বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৫ অপরাহ্ন

টেস্ট টিউব বেবি : একটি পর্যালোচনা

-হাসিবুর রহমান বুখারী*


[বহু চর্চিত টেস্ট টিউব বেবি (ঃবংঃ-ঃঁনব নধনু) সম্পর্কে একটি তত্ত্বানুসন্ধানধর্মী ও গবেষণামূলক বিশ্লেষণ সময়ের দাবী। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘টেস্ট টিউব বেবি’ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে নির্ভুল ও সঠিক তথ্য-উপাত্তের পরিমাণও একবারে শূন্যের কোঠায়। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে এ সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আতের দিকনির্দেশনা উল্লেখপূর্বক একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা ‘মাসিক আল-ইখলাছ’-এর পাঠক সমীপে উপস্থাপিত হল-সম্পাদক]

পরিচয়

সন্তান জন্মদানে অক্ষম স্বামীর দেহ থেকে শুক্রাণু ও স্ত্রীর দেহ থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কৃত্রিম পরিবেশে কাঁচের নলের মধ্যে বা টেস্ট টিউবের ভিতরে নিষিক্ত (ঋবৎঃরষরুবফ) করে পুনরায় স্ত্রীদেহের জরায়ুতে স্থাপন করার পর স্বাভাবিক নিয়মে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাকে টেস্ট টিউব বেবি বা নলজাতক শিশু বলে। প্রকৃতপক্ষে টেস্ট টিউব বেবি ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (ওঠঋ)-এর সহজ ও সর্বজনবোধ্য সংক্ষিপ্ত রূপ। ‘ইন-ভিট্রো’ শব্দটি লাতিন ভাষা থেকে এসেছে। ‘ইন-ভিট্রো’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ইন=ভেতরে+ভিট্রো=কাঁচ নল। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অর্থ হল, ‘কাঁচের নলের ভেতর’। যেহেতু কাঁচের টেস্টটিউবের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক ঘটানো হয়, সেহেতু একে সহজভাবে টেস্টটিউব পদ্ধতি বলে।

মূলত নারীর ডিম্বাণু বা পুরুষের শুক্রাণু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে টেস্টটিউব বেবিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়া হয়। অনেক পুরুষের শুক্রাণুর চলার গতি কম হওয়ার কারণে এগুলো স্ত্রীর ডিম্বনালিতে নিষেকের জন্য পৌঁছাতে পারে না অথবা অনেক নারীর ডিম্বনালিতে প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে শুক্রাণু নিষিক্ত করার জন্য ডিম্বানুর কাছে পৌঁছাতে পারে না ফলে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না। কিংবা জরায়ুতে ফাইব্রয়েড জাতীয় টিউমার বা এন্ডোমেট্রোয়েসিস জাতীয় রোগ থাকলে কিংবা ডিম্বাশয় বা ওভারিতে সিস্ট বা ওভারিয়ান ফেইলিউর হলে টেস্ট টিউবপ্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়।

