আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণ
-আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস*
[খুলাফায়ে রাশেদার যুগ ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে সূচিত স্বর্ণযুগের ধারাবাহিক যুগ। এযুগে নৈতিকতা, মহানুভবতা, সাম্য, সুবিচার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত ও শক্তিশালী। সভ্যতা, সংস্কৃতি, তাহযীব ও তামাদ্দুন ছিল উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তাঁরা ছিলেন বিশ্বের মডেল। মতানৈক্য ও মতভেদের বিষাক্ত এই সমাজে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশিদীনের আদর্শকে পরিত্যাগ করার কোন সুযোগ নেই। বিভিন্ন হাদীছে খুলাফায়ে রাশিদীনের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাঁদের সময় যে নুবওঅতের ধারাবাহিকতায় সফলভাবে পরিচালিত হবে, তারও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে খিলাফতের বিস্তৃতি ও প্রভাবের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম খলীফা আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শাসনব্যবস্থাকে উন্নত প্রতীক হিসাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন। অতঃপর ইসলামী খেলাফতকে পৃথিবীর ইতিহাসে মডেল হিসাবে উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে তিনি সফল খলীফা। তিনি একাধারে ছিলেন সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, দূরদর্শী সেনানায়ক, শরী‘আত অভিজ্ঞ, তাক্বওয়াশীল, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা, দয়া ও মহানুভবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মূলত ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রাষ্ট্রনীতি ও সামরিক কৌশল নির্ধারণে ছিলেন অতুলনীয়। চতুর্থ খলীফা আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আমলে কিছু অস্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। তাই ‘খেলাফতী জাগরণ’ কলামের মাধ্যমে খুলাফায়ে রাশেদীনের বিস্তৃত বর্ণাঢ্য সত্য ইতিহাস সুধী পাঠকের উদ্দেশ্যে নিয়মিত উপস্থাপন করা হবে ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে ইচ্ছুক লেখকদের তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী লেখা সানন্দে গৃহীত হবে। [সম্পাদক]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরিচিতি
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রকৃত নাম আব্দুল্লাহ। উপনাম আবু বকর। তার পূর্ণাঙ্গ নাম হল- আব্দুল্লাহ বিন উছমান বিন ‘আমির বিন ‘আমর বিন কা‘ব বিন সা‘দ বিন তাইম বিন মুররাহ বিন কা‘ব বিন লুয়াই বিন গালিব কুরাশি তাইমী।[১] তাঁর কয়েকটি উপাধি নাম রয়েছে। যেমন, আতীক্ব[২] , ছিদ্দীক্ব[৩] , ছাহিব[৪] , আতকা[৫] এবং আওয়াহ [৬]। পিতার নাম উছমান এবং তাঁর উপনাম আবু কুহাফা।[৭] তিনি হস্তীবর্ষের পরের বছর জন্মগ্রহণ করেন। তবে কেউ বলেন, হস্তীবর্ষের তিন বছর পরে, কারো মতে, আড়াই বছর পরে।[৮] তাঁর মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখর। কুনিয়াত ছিল উম্মুল খাইর।[৯]
ইসলাম গ্রহণ
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণ ছিল তার জীবনের এক পবিত্র অধ্যায়ের সূচনা। এর মাধ্যমে তিনি লাভ করেছিলেন এক অর্থবহ জীবন। অন্যদিকে ইসলাম গ্রহণ ছিল সত্যের অন্বেষণে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দীর্ঘ যাত্রার এক সফল পরিসমাপ্তি। হাদীছে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ ‘প্রত্যেক শিশুই ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে; অর্থাৎ প্রত্যেক নবজাতকই এ পৃথিবীতে তার স্রষ্টার প্রতি অনুগত হিসাবে জন্ম নেয়। এরপর তার পিতামতাই তাকে ইহুদী অথবা খ্রিষ্টান অথবা অগ্নি উপাসকে পরিণত করে’।[১০]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ক্ষেত্রে তার এই জন্মগতভাবে প্রাপ্ত পবিত্র বৈশিষ্টটি ইসলাম গ্রহণ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। এই গোটা সময় ধরেই তিনি সত্যের অন্বেষণে রত ছিলেন; খুঁজে ফিরছিলেন সেই ধর্ম, যা তার পবিত্র ও নিষ্কলুষ সত্তার সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।
একজন ব্যবসায়ী হিসাবে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে আরব বিশ্বের দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করতে হত। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহর-নগর-বন্দর চষে বেড়িয়েছেন তিনি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে এসব সফরে তার সাক্ষাৎ হত; বিশেষ করে খ্রিষ্টানদের সাথে। তবে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ও একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো সম্পর্কে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। এ কারণে একটি ঘটনা তার চিন্তায় বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। একদিন তিনি কা‘বার চত্বরে বসেছিলেন। এমন সময় যায়দ বিন ‘আমর বিন নুফাইল এবং ইবনু আবু সাল্তের মাঝে তিনি কিছু কথোপকথন শুনতে পেলেন। ইবনু আবী সালত বললেন, ‘কল্যাণসন্ধানী, সুপ্রভাত’ সত্যের সন্ধান পেয়েছ? যায়দ না সূচক জবাব দিয়ে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন
‘যে দ্বীনে নেই একত্ব,
শেষ বিচারের দিনে তা হবে বরবাদ’।
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাদের একজনকে আরও বলতে শুনলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে হোক কিংবা আমাদের, একজন নবী আগমনের সময় ঘনিয়ে আসছে’।[১১]
