নির্যাতিত মুসলিম ক্রীতদাস মুক্তকরণে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)
-আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইউনুস*
ভূমিকা
তাওহীদী কালেমার দাওয়াত যখন মক্কার আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেল এবং মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করল, তখন মক্কার কাফের, মুশরিকরা বাধার প্রাচীর নিয়ে হাজির হল। কিন্তু মানুষকে তারা ইসলাম থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হল। ফলে ক্ষোভে-হতাশায় মুসলিমদের উপর তারা কঠিনভাবে অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে দিল। এক্ষেত্রে সাধারণত যারা দুর্বল প্রকৃতির মুসলিম তাদেরকেই মুশরিকরা টার্গেট করত। যেমন ক্রীতদাস বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। মূলত তাদের উপর অত্যাচার করার কারণ ছিল- তাদেরকে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করা এবং প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের কাছে হুমকি বার্তা পৌঁছানো। অন্যদিকে এর মাধ্যমে তারা তাদের রাগ ও ক্ষোভ নিবারণ করত। নিম্নে কুরাইশ কাফের ও মুশরিক কর্তৃক মুসলিম ক্রীতদাসদের উপর যে অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়েছিল এবং আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অনেক দাসকে ক্রয় করে যে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন তার ছিটেফোঁটা কিছু দুর্লভ ইতিহাস উল্লেখ করা হল।
বিলাল ইবনু রাবাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)
বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -এর কোন পরিবার ছিল না। এমনকি তাকে রক্ষা করবে এমন কোন আপনজনও ছিল না। অন্যদিকে কুরাইশ কাফিররা তাকে মানুষ হিসাবেই গণ্য করত না। তাদের কাছে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিল রক্ত-মাংসের এক গৃহপালিত পশু, যাকে তাদের ইচ্ছামত বেচাকেনা করা যেত। আর পশুর মতই সকল আদেশ-নিষেধ মানতে বাধ্য করা যেত। কিন্তু এ প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ অনেক ক্রীতদাস মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রচারিত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, যা কুরাইশদের কাছে ছিল অকল্পনীয় এবং অনেকটা ভীতিকর। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদেরকে চরম অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এমনকি তারা ইসলামের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। বিশেষ করে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মৃত্যুকেই সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। যদিও হৃদয় ঈমানের উপর অবিচল ও স্থির থাকলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুখে অবিশ্বাস করার কথা বলা অনুমোদিত। তবুও বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হৃদয়ে ঈমানও ছিল এবং তাঁকে বাধ্যও করা হয়েছিল; কিন্তু তারপরেও তিনি বিন্দুমাত্র আপোস করেননি। ক্রীতদাস বেলাল ইবনু রাবাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিবরণ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ أَوَّلُ مَنْ أَظْهَرَ إِسْلَامَهُ سَبْعَةً رَسُوْلُ اللهِ وَأَبُوْ بَكْرٍ وَعَمَّارٌ وَأُمُّهُ سُمَيَّةُ وَصُهَيْبٌ وَبِلَالٌ وَالْمِقْدَادُ فَأَمَّا رَسُوْلُ اللهِ فَمَنَعَهُ اللهُ بِعَمِّهِ أَبِىْ طَالِبٍ وَأَمَّا أَبُوْ بَكْرٍ فَمَنَعَهُ اللهُ بِقَوْمِهِ وَأَمَّا سَائِرُهُمْ فَأَخَذَهُمُ الْمُشْرِكُوْنَ فَأَلْبَسُوْهُمْ أَدْرَاعَ الْحَدِيْدِ وَصَهَرُوهُمْ فِى الشَّمْسِ فَمَا مِنْهُمْ إِنْسَانٌ إِلَّا وَقَدْ وَاتَاهُمْ عَلَى مَا أَرَادُوْا إِلَّا بِلَالٌ فَإِنَّهُ هَانَتْ عَلَيْهِ نَفْسُهُ فِى اللهِ وَهَانَ عَلَى قَوْمِهِ فَأَعْطَوْهُ الْوِلْدَانَ وَأَخَذُوْا يَطُوْفُوْنَ بِهِ شِعَابَ مَكَّةَ وَهُوَ يَقُوْلُ أَحَدٌ أَحَدٌ