পদ্ধতি

প্রথমে ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে স্ত্রীর তলপেটে ছোট্ট ছিদ্র করে সূক্ষ্ম মাইক্রোইনজেকশন দ্বারা ওভাম বা ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর সংগৃহীত ডিম্বাণু ইনকিউবেটরে স্ত্রীদেহের মত উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। এ সময় ডিম্বাণুর জন্য কৃত্রিম পুষ্টি পদার্থের ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর জীবাণুমুক্ত একটি পাত্রে স্বামীর শুক্রাণু বা স্পার্ম সংগ্রহ করা হয়। শুক্রাণুর কোন ত্রুটি থাকলে তা দূর করা হয়। গবেষণাগারে শুক্রাণুকে বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। সংগৃহীত শুক্রাণুকে উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয় যাতে এদের মৃত্যু না ঘটে। অতঃপর সংগৃহীত ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণুকে একটি টেস্টটিউব বা অন্য কোন সুবিধামতো মাধ্যমে (সবফরধ) নিয়ে ইনকিউবিটারে ২৪-৪৮ ঘণ্টা রেখে দেয়া হয়। এ অবস্থায় ইনভিট্রোতে নিষেক ঘটতে থাকে এবং ক্লিভেজ চলতে থাকে এবং নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রাথমিক ভ্রƒণে পরিণত হতে থাকে। শুক্রাণুর নিষিক্তকরণ এবং চলার ক্ষমতা কম থাকলে তখন ওহঃৎধপুঃড়ঢ়ষধংসরপ ংঢ়বৎস রহলবপঃরড়হ (ওঈঝও) পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়। এপ্রক্রিয়ায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে শুক্রাণুর নিউক্লিয়াস প্রবেশ করানো হয়। বয়স্ক বা বেশ কয়েকবার বিফল হওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে অংংরংঃবফ যধঃপযরহম-এর সাহায্য নেয়া হয়। অতঃপর ৪৮ ঘণ্টা পর স্ত্রীর বয়সের অনুপাতে ৪-৮ কোষবিশিষ্ট ২-৩টি সর্বোত্তম ভ্রƒণ স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। একটি ক্যাথেটারের মাধ্যমে যোনিপথের ভিতর দিয়ে জরায়ুতে ভ্রƒণ স্থানান্তর করা হয়। এটি খুবই সহজ ও ব্যথামুক্ত একটি পদ্ধতি। একটু সিডেটিভ প্রয়োগ করলেই চলে, স্ত্রীকে অচেতন করার প্রয়োজন  পড়ে না। ভ্রƒণ জরায়ুর ভিতরের প্রাচীরে বা এন্ডোমেট্রিয়ামে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয় একে ইমপ্লান্টেশন বলে।

ইমপ্লান্টেশন-এর পরে ৯-১২ সপ্তাহের মধ্যে প্লাসেন্টা বা অমরা সৃষ্টি হয়। ভ্রƒণ অমরার মাধ্যমে খাদ্যগ্রহণ শুরু করে। এরপর সময়ের সাথে সাথে ভ্রƒণ একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হতে থাকে। জরায়ুতে ভ্রƒণ ভালোভাবে বেড়ে উঠার জন্য প্রজেস্টেরণ, ইস্ট্রোজেন, যঈএ হরমোনের কৃত্রিম ডোজপ্রয়োগ করা হয়।

শারঈ বিধান

শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, গর্ভোৎপাদন ও পরাগায়নের এই পদ্ধতিতে স্বামীর শুক্রাণু এবং স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মহিলার ডিম্বাণু অথবা স্ত্রীর ডিম্বাণু এবং স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের শুক্রাণু গ্রহণ করে কোন স্ত্রীর মাতৃগর্ভে স্থাপন করা শরী‘আতসম্মত নয়। অসংখ্য আলেম এই পদ্ধতিকে হারাম বলেছেন। ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র অধীনস্থ ‘ইসলামী ফিক্বাহ্ একাডেমী পরিষদ’ এবং ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগে’র অধীনস্থ ‘ইসলামী ফিক্বাহ্ বোর্ড’ দ্বারা এ সম্পর্কে কিছু সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাঁরা এই পদ্ধতিটিকে জায়েয বলে অভিমত দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাঁরাও তাঁদের মতামত থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। নি¤েœ কিছু অধিবেশন ও তার গৃহীত সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হল,

