প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে
সুখ-দুঃখের সাতকাহন
(৮ম কিস্তি)
(২৩)
ইন্ডিয়া সফরের বর্ণনায় আজকের পর্বের দর্শণীয় স্থান আগ্রার-তাজমহল। উযাইর সহ ১৯৮৩ সালের আগষ্ট মাসের রৌদ্র উজ্জ্বল এক সকালে তাজ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগ্রার পথে রওয়ানা হলাম। দিল্লি থেকে আগ্রা শহরের দূরত্ব ২২১ কিলোমিটার, যতদূর মনে পড়ে আমরা চার ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছি। আশে-পাশের এক হোটেলে দুপুরের খানা খেয়ে আমরা তাজ মহল কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকলাম। তাজমহল সম্পর্কে এতদিন যা শুনেছিলাম, আসলে এর সৌন্দর্য তার চেয়েও সুন্দর। এক কথায় এর সৌন্দর্য ও নির্মাণ-শৈলীর বর্ণনা দেয়া কবি সাহিত্যিক এবং কথা শিল্পীদের কাজ।
এ কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি রেষ্ট হাউস, একটি মসজিদ, তাজ মহল আর রঙ বে-রঙের ফুল বাগান। পৃথিবীর সপ্ত-আশ্চর্যের অন্যতম এ স্থাপত্য শিল্প কর্মটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতার বর্ণনা দেয়া সম্ভব হলেও এর অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া এক কথায় অসম্ভব। ১৬৩২ খৃ. সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের সমাধি হিসাবে এটি নির্মাণ করেন, এখানে সমাধির ঠিক উপরে সম্রাট শাহ-জাহানের ঝুলন্ত কবর রয়েছে। লোক মুখে শোনা কথা, শাহজাহানের কবর থেকে এক মিনিট পর পর একফোঁটা জল অশ্রু হিসাবে ঝরে পড়ত মমতাজ বেগমের সমাধিতে, এটাকে শোক প্রকাশ-এর প্রতীক মনে করা হত। ইংরেজ সরকার এই প্রযুক্তির রহস্য উন্মোচন করতে এবং এ কৌশল শেখার নিমিত্তে পার্শ্ববর্তী নদীতে খোঁড়াখুঁড়ি করে, ফলে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
শাহজাহানের কার্যকাল ১৬২৮-১৬৫৮ খৃ.
এই কার্যকালের মধ্যে তিনি তাজমহলের মত অপূর্ব সুন্দর স্থাপনা তৈরি করেন। একটি ভালো কাজও করেছেন তাহল দিল্লির শাহী মসজিদ এবং লাহোরের শাহী মসজিদ নির্মাণ। তাজমহল কমপ্লেক্সটি ৪২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। আইভরি সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি তাজ মহল যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এই কমপ্লেক্সের তিন দিকে খাঁজ কাটা সাদা পাথরের সুউচ্চ বাউন্ডারি ওয়াল অবশিষ্ট একদিকে তাজ মহল। এই শিল্পকর্মের চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন উস্তাদ আহমদ লাহোরী।
তাজমহল নির্মাণ কাজ ১৬৩২-এ শুরু হয় এবং দশ বছরের মধ্যেই মূল কাঠামো তৈরির কাজ শেষ হয়। অবশিষ্ট ডেকোরেশন কাজ করতে আরও দশ বছর সময় লাগে। ফলে সর্বমোট বিশ বছর ধরে বিশ হাজার শ্রমিক ও মিস্ত্রি একদল দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশনায় কাজ করেন এবং ১৬৫৩ খৃষ্টাব্দে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
তাজমহলের উচ্চতা ২৪০ ফিট এবং এর জন্য ব্যয় হয় তৎকালীন ৩২ মিলিয়ন ইন্ডিয়ান রুপি যা বর্তমান হিসাবে ৭০ বিলিয়ন বা সাত হাজার কোটি রুপি বা ৯৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাজমহল ১৯৮৩ খৃ. ডড়ৎষফ ঐবৎরঃধমব ঝরঃব হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত। এটিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্মাণ শৈলী বলে জাতিসংঘের এক ঘোষণায় স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটি একটি ইন্দো-ইসলামিক কারুকার্যের শ্রেষ্ঠ নমূনা।