‘প্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণাকারী দলে সাতজন ছিলেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর, ‘আম্মার, ‘আম্মারের মা সুমাইয়া, সুহাইল, বিলাল এবং মিক্বদাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর চাচা আবু তালিবের নিরাপত্তায় রেখেছিলেন। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর নিজ গোত্রের নিরাপত্তা বলয়ে ছিলেন। কিন্তু অবশিষ্টরা কুরাইশদের রোষানলে পড়ে। কুরাইশরা তাদেরকে লোহার বর্ম পরিয়ে প্রখর সূর্যের নীচে উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে রাখত। অমানুসিক অত্যাচারের মুখে তারা কুরাইশদের চাহিদা মোতাবেক মুখে ইসলামকে অস্বীকার করলেও তাদের অন্তর ছিল ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত; তবে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মুখেও অস্বীকার করেননি। তিনি কুরাইশ কাফিরদের সাথে আপোস করার চেয়ে আল্লাহর জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়াকে উত্তম মনে করেছিলেন। তারা মক্কার দুষ্ট ছেলেদের হাতে তাকে তুলে দিত, তারা তাকে মক্কার উপত্যকায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বেড়াত; কিন্তু বেলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সবময় বলতেন ‘আহাদ, আহাদ, অর্থাৎ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক’।[১]
বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর অত্যাচারের বিবরণ দিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু হিশাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করেছেন জানতে পেরে তার মালিক উমাইয়া ইবনু খালফ প্রথমে তাকে ভয় দেখাল, তারপর প্রলোভনও দেখাল। কিন্তু তিনি ইসলাম ত্যাগ করে আবার জাহেলিয়াতে ফিরে যেতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। একজন ক্রীতদাস স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম বেছে নিয়েছে দেখে উমাইয়া রাগে-ক্ষোভে ফুসে উঠল। সে ঠিক করল, তাকে এমন শাস্তি দেবে, যা অন্যদের কাছেও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সারাদিন অভুক্ত ও পিপাসার্ত রাখার পর উমাইয়া তাকে মরুর তপ্ত বালুতে নিয়ে যেত। এরপর সে তার অন্য দাসদের আদেশ দিত, তীব্র গরম বালুর উপরে শুইয়ে রেখে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বুকের উপর পাথর চাপিয়ে দিতে। তার হাতগুলোও বেঁধে দেয়া হত, যেন তিনি নড়াচড়া করতে না পারেন। এরপর উমাইয়া তাকে বলত, ‘তোমাকে এ অবস্থাতেই মরতে হবে, নিজের ভাল চাইলে মুহাম্মাদকে অবিশ্বাস করে লাত-উয্যার ইবাদত শুরু কর’। কিন্তু তিনি এত কষ্টের মাঝেও ঈমানকে বিসর্জন দিয়ে বাতিলের সাথে আপোস করেননি। উমাইয়ার অত্যাচারের মুখে তিনি শুধু একটা কথা জোরালোভাবে বলে যেতেন, ‘আহাদ, আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ এক আল্লাহ এক।[২]
উমাইয়া এবং তার গ্যাংরা বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর এতই অত্যাচার করে যে, একসময় তারা ভাবল সে হয়ত মরেই যাবে। এমন সময় একদিন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এগিয়ে এলেন এবং উমাইয়াকে বললেন, ‘এ মানুষটির ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। আর কত!’ উমাইয়া বলল, ‘তুমিই তো একে নষ্ট করেছ, তাহলে তুমি তাকে বাঁচাচ্ছো না কেন?’ আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘তাহলে আমি তা-ই করব। আমার একজন কাল ক্রীতদাস আছে, যে এর চেয়েও শক্তিশালী এবং তোমার ধর্মে বিশ্বাসী। বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বদলে তুমি তাকে নাও আর বিলালকে দিয়ে দাও’। উমাইয়া বলল, ‘ঠিক আছে, মেনে নিলাম’। চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে মুক্ত করে দিয়ে স্বাধীন মানুষ হিসাবে ঘোষণা দিলেন।[৩] অন্য বর্ণনায় এসেছে, দাসের বিনিময়ে নয়, বরং তিনি ৭ কিংবা ৪০ উকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে কিনে মুক্ত করেছিলেন।[৪]
সুধী পাঠক! কঠিন পরীক্ষার শেষে থাকে মনজুড়ানো পুরস্কার। বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কুরাইশদের হাতে যে অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করেছেন, মৃত্যুর দোয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মত মহৎ ব্যক্তির মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করলেন। মুক্ত বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর দাসত্বের সময়ে যেমন দৃঢ়চিত্ত মনোবলের অধিকারী ছিলেন, তেমনি দৃপ্ত শপথ নিয়ে ইসলামের উপর অটল থাকেন। বরং তিনি ইসলামের খেদমতে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। তার শক্তি ও সময় আরও