পবিত্র মক্কা নগরীতে ২৮ রাবিউল আখির ১৪০৫ হিজরী শনিবার থেকে ৭ জুমাদাল উলা ১৪০৫ হিজরী সোমবার পর্যন্ত মোতাবেক ১৯-২৮ জানুয়ারী ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘টেস্ট টিউব বেবি’ সম্পর্কে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগে’র অধীনস্থ ‘ইসলামী ফিক্বাহ্ একাডেমী’র অষ্টম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অনুরূপভাবে ৮-১৩ ছফর ১৪০৭ হিজরী মোতাবেক ১১-১৬ অক্টোবর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ‘টেস্ট টিউব বেবি’ সম্পর্কে ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র অধীনস্থ ‘ইসলামী ফিক্বাহ্ একাডেমী পরিষদে’র পরিচালনায় একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে কৃত্রিমপ্রজনন বা টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে দীর্ঘ অধ্যয়ন, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর উলামা পরিষদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘বর্তমান সময়ে কৃত্রিম প্রজননের সাতটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যার মধ্যে পাঁচটি নাজায়েয এবং দু’টি জায়েয। যথা :

(১) স্বামীর শুক্রাণুর সাথে স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন নারী থেকে সংগৃহীত ডিম্বাণুর পরাগায়ন বা নিষিক্ত (ঋবৎঃরষরুবফ) করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্বীয় স্ত্রীদেহের জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।

(২) স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ থেকে সংগৃহীত শুক্রাণুর সাথে স্ত্রীর ডিম্বাণুর পরাগায়ন বা নিষিক্ত করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্বীয় স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়।

(৩) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গ্রহণ করে বাহ্যিক পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণ করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্ত্রী ব্যতীত অন্য একজন মহিলার গর্ভে রোপণ করা হয়, যিনি স্বেচ্ছায় অর্থের বিনিময়ে গর্ভধারণের কাজ করে থাকেন।

(৪) স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত অন্য দু’জন বহিরাগত নারী-পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু গ্রহণ করে বাহ্যিক নিষিক্তকরণ করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্বীয় স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়।

(৫) স্বামী শুক্রাণু এবং প্রথম স্ত্রীর ডিম্বাণু গ্রহণ করে বাহ্যিক পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণ করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়।

(৬) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গ্রহণ করে বাহ্যিক পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণ করার পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্বীয় স্ত্রীর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়।

(৭) স্বামীর শুক্রাণু গ্রহণ করার পর অভ্যন্তরীণ পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণ করার জন্য স্বীয় স্ত্রীর যোনিনালীর উপযুক্ত জায়গায় অথবা জরায়ুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়।

সিদ্ধান্ত : শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রথমোক্ত পাঁচটি পদ্ধতিই হারাম ও নিষিদ্ধ। কেননা এর ফলে বংশের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটবে, মাতৃত্বের অনাবিল টান হারিয়ে যাবে এবং এছাড়াও অন্যান্য শারঈ সমস্যা রয়েছে। পক্ষান্তরে ষষ্ঠ ও সপ্তম পদ্ধতি সম্পর্কে উলামা পরিষদ বিবেচনা করে বলেন, ‘প্রয়োজনে চিকিৎসাস্বরূপ এ দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করাতে কোন দোষ নেয়। সেই সাথে সমস্ত প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের প্রতিও বিশেষ জোর দিয়েছেন।[১]

শায়খ মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) আরো বলেন, ‘গর্ভোৎপাদন বা পরাগায়নের এই পদ্ধতিতে যদি স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত কোন অপরিচিত মানুষের উপাদান প্রবেশ করে, যেমন স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ থেকে যদি শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয় কিংবা স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মহিলা থেকে যদি ডিম্বাণু গ্রহণ করা হয়, সেক্ষেত্রে এটি হারাম হিসাবে বিবেচিত হবে। কেননা এটি ব্যভিচারের সমতুল্য। কোন স্ত্রী যদি স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের শুক্রাণু নিজের মাতৃগর্ভে প্রবেশ করান, তবে সেটা ব্যভিচার হিসাবে পরিগণিত হবে এবং উক্ত শুক্রাণু থেকে ভূমিষ্ট সন্তান (وَلَدُ الزِّنَا) ব্যভিচারের সন্তান হিসাবে গণ্য হবে। যেমন আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, الْوَلَدُ لِلْفِرَاشِ وَلِلْعَاهِرِ الْحَجَرُ ‘বিছানা যার সন্তান তার আর ব্যভিচারিণীর জন্য রয়েছে পাথরের শাস্তি’।[২]