তাজমহলের ভিতটা আরচ টাইপের আটকোণ বিশিষ্ট স্কোয়ার সাইজের এবং উপরে বড় আকারের গুম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপনা। এর দেয়ালে আম, আপেল ও আঙ্গুরের ছবি দেখে মানুষ তো বটেই পাখিরা পর্যন্ত ধোঁকা খায়। পাকা আমের উপর ঠোকর মারতে পাশের ডালে বসতে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পাখিরা নিচে পড়ে যায়। এত নিখুঁত কারুকার্য, গাছের কা-, ডাল, পাতা ও ফলের রঙ বিশেষত ফলের কোন দিকে পাকা শুরু হয়েছে সেটা ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই শিল্প-কর্মের নৈপুণ্য, চারশ বছরের দীর্ঘ সময়েও একটুও কমেনি বরং চাঁদনি রাতে এর চাকচিক্য যেন আরো বেড়ে যায়।
চার কোণে চারটি মিনার এর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া ভবনটির দক্ষিণ দিকে লম্বা একটা জলাশয় তৈরি করা আছে। উভয় পাড়ে পাথরের মসৃণ চত্তর, তার পাশে ফুল বাগান, সেখানে রয়েছে হরেক রকমের ফোঁটা ফুল। স্থানটিকে যেন স্বপ্নপুরিতে রূপান্তরিত করে রেখেছে। অগণিত দর্শনার্থীর ভিড়, আমরা দু’জন যেন বাকরূদ্ধ অবস্থায়।
দর্শনার্থীদের সবার হাতে কাগজ কলম, তাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে নোট করার হিড়িক, আর কবিদের কবিতা লেখার জযবা দেখে আমি বিষন্ন মনে ভাবছিলাম, কত বিচিত্র এই দুনিয়া! কেউ স্ত্রীর কবরের জন্য কোটি কোটি রুপি খরচ করেছেন, আর কেউ এটাকে দেখার জন্য লাখ লাখ রুপি খরচ করছেন!
উযাইর তখনও অবিবাহিত ছিল। আমি মনে মনে সংকল্প করলাম, বেঁচে থাকলে পরের বার একা নয় প্রিয়তমাকেও সঙ্গে আনব। কিন্তু আমি আবারও এক কনফারেন্সে যোগদান করতে ২০১৫ সালে দিল্লি গিয়েছিলাম। কিন্তু সংকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জামেয়া মিল্লিয়ার নেহরু হলে আটকে ছিলাম এবং বিভিন্ন ভবনে ছাত্র হিসাবে আরব মাশায়েখের মূল্যবান লেকচার নোট করায় ব্যস্ত থেকেছি। দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ইনশাআল্লাহ আমরা আবার যাব।
(২৪)
দিল্লি মহানগরে আরোও সপ্তাহখানেক ছিলাম, বন্ধুবর ওযাইর সঙ্গে ছিল বলে খুব সহজেই অনেক কিছু দেখা এবং জানার সুযোগ হয়েছিল। মোঘল সম্রাটদের ধ্বংসাবশেষ দেখার সাধ ছিল। লাইট এন্ড সাউন্ড প্রোগ্রাম দেখলাম বেশ কয়েকবার উর্দু, ইংরেজী ও হিন্দি ভাষায়। এর সার-সংক্ষেপ ছিল এ রকম যে, একটা বিল্ডিং হঠাৎ বিকশিত ও আলোকিত হয়ে উঠে। বিল্ডিং এর ভিত ও প্লিন্থ থেকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়। অতঃপর নিজেই তার আতœকাহিনী বলতে থাকে। কার আমলে কত সালে তৈরি হয়, কতদিন গৌরব এবং ঐতিহ্য আকাশ চুম্বি ছিল, পতন শুরু কখন থেকে, পরিতায্য কবে থেকে, কারা এখানে বাস করতেন।
