উত্তর : কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি, না-কি আরশ সর্বপ্রথম সৃষ্টি এ ব্যাপারে আলেমগণ থেকে দু’টি কথা বর্ণিত হয়েছে। হাফেয আবুল আলা আল-হামাদানী এ মত দু’টি উল্লেখ করেছেন। এ মত দু’টির মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে কলমের পূর্বে আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ قَالَ وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ
‘আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত সৃষ্টির তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। তখন তার আরশ ছিল পানির উপর’’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩১৯১)। এখানে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আরশ সৃষ্টির পর তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আর কলম সৃষ্টি করার সময় তাক্বদীর লিখা হয়েছে। উবাদাহ ইবনু ছামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ দ্বারা এটি সাব্যস্ত।
নবী (ﷺ)-এর বাণী: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ ‘‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন...’। পুরো হাদীছ মিলে বাক্য মাত্র একটি হতে পারে আবার দু’টিও হতে পারে। বাক্য যদি একটি হয়, তাহলে অর্থ হবে আল্লাহ তা‘আলা কলম সৃষ্টি করে তাকে প্রথম আদেশ দিলেন, লিখো। এ হাদীছের শব্দ থেকে বুঝা যায়। নবী (ﷺ) বলেন, أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ এখানে اولَ শব্দের লাম বর্ণের উপর যবর এবং القلم শব্দের মীম বর্ণের উপর যবর দিয়ে পড়া থেকে বুঝা যায় বাক্য মাত্র একটি। আর যদি বাক্য দু’টি হয়, তাহলে এখানে اولَ শব্দের লাম বর্ণের উপর পেশ এবং القلم শব্দের মীম বর্ণের উপরও পেশ দিয়ে পড়তে হবে। এতে করে অর্থ হবে কলম প্রথম সৃষ্টি। এতে করে উবাদাহ ইবনে ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব হয়। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, তাক্বদীর সৃষ্টির আগেই আরশ ছিল। আর তাক্বদীর ও কলম একসাথেই সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, لما خلق الله القلم قال له: اكتب ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কলম সৃষ্টি করলেন, তখন কলমকে বললেন, লিখো’ (ত্বাবারাণী, মু‘আজুম কাবীর, হা/১২৫০০)। সুতরাং কলম হলো প্রথম কলম, সর্বোত্তম কলম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কলম। একাধিক মুফাসসির বলেন, এটি হলো সেই কলম, যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সূরা কলমের শুরুতেই শপথ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, نٓ وَ الۡقَلَمِ وَ مَا یَسۡطُرُوۡنَ ‘নূন, শপথ কলমের এবং লেখকরা যা লিখে চলেছে তার’ (সূরা আল-কলম: ১)।
দ্বিতীয় কলম হলো, অহী লিখার কলম। এর মাধ্যমে নবী-রাসূলদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর অহী লিখা হয়। এ কলমের ধারকরাই সৃষ্টিজগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দুনিয়ার সমস্ত কলম তাদের কলমের সেবক। মি‘রাজের রাতে নবী (ﷺ)-কে এত উপরে উঠানো হয়েছিল যে, তিনি কলম দিয়ে অহী লিখার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। এ কলমগুলো দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার ঐসব অহী লিখা হয়, যার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টিজগতের সবকিছু পরিচালনা করেন। ঊর্ধ্বজগৎ ও নিম্নজগতের যাবতীয় বিষয়ের অহী এ কলমগুলো দিয়েই লিখা হয়।
পরবর্তীদের মধ্যে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা নিম্নের ছহীহ হাদীছগুলো দিয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন। রাসূল (ﷺ) বলেন, إن أول شيء خلقه الله تعالى القلم وأمره أن يكتب كل شيء يكون ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম যে জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। অতঃপর কলমকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন’ (আবূ ইয়ালা, ১/১২৬; আল-আসমা ওয়াছ ছিফাত লিল-বায়হাকী, হা/২৭১; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৩)। তিনি আরো বলেন,
إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيْرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ
‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেন, লিখো। কলম বলল, হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ বললেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী প্রতিটি বস্তুর তাকদীর লিখো’ (আবূ দাঊদ, হা/৪৭০০, সনদ ছহীহ)। মালেকী মাযহাবের বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, قبل القلم لم يكن شيء إلا هو سبحانه ‘কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না’ (আরেযাতুল আহওয়াযী)। অপরপক্ষে আরেক দল আলেমের মতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর আরশ। আল্লামা ইবনু তাইমিয়া এবং অন্যান্য আলেম থেকে এই মত পাওয়া যায়। তাদের দলীল হচ্ছে, ইমরান ইবনু হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে নাবী (ﷺ) বলেন,
كَانَ اللهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ، وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ
‘আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিস লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩১৯১)। উপরের হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেছেন। এটিই সর্বাধিক শক্তিশালী মত। কারণ এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট হাদীছ হলো, আবূ রাযীন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলাম,
أَيْنَ كَانَ رَبُّنَا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ خَلْقَهُ قَالَ كَانَ فِيْ عَمَاءٍ مَا تَحْتَهُ هَوَاءٌ وَمَا فَوْقَهُ هَوَاءٌ وَخلق عرشهُ عَلَى الْمَاءِ
‘সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করার পূর্বে আমাদের রব কোথায় ছিলেন? তিনি বললেন, বাদলের উপর ছিলেন। যার উপর-নিচে কোন বায়ু ছিল না। অতঃপর তিনি পানির উপর আরশ সৃষ্টি করেছেন’। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ثم خلق عرشه على الماء ‘অতঃপর তিনি তার আরশকে পানির উপর সৃষ্টি করেছেন’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২৩৩)। এই হাদীছকে ইমাম ত্বাবারী, তিরমিযী, ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুমুল্লাহ) ছহীহ বলেছেন।
প্রশ্নকারী : মুহাম্মাদ খান, চাঁদপুর।