শায়খ উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিশেষ প্রয়োজনে তিনটি শর্তসাপেক্ষে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা দোষনীয় নয়। যথা :

(১) এই পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণ শুধু স্বামীর শুক্রাণু দ্বারাই সংঘটিত হতে হবে। আর স্বামী ব্যতীত অন্য কারোর শুক্রাণু দ্বারা এই নিষেক সংঘটিত হওয়া জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন

وَ اللّٰہُ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا وَّ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنۡ اَزۡوَاجِکُمۡ بَنِیۡنَ وَ حَفَدَۃً  وَّ رَزَقَکُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ ؕ اَفَبِالۡبَاطِلِ  یُؤۡمِنُوۡنَ وَ بِنِعۡمَتِ اللّٰہِ ہُمۡ یَکۡفُرُوۡنَ .

‘আর আল্লাহ‌ তোমাদের থেকেই তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের যুগল (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী) থেকে তোমাদের জন্য পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি তারা বাতিলের স্বীকৃতি দেবে, আর তারা আল্লাহ‌র অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’ (সূরা আন-নাহ্ল : ৭২)। এখানে আল্লাহ তা‘আলা সন্তানের জন্য স্বামী-স্ত্রীকে নির্ধারিত করেছেন।

(২) শুক্রাণু নিষ্কাশনের কাজটি বৈধ পন্থায় হতে হবে। যেমন স্ত্রীকে উপভোগ করার মাধ্যমে, স্ত্রীর উরু উপভোগ করার মাধ্যমে অথবা স্ত্রীর হাতের মাধ্যমে। অতঃপর তা ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত বা পরাগায়ন করবে। নিষ্কাশনের কাজটি যেন হস্তমৈথুনের দ্বারা না হয়। কেননা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে স্বমেহন বা হস্তমৈথুন করা হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ।... আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংরক্ষিত রাখে। তবে নিজেদের স্ত্রী বা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতঃপর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে, তারাই হবে সীমালংঘনকারী’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১-৭)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উক্ত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় গ্রন্থ ‘কিতাবুল উম্ম’-এর মধ্যে বলেছেন, ‘অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, স্বমেহন করা হারাম। কোন মুসলিম নিজের বিবাহিতা স্ত্রী এবং অধিকারভুক্ত দাসী ছাড়া অন্য কারো বা কিছুর মাধ্যমে কাম-তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না’।

(৩) পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণের পর উক্ত পরাগায়িত পদার্থটি স্বীয় স্ত্রীর জরায়ুতেই রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই স্ত্রী ব্যতীত অন্য কারোর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা যাবে না। কেননা পরপুরুষের বীর্য কোন স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করানোটা ব্যভিচারের সমতুল্য। এজন্য এটি হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

نِسَآؤُکُمۡ حَرۡثٌ لَّکُمۡ  ۪ فَاۡتُوۡا حَرۡثَکُمۡ اَنّٰی شِئۡتُمۡ ۫ وَ قَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّکُمۡ  مُّلٰقُوۡہُ  ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ.

‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার। আর তোমরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু কর এবং আল্লাহ‌কে ভয় করা এবং জেনে রেখো, তোমরা অবশ্যই আল্লাহ‌র সম্মুখীন হবে। আর মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২২৩)। এখানে শস্যক্ষেত্রকে স্বামীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। স্বামী ব্যতীত অন্য কারোর জন্য তা হালাল নয়।[৩]

শায়খ আল্লামা ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) ‘টেস্ট টিউব বেবি’ সম্পর্কে বলেন, ‘এ সম্পর্কে পবিত্র মক্কা নগরীতে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিক্বহী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে বৈধতা ও অবৈধতার নিরিখে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। দু’টি অবস্থার মধ্যে উলামা পরিষদ একটি পদ্ধতিকে জায়েয বলেছেন আর অপর পদ্ধতিকে সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েয বলেছেন। যেমন,

বৈধ অবস্থা

উলামা পরিষদ যে পদ্ধতিটিকে জায়েয বলেছেন, সেটি হল- ‘যে সমস্ত মহিলার ডিম্বাশয়ে বা জরায়ুতে অথবা বীর্য সরবরাহকারী নালীগুলোতে রোগের কারণে অথবা পুরুষের শুক্রাণুতে সমস্যা থাকার কারণে গর্ভবতী হতে পারছেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা কিন্তু বন্ধ্যা নয়। এখানে এমন কিছু কারণ রয়েছে যা চিকিৎসকরা জানেন, সেটি পুরুষের মধ্যে হোক কিংবা নারীর মধ্যে। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ অনুধাবন করতে পারছেন যে, যদি স্বামীর কাছ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করে ইনজেকশন দ্বারা স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করানো হয়, তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহে গর্ভোৎপাদন হতে পারে এবং যদি এটি বিশেষ পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সংঘটিত হয়, যেখানে মহিলা ডাক্তার অথবা নির্দিষ্ট পুরুষ ডাক্তার ব্যতীত অন্য কেউ উপস্থিত থাকবে না, সম্ভবপর হলে মহিলা ডাক্তারই নিযুক্ত করা অপরিহার্য। স্বামী স্ত্রীর দ্বারা নিজেই নিজের শুক্রাণু সংগ্রহ করে ঐ মহিলা ডাক্তারকে দিয়ে দেবেন যিনি স্ত্রীর গর্ভাশয়ে তা ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করবেন। তবে অভিজ্ঞ মহিলা ডাক্তার নিযুক্ত করা সম্ভবপর না হলে, সেক্ষেত্রে পুরুষ ডাক্তারও নিযুক্ত করা জায়েয।

সুধী পাঠক! উলামা পরিষদের সর্বসম্মতিক্রমে এই পদ্ধতি জায়েয। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সেখানে যেন স্বামী, স্ত্রী, নির্দিষ্ট মহিলা ডাক্তার অথবা নির্দিষ্ট পুরুষ ডাক্তার ব্যতীত অন্য কেউ উপস্থিত না থাকে। কেননা পরপুরুষের সামনে বিবস্ত্র হওয়া জায়েয নয়, এমনকি মাহারিমের সামনেও না। কেননা স্বামী ব্যতীত কোন মাহারিমের জন্যও লজ্জাস্থান বা বক্ষদেশ থেকে হাঁটুর উপরের অংশ দেখা জায়েয নয়। বিশেষ প্রয়োজনের তাকীদে শুধু মহিলা ডাক্তার অথবা নিরুপায়ে নির্দিষ্ট পুরুষ ডাক্তারের জন্য জায়েয করা হয়েছে।[৪] এই পদ্ধতিটি-ই জায়েয। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করতে হবে শুক্রাণু যেন অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর হয়। তবে আহলুল ইলম বা বুদ্ধিজীবীদের মতানুযায়ী এর থেকে বেঁচে থাকাটাই সর্বাধিক নিরাপদ হবে। কারণ শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্বামীর শুক্রাণু ও স্ত্রীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করার পর তা কৃত্রিম পরিবেশে কাঁচের নলের মধ্যে বা টেস্ট টিউবের ভিতরে নিষিক্ত (ঋবৎঃরষরুবফ) করার পর পুনরায় তা স্ত্রীদেহের জরায়ুতে স্থাপন করার বিষয়টি খুবই বিপদজনক এবং অত্যধিক জটিল। কেননা একটি ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগারে এক সঙ্গে একাধিক টিউব বা নল থাকে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় উদাসীনতার কারণে টিউব পরিবর্তন হয়ে একজনের শুক্রাণু অন্যজনের স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে যায়। সেজন্য এর থেকে বিরত থাকাটাই অধিক নিরাপদ। কেননা এর ফলে এক বংশের মধ্যে অন্য বংশের প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং বংশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা মোটেও শরী‘আতসম্মত নয়। যেমন নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, لَا تُوْطَأُ حَامِلٌ حَتَّى تَضَعَ ‘সন্তান প্রসব না করা পর্যন্ত গর্ভবতীর সাথে যৌনসঙ্গম করা যাবে না’।[৫] অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,

