বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ অপরাহ্ন

আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসরেন উপায়

-হাসিবুর রহমান বুখারী*


(শেষ কিস্তি)

আহলে কুরআন বা হাদীছ অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন

আহলে কুরআন বা হাদীছ বিরোধীদের বিভ্রান্তিকর হাতিয়ারের নাম হল, অনৈতিক যুক্তি। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ মানুষকে আদর্শচ্যুত করার জন্য তাদের সামনে কিছু উদ্ভট প্রশ্ন ও নীতিহীন যুক্তি পেশ করে থাকে। নিম্নে তাদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার মোক্ষম জবাব উপস্থাপন করা হল :

প্রথম সংশয়

তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কিতাব-ই যথেষ্ট। কেননা কুরআনের মধ্যেই সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনকে বুঝার জন্য অথবা শরী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুন্নাত বা হাদীছের প্রয়োজন নেই।[১]

নিরসন

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনে মূলত শরী‘আতের মূল নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা বা বিধি-বিধানের নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি। যদি তাই হয় তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা, উট, গরু, ছাগল, স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের নিসাব বা পরিমাণ, ছিয়ামের বিধি-বিধান, হজ্জের নিয়ম-কানুন ইত্যাদি কোথায় বলা হয়েছে? যদি রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত না থাকত, তাহলে আমরা এগুলো কোথায় থেকে জানতে পারতাম। সেই জন্যই ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত-ই হল, আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের ব্যাখ্যাকারী’।[২] আল্লামা বাদরুদ্দীন আল-যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় রিসালাতের ‘রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য’ নামক অনুচ্ছেদে বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)। এমন প্রত্যেকটি বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে ফরয করেছেন যেমন : ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি। যদি রাসূল (ﷺ) এগুলোর নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত না করতেন, তাহলে আমরা সেগুলো কিভাবে আদায় বা পালন করতাম? তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত আমাদের পক্ষে কোন ইবাদতই করা সম্ভবপর হত না’।[৩]

‘ইসলাম ওয়েব’-এর আলিমগণ বলেন, ‘অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূল (ﷺ) ছিলেন কুরআনুল কারীমের উত্তম ব্যাখ্যাকারী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اَنۡزَلۡنَاۤ  اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ  لِتُبَیِّنَ  لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ  اِلَیۡہِمۡ وَ لَعَلَّہُمۡ  یَتَفَکَّرُوۡنَ

‘আর আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (সূরা আন-নাহল : ৪৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,

وَ مَاۤ  اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ اِلَّا لِتُبَیِّنَ لَہُمُ الَّذِی اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ ۙ وَ ہُدًی  وَّ  رَحۡمَۃً   لِّقَوۡمٍ  یُّؤۡمِنُوۡنَ

‘আমি তো আপনার প্রতি কিতাব এ জন্যই অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তাদেরকে আপনি তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া স্বরূপ’ (সূরা আন-নাহল : ৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর’ (সূরা আল-হাশর : ৭)।

আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩৮)। এখানে সাধারণভাবে চুরি করলেই চোরের হাত কাটার কথা বলা হয়েছে। জাহিরিয়্যাহ্ মাযহাবের ফকীহবিদদের মতানুযায়ী চুরির এই বিধান সকল প্রকার চুরির জন্য ব্যাপক, চুরির পরিমাণ অল্প হোক অথবা বেশি, সুরক্ষিত জায়গা থেকে চুরি করা হোক অথবা অরক্ষিত জায়গা থেকে, সর্বাবস্থাতেই চোরের হাত কাটা যাবে। অথচ বাণীসূচক হাদীছের মধ্যে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘এক চতুর্থাংশ স্বর্ণমুদ্রা (দীনার) বা ততোধিক চুরি করলে তবেই হাত কাটা যাবে’।[৪]

অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর কর্মসূচক হাদীছ এবং ছাহাবীদের আমল ও স্বীকারোক্তি থেকে তা আরো পরিস্ফুটিত হয়। এরকম শতসহ¯্র আয়াত আছে, যার বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত ছাড়া সম্ভব নয়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হল :

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুল্ম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)। ছাহাবীগণ এই আয়াতের ‘যুলম’ শব্দ দ্বারা সাধারণ ছোট-বড় অত্যাচার করা বুঝেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হলে ছাহাবীগণ চমকে উঠেন এবং ভীতিকর অবস্থায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুল্ম করেনি? এ আয়াতে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে যুল্মকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কী? রাসূল (ﷺ) উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে যুল্ম বলতে শিরকক বুঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘নিশ্চিত শিরক বিরাট যুলম’।[৫] কাজেই আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর ইবাদাতে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে না, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত।

