ঐতিহাসিক চক্রান্তের শিকার বিখ্যাত সংস্কারক
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
(২য় কিস্তি)
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) -এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এই প্রথম নয়। তাঁর মৃত্যু হয় ১৭৯২ সালে, তখন থেকে আজ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। যুগে-যুগে কালে-কালে বহু আলিমে দ্বীন এই সমস্ত জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরেছেন। সংশয়ের নিরসন ও প্রতিবাদ স্বরূপ বিভিন্ন ভাষায় স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন।
মূলত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলা মানুষগুলোর এবং ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের এটিই চিরাচরিত অভ্যাস যে, যখন তারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল অথবা সালাফে ছালিহীনের উত্তম আদর্শ অথবা ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য তথ্য দ্বারা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় না, তখন তারা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের ঘৃণার্হ পথ বেছে নেয়। যেমন, মক্কার কাফির ও মুশরিকরা যখন নবী কারীম (ﷺ)-কে নীতিগত, বাস্তবিক ও আদর্শিক দিক দিয়ে মোকাবিলা করতে পারছিল না, তখন তারা ভিন্ন পথ খুঁজতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে ইসলামের উত্তাল তরঙ্গ কিভাবে স্তব্ধ করা যায়। সে লক্ষ্যে তারা বেছে নেয় গাল-মন্দ ও কুৎসা রটনা সহ বিভিন্ন অশালীন কথার দ্বারা তাঁর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপনের ঘৃণ্য পথ। তাদের বিশ্বাস এ অস্ত্রের আঘাতেই তাঁকে ধরাশায়ী করা সম্ভব। তাদের অলীক কল্পনা ছিল যে, হয়তো ভিনদেশী লোকেরা দ্বীন গ্রহণ করতে এসে তাঁর বদনাম শুনে ইসলাম গ্রহণ না করেই নিজ দেশে ফিরে যাবে। আর যদি তারা যাচাই-বাছাই করতে আসে তাহলে তো ঘুরে ফিরে তাদের কাছেই আসতে হবে। তখন তারা তাদের মগজ ধোলাই করে তাঁর থেকে বিমুখ করেই ছাড়বে। কাফির-মুশরিক কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেয়া গালি ও মিথ্যা অপবাদের কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হল।
১. স্বধর্মত্যাগী, স্বধর্মভ্রষ্ট, দলত্যাগী ও বেদ্বীন : তারা স্বীয় ধর্মীয় লোকদের ও অন্ধ অনুসারীদের ক্ষিপ্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে আক্রমাত্মক স্বরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বেদ্বীন বা স্বধর্মত্যাগী বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। এই হীন ও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার ফলে তারা বলত যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্ম তথা ইসলাম গ্রহণ করে বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তখন আবূ লাহাব সাথে সাথে গিয়ে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করত।
রাবী‘আ ইবনু আব্বাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জাহিলিয়্যাতের (অর্থাৎ অন্ধকারের) যুগে ‘যুল-মাজায’ নামক বাজারে দেখলাম, তিনি বলছিলেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বল, সফলকাম হবে’। আর মানুষ তাঁর চতুষ্পার্শ্বে ভীড় জমাচ্ছিল। তাঁর পিছনে এক গৌরবর্ণ টেরা চোখবিশিষ্ট সুন্দর চেহারার লোক বলছিল, এ লোকটি স্বধর্মত্যাগী ও মিথ্যাবাদী। এ লোকটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছনে পিছনে যেখানে তিনি যেতেন সেখানেই যেত। তারপর আমি লোকদেরকে এ লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। লোকেরা বলল, এটি তাঁরই চাচা আবূ লাহাব’।[১]
জাহিলী যুগের মানুষদের প্রচারণায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। যিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক দ্বীন তথা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য নিরলসভাবে দাওয়াতী কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁকেই শুনতে হয়েছে স্বধর্মত্যাগী নামক নোংরা গালি ও কটাক্ষ।
২. পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী ও জামা‘আত বিভক্তকারী : তারা নবী (ﷺ)-কে পূর্ব-পুরুষদের ধর্ম বিনষ্টকারী ও ঐক্য বিনাশকারী হিসাবে সমাজের মাঝে প্রচারণা চালিয়েছিল। জাহিলী যুগে কুরাইশা নেতারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আবূ তালিবের নিকট গিয়ে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ করে ইসলামের দাওয়াতী মিশন নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিল। প্রকারান্তরে তারা নবী করীম (ﷺ)-কে নিয়ে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা স্বীয় চাচার কাছে অভিযোগ করে যে, ‘আপনার পিতা-পিতামহের বিরোধিতা করছে, আপনার জাতির ঐক্য ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। (তাঁকে আমাদের হাতে তুলে দিন) আমরা তাঁকে হত্যা করব’।[২]