لَا يَحِلُّ لِامْرِئٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يَسْقِيَ مَاءَهُ زَرْعَ غَيْرِهِ يَعْنِيْ إِتْيَانَ الْحَبَالَى.

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে, তার জন্য অন্যের ফসলে নিজের পানি সিঞ্চন করা বৈধ নয়। অর্থাৎ গর্ভবতী মহিলার সাথে যৌনসঙ্গম করা বৈধ নয়’।[৬]

অবৈধ অবস্থা

স্ত্রীর গর্ভাশয়ে প্রবেশ করানোর জন্য স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের শুক্রাণু গ্রহণ করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। গর্ভোৎপাদন করার জন্য স্বামী ব্যতীত অন্য কোন অপরিচিত পুরুষের বীর্য গ্রহণ করার কারণে এটি ব্যভিচারের সমতুল্য। এটি নিষিদ্ধ এবং নাজায়েয। তাদের উভয়কে এর থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করা অপরিহার্য। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।[৭]

পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে এই দু‘আ করি যে, তিনি যেন এই বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত পদ্ধতির প্রয়োজন ছাড়াই প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীকে প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় পদ্ধতিতে সুসন্তান দান করেন এবং সকল রকমের পরীক্ষা ও বিপদ-আপদে তাদেরকে ধৈর্যধারণ করার তাওফীক্ব দান করেন।[৮]


* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

[১]. মাজাল্লাতুল মাজমা‘আ, ৩/১/৪২৪; ক্বারারাতুল মাজমায়িল ফিক্বহী, পৃ. ১৫৯-১৬১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩১০৪, ৩৪৭৪।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩০৩, ৬৭৫০, ৬৮১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫৮; তিরমিযী, হা/১১৫৭; নাসাঈ, হা/৩৪৮২, ৩৪৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/২০০৬; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২১৮৭১।

[৩]. মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল লিইবনে উছাইমীন, ১৭শ ক-, পৃ. ২৭-২৮; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৮৬০৪।

[৪]. মুগনীউল মুহতাজ, ৩য় খ-, পৃ. ১৩৩; মাজাল্লাতুল মাজমাআ‘, ১ম খ-, পৃ. ৪৯; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৯৩৮৭৭।

[৫]. আবূ দাঊদ, হা/২১৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১২২৮, ১১৫৯৬, ১১৮২৩, সনদ ছহীহ।

[৬]. আবূ দাঊদ, হা/২১৫৮; তিরমিযী, হা/১১৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৯৯০, সনদ ছহীহ; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ র্দাব লিইবনে বায, ২১শ খ-, পৃ. ৪৩২; মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনে উছাইমীন, ১৭ খ-ের ৯ নং প্রশ্ন; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৯৩৮৭৭।

[৭]. ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ্ র্দাব লিইবনি বায, ২১শ খ-, পৃ. ৪৩২।

[৮]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৮৬০৪।




প্রসঙ্গসমূহ »: ইসলাম ও বিজ্ঞান
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)!! - হাসিবুর রহমান বুখারী
টেস্ট টিউব বেবি : একটি পর্যালোচনা - হাসিবুর রহমান বুখারী
আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসনের উপায় - হাসিবুর রহমান বুখারী
আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসরেন উপায় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)!! (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