উত্তর : বিচারব্যবস্থা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে। এটা শরী‘আতের নির্দেশ। এই বিধানকে উপেক্ষা করে মানবরচিত আইন প্রতিষ্ঠিত করা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত (উছাইমীন, লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ৬/৩৩ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১১২১৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰہِ ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاہُ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
‘বিধান দেয়ার অধিকার শুধু আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া আর কারোও ইবাদত করবে না। এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ সম্পর্কে অবগত নয় (সূরা ইউসুফ: ৪০)। তিনি অন্যত্র বলেন, اَفَحُکۡمَ الۡجَاہِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ ؕ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ‘তবে কি তারা প্রাগ-ইসলামী বা জাহিলিয়্যাত যুগের বিচার-ব্যবস্থা পেতে চায়? খাঁটি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিচারে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর?’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৫০)। অন্য আয়াতে বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ‘আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফির’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৪৪)।
সুতরাং যে সমস্ত শাসক সজ্ঞানে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধানকে অপেক্ষা করে নিজের পক্ষ থেকে মনগড়া বিধান তৈরি করে দেশ পরিচালনা করছে, তারা কাফির, তাদের বিপক্ষে জিহাদ করা আবশ্যক (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনি উছাইমীন, ২/১১৮ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৮৪৫৩)।
তবে জিহাদ ফরয হওয়ার জন্য ইসলাম কয়েকটি শর্ত আরোপ করেছে। এখানে প্রধান দু’টি শর্ত হল : (১) মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন : আল্লাহর কালিমাহ সুউচ্চ করার জন্য এবং দ্বীনের সাহায্যার্থে জিহাদের অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি মুসলিম শাসকের ইচ্ছাধীন ও গবেষণাধীন। তাঁর আদেশের আনুগত্য করা যরূরী (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৮/৩৯০-৩৯১; আল-মুগনী, ১০/৩৬৮; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৮/২২; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১২/১২ পৃ.)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, ‘ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধ করা ও তাঁর মাধ্যমে নিরাপত্তা লাভ করা’ নামে (অধ্যায় নং-৫৬, অনুচ্ছেদ নং-১০৯)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, وَإِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ ‘ইমাম তো ঢাল স্বরূপ। তাঁরই নেতৃত্বে যুদ্ধ করা হয় এবং তাঁরই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়’ (ছহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪১)।
(২) পর্যাপ্ত পরিমাণ সামরিক বাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিদ্যমান থাকা: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, শায়খ ইবনু বায ও শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি, সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করা ব্যতীত জিহাদ করা জায়েয নয়। এতটা শক্তিশালী হতে হবে, যার দ্বারা বাতিল শাসককে পরাস্ত করার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে। একাকী কিংবা কিছু লোক মিলে ঝাঁপিয়ে পড়া মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। এভাবে তারা নিজেকে এবং পুরো দেশকে তথা মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। সেই জন্য কোন একজনের নেতৃত্বে সকলের একত্রিত হওয়া অপরিহার্য। মক্কার কাফির ও মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ছাহাবীরা সর্বদা রাসূল (ﷺ)-এর কাছে অনুমতি চেয়েছেন কাফিরদের সহিংস আচরণকে প্রতিরোধ করতে বা তাদের বর্বরতার প্রতিবাদে অস্ত্র তুলে নিতে। কিন্তু কখনোই তিনি অনুমতি দেননি। এক পর্যায়ে দাওয়াত ও তাবলীগের ভিত্তিতে মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামী জীবনব্যবস্থা মেনে নেন এবং রাসূল (ﷺ)-কে তাঁদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে গ্রহণ করেন। এভাবে দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মুশরিকরা এই নতুন রাষ্ট্রটিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চেষ্টা করে। তখন রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জিহাদের বিধান প্রদান করা হয় (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৮/৩৯০-৩৯১; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুশ শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে বায, ২৮/২৭০; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৮/২২ পৃ.)।
অনুরূপভাবে চুরি বা ব্যভিচারের মত ধ্বংসাত্মক পাপে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামী শরী‘আহ অনুযায়ী মুসলিম শাসকের নির্দেশে হদ্ ক্বায়িম করা বা হত্যা করা অপরিহার্য। কিন্তু ইসলামী শাসকের অনুমতি ব্যতীত কোন পাপের শাস্তি স্বরূপ কাউকে হত্যা করা বা কারোর হাত কাটা নিষিদ্ধ। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি সহ অন্য আলেমগণ বলেন, ‘হদ্ (মৃত্যুদণ্ড, সাজা, শাস্তি) প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি মুসলিম ইমাম, সুলতান, শাসক অথবা তার স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধির উপর নির্ভরশীল। সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তির বাতাবরণ অপ্রতিহত রাখার জন্য মুসলিম শাসক ও তাঁর প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কারোর জন্য ‘হদ্’ ক্বায়িম করা অনুমোদিত নয়। কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সমাজের জন্য হদ্ ক্বায়িম করা জায়েয নয়। কারণ এর ফলে যে, বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ, অস্থিরতা, অরাজকতা, নৈরাজ্য ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা সমাজের নেয় (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২২/৫-১০; কিতাবুল উম্ম, ৬/১৫৪; আল-কাফি ইবনে কুদামাহ, ৩/২৩৪; কুয়েতী ফিকহ বিশ্বকোষ, ৫/২৮০; তাফসীরে কুরতুবী, ২/২৫৬; আল-মুগনী, ৯/৮; মাজমূঊ রাসাইল ইবনে রজব, ২/৬০৮; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৯/৩০৩ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : শাহিনুর রহমান, সিরাজগঞ্জ।