আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মদীনায় হিজরত
-মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
(২য় কিস্তি)
আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হিকমাহ অবলম্বন
যাত্রাবস্থায় আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সর্বদা সওয়ারীতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছনে বসতেন। কেননা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মধ্যে বার্ধক্যের নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারায় তখনো চাকচিক্য বজায় ছিল। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরব্বী ভেবে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেই করত। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন, هَذَا الرَّجُلُ يَهْدِيْنِى السَّبِيْلَ ‘এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’।[১] এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন লোক হবে। এর মাধ্যমে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিচয় গোপন করতেন।
উম্মু মা‘বাদের সাথে সাক্ষাৎ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মদীনা অভিমুখে যাত্রার প্রতিমধ্যে খুযা‘আহ গোত্রের অতিথিপরায়ণ মহিলা উম্মু মা‘বাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, পানাহারের কিছু আছে কি? ঐ মহিলার অভ্যাস ছিল তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে তিনি ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন এমন হয়েছিল যে, বাড়ীতে পানাহারের মত কিছুই ছিল না। ঐ সময়টা ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। বকরীগুলো সব মাঠে নিয়ে গেছেন স্বামী আবূ মা‘বাদ। একটা কালো দুর্বল বকরী যে মাঠে যাওয়ার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা তাঁবুর এক কোণে বাধা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেটাকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মু মা‘বাদ বললেন, ওর পালানে কিছু থাকলে আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বকরীটির বাটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখলেন ও বরকতের দু‘আ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরীটির বাট দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি দোহন করতে থাকলেন। তাতে দ্রুত পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথমে বাড়ীওয়ালী উম্মু মা‘বাদকে পান করালেন। তারপর সাথীদের এবং সবশেষে তিনি নিজে পান করলেন। এরপর এক পাত্র পূর্ণ করে উম্মু মা‘বাদের কাছে রেখে তারা পুনরায় যাত্রা করলেন। অল্পক্ষণ পরেই আবু মা‘বাদ বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন-
وَاللهِ هَذَا صَاحِبُ قُرَيْشٍ …. لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَصْحَبَهُ وَلَأَفْعَلَنَّ إَِنْ وَجَدْتُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيْلًا
‘আল্লাহর কসম! ইনিই কুরাইশদের সেই মহান ব্যক্তি হবেন। যার সম্পর্কে লোকেরা নানা কথা বলে থাকে।… আমার দৃঢ় ইচ্ছা আমি তার সাহচর্য লাভ করি এবং সুযোগ পেলে আমি তা অবশ্যই করব’।[২]
আসমা বিনতে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা জানতাম না রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন পথে মদীনায় গমণ করেছেন। কিন্তু দেখা গেল যে, হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে জনৈক অদৃশ্য ব্যক্তি একটি কবিতা পাঠ করতে করতে এল এবং মানুষ তার পিছে পিছে চলছিল। তারা সবাই তার কবিতা শুনছিল। কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। এভাবে বারবার শোনা যাচ্ছিল لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। সেই সাথে পঠিত পাঁচ লাইন কবিতা শুনে আমরা বুঝেছিলাম যে, তিনি উম্মু মা‘বাদের তাঁবুতে অবতরণ করে ঐ পথ ধরে মদীনা গিয়েছেন। উক্ত বার্তায় পাঁচ লাইন বিশিষ্ট কবিতার প্রথম দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-
جَزَى اللهُ رَبّ الْعَرْشِ خَيْرَ جَزَائِهِ + رَفِيْقَيْنِ حَلّا خَيْمَتِيْ أُمِّ مَعْبَدٍ
هُمَا نَزَلَا بِالْبِرِّ وَارْتَحَلَا بِهِ + وَأَفْلَحَ مَنْ أَمْسَى رَفِيْقَ مُحَمَّدٍ
‘আরশের মালিক আল্লাহ তাঁর সর্বোত্তম বদলা দান করেছেন তাঁর দুই বন্ধুকে, যারা উম্মু মা‘বাদের দুই তাঁবুতে অবতরণ করেছেন। তাঁরা কল্যাণের সাথে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সাথে গমন করেছেন। তিনি সফলকাম হয়েছেন যিনি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বন্ধু হয়েছেন’।[৩]
বারা বিন আযেব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন, একদিন আমি আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হিজরতের রাতে আপনারা কিভাবে সফর করেছিলেন, আমাকে একটু বলুন। তখন তিনি বললেন, আমরা সারা রাত চলে পরদিন দুপুরে জনমানবহীন রাস্তার পাশে একটা লম্বা ও বড় পাথরের ছায়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শুইয়ে দিলাম। অতঃপর আমি চারিদিকে দেখতে লাগলাম। এমন সময় একটি মেষপাল আসতে দেখলাম। আমি মেষপালককে বললে সে দুগ্ধ দোহন করে দিল। অতঃপর আমরা উভয়ে দুধ পান করে তৃপ্ত হলাম। এরপর সূর্য ঢলে পড়লে আমরা রওয়ানা হলাম। ইতিমধ্যে দূর থেকে দেখলাম সুরাক্বা বিন মালেক আমাদের পিছু নিয়েছে। তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর কাছে আসতেই তার ঘোড়া পেট পর্যন্ত শক্ত মাটিতে দেবে গেল। সে বলল, আমি দেখলাম তোমরা আমার বিরূদ্ধে বদ দু‘আ করেছো। এক্ষণে আমার জন্য দু‘আ কর। আমি তোমাদের পক্ষে শত্রুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জন্য দু‘আ করলেন এবং সে মুক্তি পেল। অতঃপর সে ফিরে যাওয়ার পথে পিছু ধাওয়াকারী লোকদের বলতে থাকে যে, আমি তাঁকে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। অতএব তোমরাও ফিরে চল। এভাবে সে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।[৪]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* এম. এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯১১।
[২]. হাকিম, হা/৪২৭৪।
[৩]. আর-রাহীকুল মাখতূম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৩।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬১৫।