(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে ছালাত ক্বছর (সংক্ষিপ্ত) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা আন-নিসা : ১০১)।

উপরিউক্ত আয়াত থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বছরের ছালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে জন্যই কিছু ছাহাবায়ে কিরাম রাসূল (ﷺ)-কে বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তা‘আলা যে বলেছেন, ‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তবে ছালাত ক্বছর (সংক্ষিপ্ত) করলে এতে তোমাদের কোন দোষ নেই’। আর মানুষ তো এখন নিরাপদে আছে? (অর্থাৎ তাহলে কি নিরাপদ স্থানে ক্বছর করা যাবে না?) জবাবে তিনি বলেন, তুমি যে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ, আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম। তাই আমিও এ বিষয়ে রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওটা তো একটি ছাদাক্বাহ্ বিশেষ, যা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর ছাদাক্বাহ্ গ্রহণ কর’।[৬]

(৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছের বিধান কী হবে? কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কী-না?! রাসূল (ﷺ)-এর বাণীসূচক হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সমস্ত প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া হালাল, আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হল, মাছ ও টিড্ডি, এবং দু’প্রকারের রক্ত হল, কলিজা ও প্লীহা’।[৭] এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করে না, এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও নবী (ﷺ)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা ভক্ষণ করছে।

(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতি যে অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আহারকারী যা আহার করে, তার মধ্যে আমি কিছুই নিষিদ্ধ পাই না। তবে মৃতপ্রাণী, বহমান রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত, কেননা তা অপবিত্র। অথবা যব্হকালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেয়ার কারণে যা অবৈধ’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪৫)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুকুরের বিধান কী হবে? সাপের বিধান কী হবে? ইঁদুরের বিধান কী হবে? শকুনের বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কি-না?!

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতের সুবিধার্থে উক্ত আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করেন। তিনি একটি উছূল বা মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) খায়বার যুদ্ধের দিন শিকারী দাঁতযুক্ত যে কোন হিং¯্র জন্তু এবং নখযুক্ত যে কোন শিকারী পাখী আহার করতে নিষেধ করেছেন।[৮]

দ্বিতীয় সংশয়

তারা মনে করে যে, হাদীছ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী নয়, বরং এগুলো তো কথা মাত্র যা আল্লাহর নামে মিথ্যা চালানো হচ্ছে (নাউযুবিল্লাহ)।[৯]

নিরসন

আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ) এবং সুন্নাতের স্থান স্পষ্ট করে বলেন,

وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ- لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ  بِالۡیَمِیۡنِ- ثُمَّ  لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ  الۡوَتِیۡنَ - فَمَا مِنۡکُمۡ  مِّنۡ اَحَدٍ عَنۡہُ حٰجِزِیۡنَ

‘যদি তিনি আমার নামে কিছু রচনা করে চালানোর চেষ্টা করতেন। তবে অবশ্যই আমি তাঁকে ডান হাত দ্বারা পাকড়াও করতাম এবং তাঁর জীবন-ধমনী কেটে দিতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাঁকে রক্ষা করতে পারত’ (সূরা আল-হাক্কাহ : ৪৪-৪৭)। উক্ত আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, যদি রাসূল (ﷺ) নিজের পক্ষ থেকে কিছু বানিয়ে বলার চেষ্টা করতেন অথবা এতে কম-বেশি করতেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পাকড়াও করতেন এবং তাঁকে ঢিল দিতেন না। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য রাসূল ছিলেন। যেহেতু তাঁকে আল্লাহ শাস্তি প্রদান করেননি তার মানে এই যে, তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বানিয়ে বলেননি।

পক্ষান্তরে হাদীছের প্রামাণিকতায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আন-নাজম : ৩-৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের মত সুন্নাতও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী।[১০]

সাইয়িদ রশীদ রেযা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছে বর্ণিত বিধানগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। অহী শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়’।[১১]

দলীল হল আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীছ। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযূ করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন’।[১২]

উপরিউক্ত বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে হাদীছের মধ্যে, অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রতিপালক এমনই করতে বলেছেন। তার মানে বুঝা যাচ্ছে হাদীছও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। তবে হ্যাঁ, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন,

ক. আল-কুরআন অহী মাতলু আর হাদীছ অহীয়ে গায়রে মাতলু।

খ. আল-কুরআন মু‘জিযাসমূহের মধ্যে একটি, কিন্তু হাদীছ তা নয়।

গ. আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত। পক্ষান্তরে হাদীছের অর্থ আল্লাহর কিন্তু শব্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর।

ঘ. আল-কুরআন ইসলামী শরী‘আতের প্রথম উৎস, আর ছহীহ হাদীছ ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস।

ঙ. আল-কুরআন ছালাতের মধ্যে তেলাওয়াত করা হয়, কিন্তু হাদীছ ছালাতে তেলাওয়াত করা হয় না।

