আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসনের উপায়
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
অবতরণিকা
ইসলাম ধর্মের নামে নব্য আবিষ্কৃত দলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তিকর দলটির নাম হল, ‘আহলে কুরআন’। পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত ‘উম্মুল কুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শায়খ খাদিম হুসাইন ইলাহী বাখ্শ (হাফিযাহুল্লাহ) ‘উম্মুল কুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স (M.A) করার সময় ‘আহলে কুরআন’ সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে তিনি فِرْقَةُ أَهْلِ الْقُرْآنِ بِبَاكِسْتَانِ وَمَوْقِفُ اْلِإسْلَامِ مِنْهَا শীর্ষক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ (Thesis) রচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর প্রবন্ধকেই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি ‘আহলে কুরআনের উৎপত্তি’ নামক শিরোনামে বলেছেন,
‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে ১৭০০ শতকের শেষের দিক থেকেই হাদীছ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অন্তরে সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে ইসলাম ধর্মের নামে অত্যাধিক জঘন্য, বিপদগামী, আদর্শচ্যুত, দিশেহারা, ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক দু’টি দল উদ্ভাবিত ও অভ্যুদিত হয়েছে। যার একটির নাম ‘ক্বাদিয়ানী’, আর অপরটির নাম ‘আহলে কুরআন’। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম অভিশপ্ত গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানী নিজেকে নাবী বলে দাবী করার মাধ্যমে ‘ক্বাদিয়ানী’ সম্প্রদায় শিরোনামে আসে। আর ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে একই প্রদেশ থেকে হাদীছ অস্বীকারকারী ‘আব্দুল্লাহ চড়কলাবীর প্ররোচনায় ‘আহলে কুরআন’ নামক অপর একটি ভ্রান্ত দলের উৎপত্তি হয়। যে সাধারণ মানুষদের সুন্নাতকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে শুধু কুরআন মানার প্রতি আহ্বান করতে থাকে এবং সে ‘লাহোরের জিনিয়ান-ওয়ালী’ নামক একটি মাসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে। শুরুর দিকে মূলত দু’জন ব্যক্তি-ই এই ভ্রান্ত মতবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। একজন পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের ‘মুহিব্বুল হাক্ব আজীম আবাদী’, অপরজন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে পলায়নকারী ‘লাহোরের আব্দুল্লাহ চড়কলাবী’।[১]
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এরা দু’জনেই কিন্তু সাইয়্যিদ আহমাদ খাঁন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ‘ছাওতু আলীকারাহ বা আলীগড়ের ডাক’ নামক আন্দোলনের সময়কালে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্বীন মানার জন্য শুধু কুরআনকেই যথেষ্ট মনে করতে হবে এবং হাদীছকে শারঈ দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না’। এই আহ্বান ‘মুহিব্বুল হাক্ব আযীমাবাদী’ ও আব্দুল্লাহ চড়কলাবীকে’ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল’।[২] বর্তমানে ‘আহলে কুরআন’ নামক দলটি চারটি উপদলে বিভক্ত। যথা : (১) উম্মাতু মুসলিম আহলুয-যিকর ওয়াল কুরআন (২) উম্মাতুন মুসলিমাতুন (৩) তুলূঊ ইসলাম এবং (৪) তাহরীকু তা‘মীর ইসলাম’।[৩]
ইসলামের নামে যে সমস্ত মাযহাব, দল ও মতবাদের অভ্যুদয় ঘটেছে তাদের স্বধর্মভ্রষ্টতা, পদস্খলিতা ও অধঃপতনের বিষয়টি পরিস্ফুটিত করার সর্বাধিক সহজবোধ্য ও সহজলব্ধ উপায় হল তার উৎপত্তিকাল সম্পর্কে পরিজ্ঞাত বা তথ্যাভিজ্ঞ হওয়া। কেননা হাদীছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِيْ مَا أَتَى عَلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلَانِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ.