পরবর্তীকালে এ ঘটনার উল্লেখ করে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘এ ঘটনার পূর্বে আমি কখনো শুনিনি যে, কোন নবী আসার সময় ঘনিয়ে আসছে’। এরপর আমি ওয়ারাকা বিন নাওফেলের নিকট গেলাম। তাকে আমি প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে প্রার্থনা করতে দেখতাম। তাকে দেখতে পেয়ে তার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম, আর যা শুনেছি সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, ভাতিজা! আমরা আসমানী কিতাব ও তার জ্ঞানের লোক। নিশ্চয় এই প্রতীক্ষিত নবী আসবেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ থেকে। বংশধারা সম্পর্কে আমার জ্ঞান থেকে বলতে পারি সমগ্র আরবে তোমাদের বংশধারাই সর্বশ্রেষ্ঠ’। অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচাজান, একজন নবী কীসের দিকে ডাকেন?’ ‘তিনি তা-ই শিক্ষা দেন ও বলেন, যা তাকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) বলা হয়। তিনি অন্যায় করেন না; অন্যায়কারীকে সাহায্য করেন না এবং অন্যায়কে সহ্যও করতে পারেন না’।[১২] এরপর যখন মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হলেন, তখন আমি তাঁর উপর ঈমান আনলাম এবং তাকে সত্যবাদী হিসাবে মেনে নিলাম।[১৩]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন প্রখর মেধাবী, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। ইসলামপূর্ব যুগেও আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাওহীদপন্থী কবিদের কবিতা মুখস্থ রাখতেন। একদা নবী করীম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ক্বীস ইবনু সা‘ইদার কবিতাগুলো কার মুখস্থ আছে, যা সে উকায বাজারে আবৃত্তি করত?’ তখন সব ছাহাবীরা চুপ থাকনে কেবল আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সাড়া দিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার মুখস্থ আছে’। এরপর তিনি ক্বীস ইবনু সা‘ইদার সেই কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন, যা সে উকায বাজারে মুশরিকদের সামনে আবৃত্তি করেছিলেন। সেটা হল- ‘আল্লাহর পসন্দের দ্বীন, তোমাদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন…’ ক্বীস ইবনু সা‘ইদের কথাগুলো আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার অন্তরে গেঁথে রেখেছিলেন এবং শোনার বহুদিন পরও এ কারণে তা তার মনে ছিল।
আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, শামে একবার আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে বুহাইরাহ নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রির সাক্ষাৎ হয়। তার কাছে তিনি তার একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চান। বুহাইরাহ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘মক্কা থেকে’। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন্ বংশে তার জন্ম’? আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উত্তর দিলেন, ‘কুরাইশ’। পাদ্রী পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী করেন?’ আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘আমি একজন ব্যবসায়ী’।
এরপর বুহাইরাহ তার স্বপ্ন সম্পর্কে শুনে বললেন, ‘যদি আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার স্বপ্ন সত্যি হয়, তাহলে আপনার জাতির মাঝে একজন নবী আসবেন এবং আপনি তার জীবদ্দশায় তার প্রধান সহচর থাকবেন এবং তার মৃত্যুর পর তার খলীফা হবেন’। উক্ত ঘটনা তখন কাউকে না বলে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) স্বপ্নের কথা গোপন রাখেন।[১৪]
ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিন্দুমাত্র ইতস্তত না হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ যে, পূর্ব থেকেই তিনি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। অন্য সবার মত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারও ভালভাবে জানা ছিল। এমনকি অন্য অনেকের চেয়ে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরও কাছ থেকে তিনি চিনতেন; জানতেন তার অনিন্দ্য চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে। তিনি জানতেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত সৎ ছিলেন যে, সামান্য থেকে সামান্যতম ব্যাপারেও মিথ্যা বলতেন না, কারও মানহানিকর কথা বলতেন না। এই যখন অবস্থা, তখন তিনি স্বয়ং আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলবেন- এটা তার কাছে যৌক্তিক কারণেই একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিল।[১৫]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানানোর সময় রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধু বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর নবী। আমাকে তিনি তাঁর বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন; আমি তোমাকে সত্যিই আল্লাহর দিকে আহ্বান করছি। আল্লাহর কসম তিনিই একমাত্র সত্য। আবু বকর! আমি তোমাকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করছি, যার কোন শরীক নেই; তাই তিনি ব্যতীত আর কারও ইবাদত কর না এবং জেনে রেখো, আল্লাহর আনুগত্যের উপরই সকল বন্ধুত্বের ভিত্তি’।[১৬]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এই আহ্বান পাওয়ার সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণ ও সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেন। তিনি তার এ অঙ্গীকার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন। বেশ কিছু বছর পর এক দিন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ছাহাবীদেরকে আবু বকর সম্পর্কে বলেন,
إِنَّ اللهَ بَعَثَنِى إِلَيْكُمْ فَقُلْتُمْ كَذَبْتَ وَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ صَدَقَ وَوَاسَانِىْ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَهَلْ أَنْتُمْ تَارِكُوْ لِىْ صَاحِبِىْ