৩. রায়িনা : মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালি স্বরূপ ও ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় ‘রায়িনা’ বলে ডাকত। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ‘বিবেক বিকৃত লোক অথবা দুষ্ট ব্যক্তি’। তারা অস্পষ্ট নাম ব্যবহার করে মনের ঝাল মিটাতে থাকে। মানুষকে কষ্ট দেয়ার জন্যই সাধারণত তার নাম বিকৃত করা হয়। এক্ষেত্রে তারাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বিকৃত নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। যেমনভাবে আল্লাহ মুমিনদের ডাক দিয়ে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! (তোমরা মুহাম্মাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁকে) ‘রায়িনা’ বল না, বরং ‘উনযুরনা’ (আমাদের খেয়াল করুন) বল এবং (তাঁর নির্দেশ) শুনে নাও। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১০৪)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে কথোপকথন বা তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের সময় মুমিনগণের বুঝতে সমস্যা হলে তাঁরা বলতেন ‘রায়িনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন এবং ধীরে বলুন। শব্দটির আর একটি অর্থ ‘বোকা’। ইয়াহূদীরা শব্দটি শুনে একটু মুখ বাঁকিয়ে বিদ্রুপাত্মক ব্যবহার শুরু করল এবং নিজেরা হাসি-ঠাট্টা করতে লাগল। তখন আল্লাহ তা‘আলা উক্ত দ্ব্যর্থবোধক শব্দটির পরিবর্তে পরিষ্কার অর্থবোধক শব্দ ‘উনযুরনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি নজর দিন- শব্দটি ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন।
৪. আদর্শচ্যুত ও পথভ্রষ্ট : তারা নিজেরা দিশেহারা ও পথভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও উল্টো তারাই নবী করীম (ﷺ)-কে পথভ্রষ্ট বলে গালি-গালাজ করত। তাদের দৃষ্টিতে তারাই হক্বপন্থী এবং নবী করীম (ﷺ) ও মুমিনরাই বিপথগামী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এবং যখন তাদেরকে (অর্থাৎ মুমিনদেরকে কাফিররা) দেখত তখন বলত, নিশ্চয় এরা পথভ্রষ্ট’ (সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন : ৩২)।
৫. পাগল ও কবি : তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাগল বা কবি হিসাবে প্রচার করতে থাকে। যেন মানুষ তাঁর কথাকে মূল্যায়ন না করে এবং তাঁর নিকট অবতারিত অহী তথা কুরআন থেকে দূরে থাকে। কেননা পাগলের কথায় কেউ কর্ণপাত করে না। আর যদি পবিত্র কুরআনকে কবির কবিতা হিসাবে প্রমাণ করা যায়, তাহলে তা অহীর মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত হবে। তাই তারা এ নোংরা পথ বেছে নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যখন তাদেরকে বলা হত যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা অহংকার করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যকে বর্জন করব’ (সূরা আছ-ছাফ্ফাত : ৩৫-৩৬)।
৬. জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী : মানুষের অন্তরে কুধারণা ও ভীতি সঞ্চার করার জন্য তারা নবী করীম (ﷺ)-কে জাদুকর ও মিথ্যাবাদী হিসাবে প্রচার করতে শুরু করেছিল। কেননা পবিত্র কুরআনের বাণী শুনে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেত। আর এটাকেই তারা জাদুকরী প্রভাব বলে সমাজে প্রচার করতে থাকে। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে পারলে তাঁর প্রচারিত দ্বীন ‘ইসলাম’ কেউ গ্রহণ করবে না। এ ভেবেই তারা তাঁর উপর মিথ্যাবাদীর অপবাদ আরোপ করেছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এদের নিকট এদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী আসল, এতে অবিশ্বাসীরা বিস্ময়বোধ করল এবং বলল, এ তো এক জাদুকর এবং মিথ্যাবাদী’ (সূরা ছোয়াদ : ৪)।
৭. পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী : তাঁর উপর অবতীর্ণ কুরআনকে তারা পূর্ববর্তী লোকদের কল্পকথা বলে প্রচার চালিয়েছিল। তারা বলেছিল, এ সবই প্রাচীন যুগের মানুষের অলীক কল্পকাহিনী। কুরআনের ‘আহসানুল কাছাছ’ তথা সর্বোত্তম শিক্ষণীয় ঘটনাগুলোকে তারা অতীতের রূপকথার কাহিনী বলে চালানোর অপপ্রচেষ্টা করেছিল। যাতে পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের অন্তরে ঘৃণা, কুধারণা ও অবহেলা তৈরি হয়, কেউ যেন তাঁকে অহী হিসাবে বিশ্বাস না করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যখন তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা তো শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এর অনুরূপ বলতে পারি, এ তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়’ (সূরা আল-আনফাল : ৩১)। তিনি আরো বলেন, ‘ওরা বলে, এগুলো তো সে কালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। অতঃপর এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তাঁর নিকট পাঠ করা হয়’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৫)।