চ. আল-কুরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ-দশ ছাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু হাদীছ পাঠে কোন নির্ধারিত ছাওয়াব পাওয়া যায় না।

ছ. আল-কুরআন তেলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা একটি প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু হাদীছ পাঠের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়।[১৩]

তৃতীয় সংশয়

এই নির্বোধেরা বলে থাকে যে, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানা যাবে না, কেননা এটি শিরক। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنِ الۡحُکۡمُ  اِلَّا لِلّٰہِ ‘হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ৫৭)। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা যাবে না।[১৪]

নিরসন

এ কথা ঠিক যে আদেশ কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মানতে হবে। কিন্তু সেই আল্লাহ তা‘আলাই তো রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন,

فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی  یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ  بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ  لَا  یَجِدُوۡا فِیۡۤ  اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا  مِّمَّا قَضَیۡتَ  وَ یُسَلِّمُوۡا  تَسۡلِیۡمًا

‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তার শপথ করে বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মেনে না নেয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না।

অতএব প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ মানাটাই হল আল্লাহর আদেশ মানা।[১৫] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন মুমিনদেরকে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ওরাই হল সফলকাম’ (সূরা আন-নূর : ৫১)। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান মানা যাবে না’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই বিধানের গ-ির বাইরে রাখা হয়েছে। বরং এটি রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে ইসলামী আইন প্রণয়নে এবং কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝার ক্ষেত্রে সুন্নাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সূর্যালোকের ন্যায় পরিস্ফুটিত হয়। যদি আমরা উপরিউক্ত উদাহরণগুলো এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্তকরণের উদ্দেশ্যে যেগুলোকে আমরা এখানে উল্লেখ করিনি সেগুলোকেও একটু গভীরভাবে বিবেচনা করি, তাহলেই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাব যে, সুন্নাতের সাহায্য ছাড়া কুরআনুল কারীমকে পূর্নাঙ্গরূপে বুঝার এবং তার উপর আমল করার কোন উপায় নেয়।[১৬] আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে সালাফে ছালিহীনের মানহাজ অনুযায়ী কুরআনুল কারীমকে বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!!

* মুর্শিদাবাদ, ভারত।

তথ্যসূত্র :
[১]. মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৪৯, ৩য় সংখ্যা, ১৯০২ খ্রি. ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৮৬, ১৯০২ খ্রি.; বুরহানুল ফুরক্বান, পৃ. ৪।
[২]. রিসালাতুশ শাফিঈ, ১ম খ-, পৃ. ৭৯; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৩১১১।
[৩]. আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৭-৮।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৮৯, ৬৭৯০, ৬৭৯১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৮৪, নাসাঈ, হা/৪৯৪৩।
[৫]. সূরা লুক্বমান : ১৩; ছহীহ বুখারী, হা/৩২, ৩৩৬০, ৩৪২৮, ৩৪২৯, ৪৬২৯, ৪৭৭৬, ৬৯১৮, ৬৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৪; তিরমিযী, হা/৩০৬৭।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬; তিরমিযী, হা/৩০৩৪; নাসাঈ, হা/১৪৩৩; আবূ দাউদ, হা/১১৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫, ২৪৬।
[৭]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; ছহীহুল জামি‘, হা/২১০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১১১৮।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৫২৭, ৫৫৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯৩২-১৯৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩২৩৪; নাসাঈ, হা/৪৩৪৮; আবূ দাঊদ, হা/৩৮০৩, ৩৮০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/ ২১৯৩, ২৭৪২, ৩০১৫, ৩০৬০, ৩১৩১, ৩৫৩৪; ইরওয়াউল গালীল, হা/২৪৮৮।
[৯]. আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৮১; ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৯১; মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৩৫; চতুর্থ সংখ্যা, ১৯০৩ খ্রি.।
[১০]. তাফসীরে কুরতুবী, ৭ম খ-, পৃ. ২৬৫৫।
[১১]. তাফসীরুল মানার, ৮ম খ-, পৃ. ৩০৮।
[১২]. আবূ দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খ-, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩০।
[১৩]. ক্বাওয়াঈদুত তাহদীছ, পৃ. ৬৪; উছূলুল হাদীছ, পৃ. ২৯; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৬৮৮০৫, ৭২৭৯৮; আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২১৫-২১৭।
[১৪]. আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৪২।
[১৫]. আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২২০।
[১৬]. মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৪-১২।




আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসরেন উপায় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)!! - হাসিবুর রহমান বুখারী
আহলে কুরআনদের বিভ্রান্তি ও তা নিরসনের উপায় - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)!! (৩য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
টেস্ট টিউব বেবি : একটি পর্যালোচনা - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