বেশি ইসলামের পথে ব্যয় করার সুযোগ পেলেন। তিনি সার্বক্ষণিক নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে থাকতেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। এমনকি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে বলেন যে, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ لِبِلَالٍ عِنْدَ صَلَاةِ الْغَدَاةِ يَا بِلَالُ حَدِّثْنِىْ بِأَرْجَىْ عَمَلٍ عَمِلْتَهُ عِنْدَكَ فِى الإِسْلَامِ مَنْفَعَةً فَإِنِّىْ سَمِعْتُ اللَّيْلَةَ خَشْفَ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَىَّ فِى الْجَنَّةِ قَالَ بِلَالٌ مَا عَمِلْتُ عَمَلًا فِى الإِسْلَامِ أَرْجَىْ عِنْدِىْ مَنْفَعَةً مِنْ أَنِّى لَا أَتَطَهَّرُ طُهُوْرًا تَامًّا فِىْ سَاعَةٍ مِنْ لَيْلٍ وَلَا نَهَارٍ إِلَّا صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُوْرِ مَا كَتَبَ اللهُ لِىْ أَنْ أُصَلِّىَ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাতের সময় বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, হে বিলাল! তুমি আমাকে বল, ইসলামের মধ্যে তুমি এমন কোন্ আমল করেছ, যার উপকারের বিষয়ে তোমার অধিক প্রত্যাশা। কারণ আজ রাতে আমি জান্নাতে আমার সম্মুখে তোমার জুতার শব্দ শুনেছি। বর্ণনাকারী বলেন, বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ইসলামের মাঝে এর চেয়ে অধিক লাভের প্রত্যাশা আমি অন্য কোন আমলে করতে পারি না যে, আমি দিনে বা রাতে যখনই পূর্ণ ওযূ করি, তখনই আল্লাহ তা‘আলা আমার ভাগ্যে যা লিখেছেন ঐ ওযূ দিয়ে ছালাত আদায় করে থাকি’।[৫]
ছাহাবীদের মাঝে বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মর্যাদা অনেক। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, ‘উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, أَبُوْ بَكْرٍ سَيِّدُنَا وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا يَعْنِيْ بِلَالًا ‘আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের নেতা এবং তিনি আমাদের আরেক নেতা বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে মুক্ত করেছিলেন’।[৬]
‘আমির ইবনু ফুহাইরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)
‘আমির ইবনু ফুহাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে ইবনু হিশাম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, ‘আমির ইবনু ফুহাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বনু আসাদ এর একজন অনারব নিগ্রো দাস ছিল। পরবর্তীতে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে খরীদ করে আযাদ করে দেন।[৭] ‘আমির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন ‘আয়েশার বৈপিত্রীয় ভাই তুফাইল ইবনু আব্দুল্লাহর দাস। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় আরকাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর গৃহে আশ্রয় গ্রহণের পূর্বেই ‘আমির ইবনু ফুহাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে তিনি কুরাইশদের কঠোর অত্যচারের স্বীকার হন। অবশেষে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।[৮] যিনি বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে ‘বিরে মাউনাহ’-এর হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় শহীদ হন।[৯]
যিননিরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)
যিননিরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মুক্ত হওয়ার পরপরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এতে কুরাইশরা বলতে শুরু করে, লাত ও উয্যাহই তার দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে। যিননিরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এতে বিন্দুমাত্র হতোদ্যম না হয়ে দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, كذبوا وبيت الله ما تضر اللات والعزى ‘তারা মিথ্যা বলছে, আল্লাহর ঘরের কসম! লাত উয্যা কেউই কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না’। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।[১০]
উম্মু ‘উবাইস (রাযিয়াল্লাহু আনহা)
উম্মু উবাইস (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কেও আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেন।[১১]
নাহদিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও তার কন্যা
আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নাহদিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও তার কন্যাকেও মুক্ত করেছিলেন। তারা উভয়েই বানু ‘আবদুদ দার গোত্রের এক মহিলার দাসী ছিলেন। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাদেরকে একদিন দেখেন যে, তারা আটা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাদের মনিব মহিলাকে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়ার অনুরোধ করলেন। কিন্তু সে উত্তর দিল, ‘আল্লাহর কসম! কখনো আমি তাদেরকে মুক্তি দেব না’। তখন আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বললেন, হে অমুকের মা! তুমি তোমার হাত থেকে তাকে মুক্ত করে দাও। মহিলা বলল, ‘তুমিই তো এদের মাথা খারাপ করেছ, তাহলে তুমিই কিনে তাদেরকে মুক্ত করে দাও’। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মহিলার দাবি অনুযায়ী মূল্য পরিশোধ করে তাদেরকে ক্রয় করে বললেন, ‘আমি তাদের নিয়ে নিলাম এবং মুক্ত করলাম’। এরপর তিনি নাহদিয়া ও তার কন্যার কাছে গিয়ে সুসংবাদ জানিয়ে বললেন, ‘তার আটা তাকে ফেরত দাও’। তারা বললেন, ‘আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)! আমরা কি হাতের কাজটা শেষ করব না?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা চাইলে শেষ করতে পার’।[১২]
দাস মুক্তকরণে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পিতার প্রতিক্রিয়া
মুসলিমদের মধ্যকার দুর্বল দাস মুক্ত করার জন্য আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর এত অর্থব্যয় দেখে অধিকাংশ কুরাইশ তাকে উপহাস করত। অন্যদিকে তাঁর নিজ পিতা যেহেতু তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, তিনিও তাকে এ কাজে নিরুৎসাহিত করতেন। একদিন তিনি আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডেকে বললেন,
يَا بُنَيَّ إِنِّيْ أَرَاكَ تُعْتِقُ رِقَابًا ضِعَافًا فَلَوْ أَنَّكَ إِذْ فَعَلْتَ مَا فَعَلْتَ أَعْتَقْتَ رِجَالًا جُلْدًا يَمْنَعُوْنَكَ وَيَقُوْمُوْنَ دُوْنَكَ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ يَا أَبَتِ إِنِّيْ أُرِيْدُ مَا أُرِيْدُ.
‘বৎস, তুমি বেছে বেছে দুর্বল দাসগুলোকেই মুক্ত করছ। তুমি যদি মুক্ত করতেই চাও, তবে শক্ত-সামর্থ্য যুবকদের মুক্ত কর। তারা তোমাকে নিরাপত্তা দেবে’। আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘হে সম্মানতি পিতা! আমি তো এসব কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করছি’।[১৩] তখন আল্লাহ তা’আলা আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁর উপর রহমত ও বরকত সম্পর্কে আয়াত নাযিল করেছিলেন, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। তিনি বলেন,
فَاَمَّا مَنۡ اَعۡطٰی وَ اتَّقٰی- وَ صَدَّقَ بِالۡحُسۡنٰی- فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡیُسۡرٰی- وَ اَمَّا مَنۡۢ بَخِلَ وَ اسۡتَغۡنٰی- وَ کَذَّبَ بِالۡحُسۡنٰی- فَسَنُیَسِّرُہٗ لِلۡعُسۡرٰی – وَ مَا یُغۡنِیۡ عَنۡہُ مَا لُہٗۤ اِذَا تَرَدّٰی- اِنَّ عَلَیۡنَا لَلۡہُدٰی- وَ اِنَّ لَنَا لَلۡاٰخِرَۃَ وَ الۡاُوۡلٰی-فَاَنۡذَرۡتُکُمۡ نَارًا تَلَظّٰی- لَا یَصۡلٰىہَاۤ اِلَّا الۡاَشۡقَی- الَّذِیۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی-وَ سَیُجَنَّبُہَا الۡاَتۡقَی- الَّذِیۡ یُؤۡتِیۡ مَالَہٗ یَتَزَکّٰی- وَ مَا لِاَحَدٍ عِنۡدَہٗ مِنۡ نِّعۡمَۃٍ تُجۡزٰۤی- اِلَّا ابۡتِغَآءَ وَجۡہِ رَبِّہِ الۡاَعۡلٰی- وَ لَسَوۡفَ یَرۡضٰی
‘অনন্তর যে দান করে ও মুত্তাক্বী হয়, যা উত্তম তাকে সত্য মনে করল। অচিরেই আমরা তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। পক্ষান্তরে কেউ কার্পণ্য করল ও বেপরোয়া হল। আর উত্তম জিনিসকে মিথ্যা মনে করল। অচিরেই তার জন্য আমরা সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ এবং তার সম্পদ তার কোন কাজে আসবে না, যখন সে পতিত হবে (জাহান্নামে)। আমার দায়িত্ব শুধু পথ নির্দেশ করা আর নিশ্চয় আমরা পরকাল ও ইহকালের মালিক। আমরা তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি; নিতান্ত হতভাগ্য ব্যতীত কেউ তাতে প্রবেশ করবে না, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়; আর তা হতে অতি সত্বর মুক্ত রাখা হবে বড় মুত্তাকীদেরকে, যে স্বীয় সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য এবং তার প্রতিকারও অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং শুধু তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়; সে তো অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে’ (সূরা আল-লাইল : ৫-২১)।[১৪]
