আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মদীনায় হিজরত
-মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম*
(৩য় কিস্তি)
অবশেষে মদীনার গন্তব্যস্থলে
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে প্রতিদিন মদীনাবাসীরা হাররাহ নামক স্থানে সমবেত হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করত। হাররাহ পাথুরে বিস্তীর্ণ এলাকা হিসাবে সুপরিচিত ছিল, যাকে মদীনার সীমানা হিসাবে ধরা হত। প্রত্যেক সকালে এসে দুপুরের তীব্র রোদ উঠা পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর আগমনের জন্য অপেক্ষা করত। শেষদিকে যখন একদিন এভাবে অপেক্ষা করে তারা বাড়িতে ফিরে যাবেন, এমন সময় এক ইহুদি তাদের দূর্গের উপর থেকে দেখতে পেল, সাদা কাপড়ে আবৃত কেউ যেন এগিযে আসছে। কিছুক্ষণ পর মরীচিকা কেটে গেলে স্পষ্ট দেখতে পেল নবীজির আগমন। তখন সে চিৎকার করে বলতে লাগল, يامعشر العرب هذا جدكم ‘হে আরববাসী! দেখো, তোমাদের বহু প্রতীক্ষিত পিতামহ এসে গেছেন’।[১]
মুসলিমগণ সাথে সাথে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে হাররাহ প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অভিবাদন জানাতে। তিনি তাদেরকে নিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে, ‘আমর ইবনু আউফ গোত্রে পৌঁছার পর থামলেন। একটানা আটদিন চলার পর ১৪ নববী বর্ষের ৮ই রবীউল আওয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে ক্বোবা উপশহরে শ্বেত-শুভ্র বসনে তাঁরা অবতরণ করেন।[২] মদীনার মুসলিম আনছারদের যারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আগে কখনো দেখেনি, তাদের অনেকে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নবী ভেবে অভিবাদন জানাতে লাগল। এটা বুঝতে পেরেই আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রোদ থেকে ছায়া দিয়ে তার মাথার উপর কাপড় ধরে দাঁড়ালেন, তখন লোকেরা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে চিনতে পারে। এ সময় তাঁর উপর অহি নাযিল হয়। মহান আল্লাহ বলেন, فَاِنَّ اللّٰہَ ہُوَ مَوۡلٰىہُ وَ جِبۡرِیۡلُ وَ صَالِحُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ بَعۡدَ ذٰلِکَ ظَہِیۡرٌ ‘নিশ্চয় আল্লাহই তার বন্ধু এবং জিবরীল (আলাইহিস সালাম) ও সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণও, উপরন্তু অন্যান্য ফেরেশতাগণ তার সাহায্যকারী’ (সূরা আত-তাহরীম : ৪)।[৩]
মদীনাবাসীরা তাদের ঘর ছেড়ে প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ছুটে আসতে লাগল, আর বলতে থাকল, يارسول الله يامحمد يارسول الله ‘হে আল্লাহর রাসূল! হে মুহাম্মাদ! হে আল্লাহর রাসূল!’[৪] সাক্ষাৎপর্ব শেষে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু আইয়ূব আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -এর বাড়িতে অতিথি হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খারিজা বিন যাইদ খাজরাজি আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ীতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।[৫]
সুধী পাঠক! এভাবে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সর্বদা পাশে থেকে অন্য সবার চেয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছিলেন। যে অভিজ্ঞতার আলোকেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুবরণের পর তিনি মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হিজরতের এ অভিযাত্রায় প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি ঘটনা ছিল তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি হিসাবে, মুসলিম হিসাবে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আগামী দিনের মুসলিম উম্মাহর নেতা হিসাবে গড়ে উঠেন। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের এ যাত্রায় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একমাত্র সঙ্গী হতে পারার সৌভাগ্য কেবল আবু বকর ছিদ্দীকই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লাভ করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যদি তোমরা তাকে [রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে] সাহায্য না কর, তবে আল্লাহই (তার সাহায্য করবেন যেমন তিনি) তার সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে, যখন কাফিররা তাঁকে দেশান্তর করেছিল, তিনি দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি যেই সময় উভয়ে গুহায় ছিলেন যখন তিনি স্বীয় সাথীকে [আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে] বলেছিলেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর সাহায্য) আমাদের সাথে আছেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁর প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাঁকে সাহায্য করলেন এমন বাহিনী দ্বারা, যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফিরদের বাক্য নীচু (অর্থাৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থ) করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণীই সমুচ্চ হল। আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ’ (সূরা আত-তওবাহ : ৪০)।
সুধী পাঠক! অন্যান্য ছাহাবীদের মধ্যে আবু বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শ্রেষ্ঠত্ব শুধু এই একটি আয়াতের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* কামিল, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
তথ্যসূত্র :
[১]. ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আবূ বকর ছিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহু, পৃ. ৪০, গৃহীত : ফুহূহুশ শাম লিল আযদী, পৃ. ২৬-২৭।
[২]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৭১।
[৩]. শামস্দ্দুীন ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ঈবাদ (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ২৭ তম সংস্করণ ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ৩য় খ-, পৃ. ৫৮।
[৪]. আল-হিজরাতু ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ. ৩৫৩; আবূ বকর ছিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহু, পৃ. ৪১।
[৫]. আল-হিজরাতু ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ. ৩৫৪; আবূ বকর ছিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহু, পৃ. ৪১।