এক এক করে দেখলাম, মতি মসজিদ (মসজিদ লু-লু,) এটি দেওয়ান খাস সংলগ্ন এবং শাহী হাম্মামাত কমপ্লেক্সে এর পশ্চিমে অবস্থিত। এর সামনে সবুজ ঘাসের বিশাল ময়দান। এই ঘাসের উপর বসেই প্রোগ্রামটি দেখানো হয়। প্রতি শো-তে তিন চার শতাধিক দর্শনার্থীর ভিড় হয়। একটি শো দেখতে ঘন্টা খানেক সময় লাগে। সকাল সাতটায় শুরু হয়, রাত আটটার পর বন্ধ হয়। প্রতি ঘন্টায় নুতন টিকেট সংগ্রহ করতে হয়, পালাক্রমে বিভিন্ন ভাষায় দেখানো হয়। দেখার সুযোগ হয়েছে এমন সব কিছুর বর্ণনা দেয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তবে একটু আভাস না দিলে বেরসিক বলা হবে।
মতি মসজিদ
রেড ফোর্ট বা লাল কেলা’ কমপ্লেক্সের নিকট মতি মসজিদটি নির্মিত হয় ১৬৫৯-৬০সালে। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি। মসজিদটির আয়তন আহামরি কিছু না হলেও খুব সুন্দর। ইন্দো-ইসলামিক আর্কিটেকচারের স্ট্যাইল, সম্রাট আওরঙ্গজেব মূলত প্রাসাদের মহিলা মুছল্লিদের জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের লক্ষ্যেই এটি নির্মাণ করেছিলেন। মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা গেইট, ওযূখানাও পৃথক পৃথক। পরিতাপের বিষয় প্রতœতাত্বিক নিয়মের আওতাধীনে হওয়ায় বহু বছর ব্যাপী এটি বন্ধ আছে।
লাল কেলা’ বা রেড-ফোর্ট
সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করতে মনস্থ করলেন। তিনি তাজমহলের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার আহমদ লাহৌরী-কে প্রাসাদের নকশা তৈরি করতে আদেশ দিলেন। গড়ে উঠল লাল মার্বেল পাথরের অনুপম ইমারত। যা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভিজিট করছেন। এই বিশাল দুর্গটির নির্মাণ কাজ ১২ মে ১৬৩৯ সালে শুরু হয় এবং ৬ এপ্রিল ১৬৪৮ সালে সমাপ্ত হয়।
দুর্গটির চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এটিই সম্রাটদের প্যালেস হিসাবে ১৮৫৭ পর্যন্ত বহাল ছিল। মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ পর্যন্ত এটি রাজধানীর মূল আকর্ষণ ছিল। বৃটিশ সরকার এটি ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে ব্যবহার করতেন ১৯৪৭ পর্যন্ত। বর্তমানে এটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র।
দিওয়ানে খাছ ও দিওয়ানে আম
সম্রাটদের আদেশ, ফরমান, নির্দেশনা এবং চিঠিপত্র রচনা ও প্রেরণের মূল কেন্দ্র ছিল দেওয়ান। কেন্দ্রীয় আদেশ ও নির্দেশনা দিতেন সম্রাট। আর প্রেরিত হত প্রাদেশিক সরকারের প্রধানদের নিকট। প্রথম দিকে বলা হত দিওয়ানুল মুকাতিবাত সংক্ষেপে দিওয়ান নামেই পরিচিত হয়। সচিবালয়ের ভূমিকা পালন করা হত। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ নিয়ে সম্রাটদের সমাবেশ হত দেওয়ানে খাছে। এবং সাধারণ মানুষের সাথে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হত দিওয়ানে আমে।
শাহী হাম্মামাত
সুবিশাল এই ভবনের তিনটি অংশ আছে, মহিলাদের জন্য, পুরুষের জন্য এবং শাহী মেহমানদের জন্য। প্রতিটি অংশই পৃথক পৃথক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভবনগুলো কী দিয়ে যে তৈরি এখনও বিস্ময়ে ভরা। মোগলদের আমল শুরু হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালে এবং এই বিশাল সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ (৩০১ বছর)
وتلك الايام نداولها بين الناس
‘মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন ঘটাই’ (সূরা আলে ‘ইমরান, আয়াত ১৪০)।
প্রসঙ্গসমূহ »:
স্মৃতিচারণ