উত্তর : ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হিকমাহ’ বলতে বুঝায় সঠিক সময়ে, সঠিক কাজ, সঠিক উদ্দেশ্যে করা’ (মাদারিজুস সালিকীন, ২/৪৪৯ পৃ.)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, অধিকাংশ আলেম বলেন, এখানে ‘হিক্মাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে দ্বীনের সামগ্রিক জ্ঞানার্জন অর্থাৎ কুরআনুল কারীম ও হাদীছের পূর্ণ পারদর্শিতা লাভ, যার দ্বারা নাসিখ ও মানসুখ অর্থাৎ রহিতকৃত ও রহিতকারী, স্পষ্ট ও অস্পষ্ট, পূর্বের ও পরের, হালাল ও হারামের এবং উপমার আয়াতসমূহের পূর্ণ পরিচয় লাভ হয়। সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করা এবং তার উপর আমল করা। নিজেকে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বিরত রাখা’ (শারহুন নববী আলা মুসলিম, ২/৩৩ পৃ.)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হিকমাহ’ বলতে বুঝায় এমন প্রত্যেক জিনিস যা মানুষকে জাহিলিয়্যাত ও অন্ধকার থেকে বিরত রাখে এবং অবৈধ ও হারাম বস্তু থেকে দূরে রাখে’ (শারহুন নববী আলা মুসলিম, ৬/৯৮ পৃ.)।
কেননা ভাল-মন্দ পড়তে তো সবাই পারে, কিন্তু ওর ব্যাখ্যা ও অনুধাবন-ই হচ্ছে ঐ ‘হিকমাহ’, যা মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দান করে থাকেন। আর যাকে এই ‘হিকমাহ’ দান করা হয় সে প্রকৃত ভাবার্থ জানতে পারে এবং কথার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। তার মুখে সঠিক ভাবার্থ উচ্চারিত হয়। মারফু হাদীছেও রয়েছে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘হিকমাতের মূল হচ্ছে আল্লাহর ভয়। পৃথিবীতে এইরূপ বহু লোক রয়েছে যারা ইহলৌকিক বিদ্যায় বড়ই পারদর্শী। দুনিয়ার বিষয়সমূহে তারা পূর্ণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু তারা ধর্ম বিষয়ে একেবারেই অন্ধ। আবার পৃথিবীতে বহু লোক এমনও রয়েছেন যারা ইহলৌকিক বিদ্যায় দুর্বল বটে, কিন্তু শরী‘আতের বিদ্যায় তারা বড়ই পারদর্শী। সুতরাং এটাই ঐ হিকমাত যা আল্লাহ তা‘আলা এঁদেরকে দিয়েছেন এবং ওদেরকে বঞ্চিত রেখেছেন। সুদ্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, এখানে হিকমতের ভাবার্থ হচ্ছে ‘নবুওয়াত’। আবূ ইসমাইল আল-হারাবিয়্যু বলেন, হিকমাতের আসল অর্থ প্রত্যেক বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করা (মানাযিলুস সায়িরীন, পৃ. ৭৮)।
যেহেতু হিকমাতের আসল অর্থ প্রত্যেক বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করা। এর পূর্ণত্ব শুধু নবুওয়াতের মাধ্যমেই সাধিত হতে পারে। তাই এখানে হিকমাত বলতে নবুওয়াতকে বোঝানো হয়েছে। কুরআনুল কারীমের অসংখ্য জায়গায় শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। কোথাও এর অর্থ নেয়া হয়েছে কুরআন, কোথাও হাদীছ, কোথাও বিশুদ্ধ জ্ঞান, কোথাও সৎকর্ম, কোথাও সত্যকথা, কোথাও সুস্থ বুদ্ধি, কোথাও দ্বীনের বোধ, কোথাও মতামতের নির্ভুলতা এবং কোথাও আল্লাহর ভয়। কেউ বলেছেন সঠিক মত বা সিদ্ধান্ত, কুরআনের ‘নাসিখ ও মানসুখ’-এর জ্ঞান এবং বিচার শক্তি। আবার কারো নিকট ‘হিকমাত’ হল শুধু সুন্নাতের জ্ঞান অথবা কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান। কিন্তু অধিক গ্রহণযোগ্য কথা হল উপরিউক্ত সব অর্থই ‘হিকমাত’-এর আওতাভুক্ত। ‘হিকমাহ’ শব্দটির মধ্যে এই সবগুলোই মিলিত রয়েছে (আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ১/২৮৮; লিসানুল আরব, ১২/১৪৩; মিছবাহুল মুনীর, ১/১৪৫; আল-ক্বামুসুল মুহীত্ব, পৃ. ১৪১৫; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ১/১৯; তাফসীরে ইবনে কাছীর, বাহরে মুহীত্ব, সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৬৯; আখলাকুল কুরআন, ৩/৮৮ পৃ.)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, শুধু দুই ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা করা বৈধ। (১) সেই ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন এবং বৈধ পন্থায় অকাতরে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন, অর্থাৎ সে তা সৎপথে ব্যয় করে। (২) সেই ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ তা‘আলা হিকমাহ বা প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং সে তার মাধ্যমে বিচার ফায়সালা করে ও তা অন্যকেও শিক্ষা দেয়’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭৩, ১৪০৯,৭১৪১,৭৩১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৮১৬)।
দ্বিতীয়তঃ অর্জন করতে পারা ও না পারার ভিত্তিতে ‘হিকমাহ’ দুইভাগে বিভক্ত। যথা: (১) حِكمةٌ فِطريَّةٌ বা স্বভাবজাত হিকমাহ: আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে অধিকহারে দান করেন এবং এ বিষয়ে বান্দার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (আলাইহিস সালাম)-কে চিঠি লেখার সময় হিকমাতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, إنَّ الحِكمةَ ليست عن كِبَرِ السِّنِّ، ولكِنَّه عطاءُ اللهِ يعطيه من يشاءُ، فإيَّاك ودناءةَ الأمورِ، ومَراقَّ الأخلاقِ ‘নিশ্চয় প্রজ্ঞা বার্ধক্যের কারণে আসে না, এটি আল্লাহর দান তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে তা দান করেন। তাই নিকৃষ্ট কাজ এবং কপট নৈতিকতা থেকে সাবধান থাকুন’ (আল-ইশরাফ ফী মানাযিলিল আশরাফ, পৃ. ২১২)। (২) حِكمةٌ مُكتَسَبةٌ বা উপার্জিত হিকমাহ: বান্দা হিকমাহ উপার্জনের মাধ্যমসমূহের উপর প্রচেষ্টা করে এবং এর প্রতিবন্ধকতা সমূহ ত্যাগ করার মাধ্যমে এটি অর্জন করতে পারে। তখন তার জন্য এটি অর্জন করা সহজতর হবে, যখন সে দ্বীন ইসলামের একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করবে, কথা অনুযায়ী কাজ করবে, নিজের কাজগুলোকে পরিমার্জিত করবে, তার চলাফেরা, ধৈর্যশীলতা এবং গভীর স্থিরতা দেখে লোকেরা তার প্রজ্ঞার সাক্ষ্য দেবে’ (মাদারিজুস সালিকীন, ২/৪৭৮ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : আব্দুর রহমান, দিনাজপুর।