেকে দলীল হিসাবে নিম্মোক্ত হাদীছটি পেশ করে থাকে। জাবির ইবনু সামুরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, أُتِىَ النَّبِىُّ ﷺ بِرَجُلٍ قَتَلَ نَفْسَهُ بِمَشَاقِصَ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ ‘নবী (ﷺ)-এর সমীপে এক ব্যক্তিকে আনা হল যে নিজের আত্মাকে চেপ্টা তীরের ফলা দ্বারা হত্যা করেছে। ফলে তিনি তার জানাযার ছালাত আদায় করলেন না’ (ছহীহ মুসলিম হা/৯৭৮)। অথচ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদীছ ব্যাখ্যাতা ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ হাদীছকে তাঁরা প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন, যাঁরা মানুষকে সতর্ক করার জন্য আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া হবে না বলে মত দেন। এটি উমার ইবনু আব্দুল আযীয ও আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মত। তবে হাসান বাছারী, ইবরাহীম নাখঈ, ক্বাতাদাহ, ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিঈ ও জমহুর আলেমের মতানুযায়ী ‘তার জানাযা পড়া হবে’। উপরিউক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন, রাসূল (ﷺ) মূলত অন্যদেরকে এ ধরনের গর্হিত অপরাধ ও মন্দ কাজ থেকে সতর্ক করার জন্যই আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়ানো থেকে বিরত থেকেছেন। আর ছাহাবীগণ তাঁর স্থলে এমন ব্যক্তির জানাযা পড়েছেন (শারহুন নাবাবী, ৭/৪৭ পৃ.)। এছাড়া এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যারা আল্লাহ, রাসূল এবং ইসলামের বিধানে বিশ্বাসী, তারা কাবীরা গুনাহে লিপ্ত থাকলেও তাদের জানাযা আদায় করতে হবে এবং তাদের জন্য দু‘আ করতে হবে (ইকমালুল মু’লিম বি ফাওয়াঈদি মুসলিম, ৩/৪৫৪ ও ৫/৫২৩; শারহুন নাবাবী আলা মুসলিম, ৭/৪৭-৪৮; আত-তামহীদ, ৬/৩৩১-৩৩২; তাফসীরে কুরতুবী, ৮/২২১)। অনুরূপভাবে চার ফিক্বহী মাযহাব, জমহুর ফিক্বাহবিদ, সালাফে ছিিলহীন এবং আলেমদের ইজমা’ অনুযায়ী ‘বিদ‘আতী মুসলিমের জানাযার ছালাত আদায় করা বৈধ’ (বাদায়িউছ ছানায়ী, ১/৩১১; ফাৎহুল আযীয, ৫/১৪৪; রাওযাতুত্ব ত্বালিবীন, ২/১১৬; কাশ্শাফুল ক্বিন‘, ২/১২৩; আত-তামহীদ, ২৪/১৩২; আল-মুহাল্লা, ৩/৪০১)।
প্রশ্নকারী : আব্দুল মালেক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।