‘বানী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উম্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বানী ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সব দলগুলোই জাহান্নামী হবে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে দল কোন্টি? তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত’।[৪]
উপরিউক্ত হাদীছের আলোকে একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতীয়মান হয় যে, যারাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর ছাহাবীগণের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে, বিবিধ দলসমূহের মধ্য হতে শুধু তারাই প্রকৃত ইসলামের ও হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর তারাই সফলতা, সার্থকতা এবং পরিত্রাণ পাবে।
আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে আহলে কুরআনদের অবস্থান
প্রকৃতপক্ষে এদের ‘আহলে কুরআন’ না বলে ‘মুনকিরুল হাদীছ বা হাদীছ অস্বীকারকারী’ বলা উচিত। কেননা কুরআন মান্যকারীদের উপর হাদীছ মানা অপরিহার্য। বস্তুত আল-কুরআনের মধ্যেই হাদীছের প্রামাণিকতা বিদ্যমান। হাদীছের সত্যতা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেউ ‘আহলে কুরআন’ হতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا
‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)। তিনি আরো বলেন,
وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ
‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (সূরা আল-হাশর : ৭)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡہَوٰی - اِنۡ ہُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی
‘আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُ الۡہُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّہٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِہٖ جَہَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا
‘আর কারো নিকট সৎপথ প্রকাশিত হওয়ার পরও যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে তাকে আমি সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে সে ফিরে যেতে চায় এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কতই না মন্দ আবাস!’ (সূরা আন-নিসা : ১১৫)। তিনি আরো
قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৩১)।
সুধী পাঠক! হাদীছের প্রামাণিকতায় এ রকম আরো সহস্র আয়াত বিদ্যমান। অতএব বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আহলে কুরআন’ নামক দলটি কুরআন-সুন্নাহ্ ও শরী‘আতের দলীলাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নাম আহলে কুরআন হলেও কিন্তু আসলে তারা কুরআনের কিছুই বুঝে না। আর বুঝবেই বা কী করে! হাদীছ ছাড়া কি কুরআন বুঝা সম্ভব? এদের ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক পূর্বেই সতর্ক করে বলেছেন, ‘জেনে রাখ! আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে অনুরূপ কিছু দেয়া হয়েছে। জেনে রাখ! এমন এক সময় আসবে যখন কোন প্রাচুর্যবান ব্যক্তি তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এ কুরআনকেই আঁকড়ে ধর, তাতে যা হালাল পাবে তাকে হালাল হিসাবে এবং যা হারাম পাবে তাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। নবী (ﷺ) বলেন, জেনে রাখ! গৃহপালিত গাধা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং ছেদন দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র পশুও নয়’।[৫]
আহলে কুরআন বা হাদীছ অস্বীকারকারীদের বিধান
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত মতানুযায়ী আহলে কুরআন বা হাদীছ অস্বীকারকারীরা কাফির। নিম্নে কয়েকজন বিদ্বানের মতামত উল্লেখ করা হল :
(১) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছ অস্বীকারকারীদের ধ্বংস অনিবার্য’।[৬]
(২) ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাহ্ওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন একটি ছহীহ হাদীছ পৌঁছেছে, অতঃপর সে কোন ভয়ের আশঙ্কা ছাড়াই তাকে অস্বীকার করেছে, তবে সে নিশ্চিতরূপে কাফির’।[৭]
(৩) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য নয়, তারা কাফির, তাদের হত্যা করা অপরিহার্য’।[৮]
(৪) ইমাম সূয়ুত্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা নবী (ﷺ)-এর হাদীছকে অস্বীকার করে তারা কাফির এবং তারা ইসলামের গণ্ডি ও চৌহদ্দি থেকে নিষ্কাষিত হয়ে ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান অথবা অন্য কোন বিধর্মী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে’।[৯]
(৫) ইমাম ইবনু দাক্বীক্ব আল-ঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীছ প্রমাণিত হওয়ার পরেও যারা তা প্রত্যাখ্যান করে তারা স্পষ্ট কাফির’।[১০]
(৬) ইমাম ইবনু হায্ম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমরা শুধু কুরআনের বিধানই মানব, হাদীছ মানব না, তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির’।[১১]
(৭) শায়খ আবূ বাকর আল-আজুর্রী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলিমগণ বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মধ্যে যে সমস্ত বিধানকে ফরয করেছেন, তার পদ্ধতি ও নিয়ম-কানূন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ছাড়া উপলব্ধি করা অসম্ভব। আর যারা এর বিপরীত বলবে, অর্থাৎ যারা বলবে যে, সুন্নাত ছাড়াও ইসলাম মানা সম্ভব তারা কাফির। তারা ইসলামী দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নাস্তিকদের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে’।[১২]
(৮) শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যারা সুন্নাতকে অস্বীকার করে তারা কাফির ও স্বধর্মত্যাগী। কেননা সুন্নাতকে অস্বীকার করা কুরআনকে অস্বীকার করার নামান্তর। যে কিতাব ও সুন্নাতকে অথবা এর কোন একটিকে অস্বীকার করে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির। অবশ্যই তাকে এ সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা দরকার’।[১৩]
(৯) সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘যারা সুন্নাত অনুযায়ী আমাল করাকে অস্বীকার করে তারা কাফির’।[১৪]
উপরিউক্ত মতামতের পক্ষের দলীল বর্ণনায় নিম্নে দু’টি হাদীছ উল্লেখ করা হল : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি ঔদাসীন্য ও বিরাগ পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়’।[১৫] অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ أَطَاعَنِيْ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَى اللهَ ‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা‘আলারই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে আল্লাহ তা‘আলারই নাফরমানী করল’।[১৬]
আল-কুরআনুল কারীমকে আমরা যেমন আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করি, অনুরূপভাবে হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের আক্বীদা কেমন হতে হবে?
এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআনের মত হাদীছও অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, হাদীছকে কুরআনের মত তেলাওয়াত করা হয় না’।[১৭] খাত্বীব আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ), হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর আদেশে যেভাবে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) নবী (ﷺ)-এর নিকট কুরআন নিয়ে অবতরণ করতেন, ঠিক একই রকম ভাবে তাঁর উপর সুন্নাত নিয়েও অবতরণ করতেন’।[১৮] দলীলগুলো নিম্নরূপ :
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)।
২. আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযূ করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’।[১৯]
৩. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, أَلَا إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রাখ! আমাকে কুরআন এবং তার সঙ্গে সমকক্ষ বা সমতুল্য কিছু দেয়া হয়েছে’।[২০] ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য মুহাদ্দিছ বলেন, ‘সমতুল্য জিনিস’ বলতে হাদীছকেই বুঝানো হয়েছে।[২১]
৪. আবূ মাসঊদ আনছারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করে ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন। রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। আবার তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। পুনরায় তিনি ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূল (ﷺ)ও ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ‘আমি এভাবে ছালাত শিখাতে আদিষ্ট হয়েছি’।[২২] উক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সুন্নাত শিখানোর জন্যই অবতরণ করেছিলেন। অতএব বুঝা গেল যে, সুন্নাত বা হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।
৫. আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,مَا أُوْتِيْكُمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا أَمْنَعُكُمُوْهُ إِنْ أَنَا إِلَّا خَازِنٌ أَضَعُ حَيْثُ أُمِرْتُ ‘আমি আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস দিই না এবং আমার ইচ্ছা মত তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বঞ্চিতও করি না। আমি তো কেবল কোষাধ্যক্ষ বা বণ্টনকারী। আমাকে যেখানে ব্যয়ের নির্দেশ দেয়া হয় সেখানেই ব্যয় করি’।[২৩] উক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মুতাবিক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনরূপ কমবেশি ছাড়াই বণ্টন করতেন। অতএব প্রমাণিত হল যে, হাদীছও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।[২৪]
৬. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَنۡزَلَ اللّٰہُ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا
‘আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমাত অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না, তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১১৩)। অন্যত্র তিনি বলেছেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৬৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি কুরআনুল কারীমের অগণিত বিশেষজ্ঞের নিকটে শুনেছি, তাঁরা বলেছেন, ‘এখানে ‘কিতাব’ বলতে কুরআনুল কারীমকে বুঝানো হয়েছে আর ‘হিকমাত’ বলতে রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতকে বুঝানো হয়েছে’।[২৫]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২১।
[২]. প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২।
[৩]. প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৬৪।
[৪]. তিরমিযী, হা/২৬৪১; মিশকাত, তাহক্বীক্ব ছানী, হা/১৬৯, ১৭১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৪৮; ছহীহুল জামি‘, হা/৫৩৪৩।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৭৪, ১৭১৯৪, সনদ হাসান।
[৬]. শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল-জামা‘আতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৮।
[৭]. ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯, ফৎওয়া নং-১১৫১২৫।
[৮]. আল-ওয়াসিয়্যাতুল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়্যাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৫।
[৯]. মিফতাহুল জান্নাহ্ ফিল ইহতিজাজি বিস সুন্নাহ, পৃ. ১৪।
[১০]. শারহুল ইলমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৭-১৭৮।
[১১]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮০।
[১২]. আশ-শারী‘আহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১২।
[১৩]. মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩ ও ৯ম খণ্ড, পৃ. ১৭৬-১৭৮।
[১৪]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৪ ও ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৯-২০।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৫৩৪।
[১৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭, ৭১৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৫।
[১৭]. মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৩।
[১৮]. আল-কিফায়াহ, পৃ. ১২; ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ২৯১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৭৭২৪৩।
[১৯]. আবূ দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩০।
[২০]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৪-৪৬০৫; তিরমিযী, হা/২৬৬৩-২৬৬৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৭৪, ১৭১৯৪, সনদ হাসান।
[২১]. মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৪।
[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২১; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১০।
[২৩]. আবূ দাঊদ, হা/২৯৪৯, সনদ ছহীহ।
[২৪]. আল-মাদখাল ইলাস-সুন্নাতিল নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ৬১।
[২৫]. আহকামুল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮; আর-রিসালাহ, পৃ. ৪৫; তাফসীরে ত্বাবারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৫৭-৫৫৮।
প্রসঙ্গসমূহ »:
কুরআনুল কারীম