‘যখন আমাকে আল্লাহ তোমাদের মাঝে পাঠালেন, তখন তোমরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছো; কিন্ত আবু বকর আমাকে সত্য সাব্যস্ত করেছিলেন। একই সাথে সে আমাকে তার জান-মাল দ্বারা সাহায্য করেছে, সান্ত¦না দিয়েছে। তাহলে কি তোমরা তাকে আমার খাতিরে সে কোন ভুলত্রুটি করলে ছেড়ে দেবে না?’ নবী করীম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একথাটি দু’বার বললেন’।[১৭]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন স্বাধীন পুরুষদের মাঝে প্রথম ইসলাম-গ্রহণকারী সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। ইবরাহীম, নাখঈ, হাস্সান বিন ছাবিত, ইবনু আব্বাস এবং আসমা বিনতু আবু বকরের মতে, আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)ই ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ ব্যক্তি। এছাড়া ইউসুফ বিন ইয়াকূব মাজিসুন তার পিতা এবং অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করে বলেন, তারা সকলেই বিশ্বাস করতেন যে, আবু বকরই (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ ব্যক্তি’।[১৮]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া প্রথম যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করা শুরু করেন তিনি হলেন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)।[১৯]
কারও মতে, প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ‘আলি (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবার কারও মতে, যায়িদ বিন হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু); আবার অনেকের মতে, খাদীজা। তবে ইমাম ইবনু কাছীর (রহিমাহুল্লাহ) উপর্যুক্ত সব মতের মাঝে সমন্বয় করে বলেছেন যে, খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ইসলাম গ্রহহণকারী প্রথম মহিলা, যায়িদ বিন হারিছা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীন দাস, ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রথম মুসলিম শিশু। তখন এদের প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারভুক্ত ছিলেন। আর আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম স্বাধীন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।[২০]
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেছেন, ‘আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলামের প্রতি আহ্বানের সাথে সাথে যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত খুশিমন নিয়ে তার কাছ থেকে বের হয়ে আসেন যে, গোটা মক্কাতে যেন তখন তিনিই সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। আর এত খুশির একটাই কারণ আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করেছেন’।[২১]
উপসংহার
ইসলামী দাওয়াতের সূচনালগ্নে আপতিত বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে যেমন খাদিজার মাধ্যমে সান্ত¦না প্রদান করেছেন অনুরূপভাবে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমেও সহযোগিতা করেছেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সামাজিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি পূর্ব থেকেই জানতেন। কেননা তিনি ছিলেন জ্ঞান ও চমৎকার চরিত্রের অধিকারী, দয়ালু, পুণ্যবান, মহৎ ব্যক্তি এবং সবার কাছে ভালবাসা, সম্মান ও প্রিয়পাত্র ছিলেন। সুতরাং বলা যায় যে, আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইসলাম গ্রহণ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক মহৎ অর্জন।
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।
[১] ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ফী তামইযিছ ছাহাবা (বৈরূত : দারুল জীল, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬৯।
[২] তিরমিযী, হা/৩৬৭৯; মিশকাত, হা/৬০২২; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৫৭৪; ছহীহুল জামে‘, হা/১৪৮২।
[৩] ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৫; তিরমিযী, হা/৩৬৯৭; মিশকাত, হা/৬০৭৪; হাকিম, হা/৪৪০৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩০৬।
[৪] সূরা আত-তাওবাহ : ৪০; ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৫৩।
[৫] সূরা আল-লাইল : ১৭; আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারুত ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪২২।
[৬] মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ আবু আব্দুল্লাহ আল-বাছরী, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা (বৈরূত : দারু ছাদির, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৮ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭১।
[৭] ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ৩।
[৮] আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০২; আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ৩।
[৯] আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ৪।
[১০] ছহীহ বুখারী, হা/১৩৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৮; মিশকাত, হা/৯০।
[১১] মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৮ম সংস্করণ, ১৪২১ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩১।
[১২] প্রাগুক্ত।
[১৩] নাফসুল মাছদার, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৫৪।
[১৪] আত-তারীখুল ইসলামী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২।
[১৫] তারিখ দাওয়াহ ইলাল ইসলাম ফী ‘আদ খুলাফা রাশিদুন, পৃ. ৪৪।
[১৬] আত-তারীখুল ইসলামী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২-৩৩।
[১৭] ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৬১।
[১৮] আবুল ফারয আব্দুর রহমান ইবনু ‘আলী ইবনু মুহাম্মাদ, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৭।
[১৯] আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ১৩।
[২০] আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ (দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৬ এবং ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৯।
[২১] আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০।