উপসংহার
দুর্বল ও অসহায় মুসলিমদের জন্য আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন করুণার আধার। এজন্য যে সমস্ত ক্রীতদাস ইসলাম গ্রহণের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশকেই তিনি ক্রয় করে দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শানে পবিত্র কুরআনের আয়াতও নাযিল করেছেন, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। ইসলামের শত্রুদের হাত থেকে অত্যাচারিত, শোষিত ও নিপীড়িত মুসলিমদের উদ্ধারে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দৃষ্টান্ত চির অনুসরণীয় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
[১]. ইবনু মাজাহ, হা/১৫০, আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, সনদ হাসান ছহীহ; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৮৩২, শু‘আইব আরনাঊত্ব (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, সনদ হাসান; মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ছহীহুস সীরাতিন নাবাবিয়্যাহ (আম্মান : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, তাবি), পৃ. ১২১-১২২।
[২]. মাহমূদ আল-বাগদাদী, ‘আত্বীকুল ‘উত্বাক্বা (আবু বকর ছিদ্দীক), পৃ. ৩৯-৪০।
[৩]. আব্দুল মালিক ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ (বৈরূত : দারুল জাইল, ১ম সংস্করণ, ১৪১১ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬০; ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ২৩-২৪; ।
[৪]. ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী, আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ২৪; ড. মুনীর আল-গাযবান, আত-তারবিয়াতুল ক্বিয়াদিয়্যাহ (দারুল ওয়াফা, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪০।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫৮ ‘মর্যাদা’ অধ্যায়-৪৫, ‘বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মর্যাদা’ পরিচ্ছদ-২১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৬৭০; ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, হা/১২০৮।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৫৪ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়-৬২, ‘বিলাল (রা.)-এর মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ-২৩; মিশকাত, হা/৬২৫০; ত্বাবাক্বাতুল কুবরা, হা/৩৬৪০, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩২।
[৭]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৫।
[৮]. ইবনুল আছীর, উসদুল গাবা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩।
[৯]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪০।
[১০]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬০-১৬১।
[১১]. তাক্বীউদ্দীন আলী ইবনু আহমাদ আল-মাক্বরীযী, ইমতাঊল আসমা‘ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৬৫; আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬০।
[১২]. ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬১; আবু বকর ছিদ্দীক্ব রাযিয়াল্লাহু আনহু শাখছিয়াতিহি ওয়া আছরিহি, পৃ. ২৪।
[১৩]. ইমতা‘ঊল আসমা‘, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬; সুলাইমান ইবনু মূসা আল-কিলাঈ আল-আন্দালুসী, আল-ইকতিফা (বৈরূত : ‘আলিমুল কুতুব, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮১; ইবনু কাছীর, আল-ফুছূল ফী সীরাতির রাসূল, পৃ. ১১; ইবনু হাযম আন্দালুসী, জাওয়ামিঊস সীরাতি ওয়া খামসু রাসাইলিন উখরা (মিসর : দারুল মা‘আরিফ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯০০ খ্রি.), পৃ. ৫৫।
[১৪]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪২২; আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীর কালামিল মান্নান (মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪২০ হি./২০০০ খ্রি.), পৃ. ৯২৬।