৮. অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী : তারা নবী করীম (ﷺ)-কে অন্যের সহযোগিতায় মিথ্যারোপকারী বলে প্রচার করতে থাকে। তারা দাবী করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রচারিত ধর্ম মিথ্যা। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের সাহায্যে এ মিথ্যা বাণী প্রস্তুত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘অবিশ্বাসীরা বলে, এ মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয়, সে নিজে তা উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে। ওরা অবশ্যই সীমালংঘন করে ও মিথ্যা বলে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৪)।
৯. মিথ্যা রটনাকারী : তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মিথ্যা রটনাকারী বলে অভিহিত করেছিল। ক্ষেত্র বিশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলা কোন বিধান রহিত করে তার পরিবর্তে ভিন্ন কোন বিধান অবতীর্ণ করলে তারা বলত, তিনি মিথ্যা উদ্ভাবনকারী না হলে এরূপ পরিবর্তন কেন হচ্ছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত অবতীর্ণ করি, আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন, তা তিনিই ভাল জানেন। তখন তারা বলে, ‘তুমি তো শুধু একজন মিথ্যা উদ্ভাবনকারী। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না’ (সূরা আন-নাহাল : ১০১)।
১০. ভবিষ্যদ্বক্তা : তারা মানুষের অন্তরে দ্বিধাদ্বন্দ তৈরি করার জন্য নবী করীম (ﷺ)-কে গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে চিত্রিত করতে থাকে। আর এসবের উদ্দেশ্য ছিল যেন মানুষ তাঁর প্রচারিত দ্বীন তথা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। অনেক সময় তাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কথাগুলোকে আল্লাহ জিবরীল (আলাইহিস সালাম) মারফত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জানিয়ে দিতেন। তখন তারা বলত, এ তো দেখছি ভবিষ্যদ্বক্তা বা জ্যোতিষী। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অতএব আপনি উপদেশ দান করতে থাকুন, আপনার প্রভুর অনুগ্রহে আপনি গণকও নন এবং পাগলও নন’ (সূরা আত-তূর : ২৯)।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের দিকসমূহ তুলে ধরার দার্শনিক ও বাস্তবধর্মী কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল-
(ক) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দাওয়াতী ও তাবলীগী কর্মপদ্ধতি ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দাওয়াতী ও তাবলীগী কর্মপদ্ধতি ও কর্মক্ষেত্রের বৃহৎ অংশই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মোটামুটি পাঁচশ’ বছর পর নবী (ﷺ) আবির্ভূত হন। দীর্ঘ বিরতির ফলে মক্কা-মদীনাসহ সমগ্র বিশ্ব শিরক ও বিদ‘আতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
মক্কার বাসিন্দারা মূলত ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর বংশধর ছিল। তারা দ্বীনে ইবরাহীমের অনুসারী এবং তাওহীদপন্থী ছিল। তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধণিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তিপূজার শিরকের প্রচলন হয়। তারা আল্লাহর বিধানসমূহকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তিপূজার মত নিকৃষ্টতম শিরকের প্রবর্তন করেছিল।
কুরাইশ বংশের বনু খুযা‘আহ গোত্রের সরদার ‘আমর বিন লুহাই অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক ছিল। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলিম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হত। অতএব শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার সে শামের ‘বালক্বা’ অঞ্চলের ‘মাআব’ নগরীতে গিয়ে দেখে যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হোব্ল’ নামক মূর্তির পূজা করছে। সে তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, ‘আমরা এই মূর্তির অছীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য প্রার্থনা করলে সাহায্য পাই’। এরা ছিল আমালিক্বা গোত্রের লোক এবং ইমলীক্ব বিন লাবিয বিন সাম বিন নূহ-এর বংশধর।[৩] ‘আমর ভাবল অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মভূমি ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন ‘হোব্ল’ মূর্তির অছীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব নিশ্চয়। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোব্ল মূর্তি ক্রয় করে নিয়ে গেল এবং মক্কার নেতাদের রাজি করিয়ে কা‘বাগৃহে স্থাপন করল। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল। সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সময়কার বিখ্যাত ‘আদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাসর (সুরা আন-নূহ : ২৩) প্রতিমাগুলো জেদ্দার অমুক স্থানে মাটির নিচে প্রোথিত আছে। ‘আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিল। অতঃপর হজ্জের মওসুমে সেগুলোকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সমর্পণ করল। এভাবে ‘আমর ছিল প্রথম ব্যক্তি, যে ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর দ্বীনে পরিবর্তন আনে এবং তাওহীদের বদলে শিরকের প্রবর্তন করে।[৪]
অতঃপর মক্কাবাসীদের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর জাতির রেখে যাওয়া ‘আদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাসর (সুরা আন-নূহ : ২৩) প্রভৃতি মূর্তিগুলো পরবর্তীতে ইবরাহীমের বংশধরগণের দ্বারা পূজিত হতে থাকে।[৫]
এভাবে পর্যায়ক্রমে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তিপূজার প্রসার ঘটতে থাকে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কা‘বাগৃহের ভিতরে ও চারপাশে অসংখ্য মূর্তি দেখতে পান। তিনি সবগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন এবং কা‘বাগৃহকে পানি দ্বারা ধৌত করে পবিত্র করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হল, ... অতঃপর আমাকে দেখানো হল ‘আমর বিন ‘আমির আল-খুযাঈকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ী-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে ‘সায়্যিবাহ্’ বা উট ছেড়ে দেয়ার প্রথা চালু করেছিল। যা লোকেরা রোগ থেকে আরোগ্যে লাভের পর কিংবা সফর থেকে ফিরে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত। ঐ সব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারু ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না’।[৬] এই সেই ‘আমর বিন লুহাই বিন ‘আমীর, যে সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহে ‘হোবল’ মূর্তির পূজা শুরু করে।[৭]
তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহ্বান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাত। তাদের ধারণা ছিল যে, এই মূর্তিই তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (সূরা আয-যুমার : ০৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুপারিশ করবে (সূরা ইউনুস : ১৮)।
তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ত্বাওয়াফ করত। তার সামনে নত হত ও সেজদা করত। ত্বাওয়াফের সময় তারা শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত। তারা বলত,لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ إِلَّا شَرِيْكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ ‘হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত। তোমার কোন শরীক নেই, ঐ শরীক ব্যতীত যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক’। মুশরিকরা ‘লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থাম থাম) বলতেন।[৮] এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَ مَا یُؤۡمِنُ اَکۡثَرُہُمۡ بِاللّٰہِ اِلَّا وَ ہُمۡ مُّشۡرِکُوۡنَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, অথচ সেই সাথে শিরকও করে’ (সূরা ইউসুফ : ১০৬)। তারা মূর্তির জন্য নযর-নিয়ায নিয়ে আসত এবং মূর্তির নামে উৎসর্গ করত (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদিপশু ও চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (সূরা আল-আন‘আম : ১৩৮-১৪০)।
তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত (সূরা আল-মায়িদাহ : ৯০-৯১)। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোব্ল দেবতার খাদিম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলো ঘুলিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষীদের কথা বিশ্বাস করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ মনে করত।[৯] তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে বা রেখা টেনে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত এবং পাখি ডানে গেলে শুভ ও বামে গেলে অশুভ ধারণা করত।[১০] তারা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলত এবং জিনদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তা সাব্যস্ত করত (সূরা আছ-ছাফ্ফাত : ১৫০-৫২, ১৫৮-৫৯)।
এতো প্রকারের মূর্তিপূজা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপরেই সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। কেননা ‘আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিল যে, এগুলো ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ভাল কিছুর সংযোজন বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ মাত্র। এজন্যই সে বেশকিছু বিদ‘আত ও ধর্মীয় রীতি-নীতি চালু করেছিল।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯০২৬, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৪১, সনদ ছহীহ লিগয়রিহি।
[২]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৯৪।
[৩]. সীরাতু ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৭।
[৪]. আর-রাহীক্বুল মাখতূম, পৃ. ৩৫।
[৫]. সীরাতু ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৭-৮৭।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫২১; ছহীহ মুসলিম, হা/৯০৪, ২৮৫৬, মিরক্বাত শারহে মিশকাত, হা/৫৩৪১।
[৭]. সীরাতু ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৮৫; মিশকাত, হা/২৫৫৪, ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৩; মিশকাত, হা/৪৫৯৬-৯৭।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩৭; মিশকাত, হা/৪৫৯২।