প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে
সুখ-দুঃখের সাতকাহন
(৪র্থ কিস্তি)
(১১)
একদিন এক ছাত্র মুহতারাম উসতায উছমান সাহেবকে বলল, উস্তায! আপনার রচিত গ্রন্থের সূচিপত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসায় উম্মু মা‘বাদ এর অলংকারপূর্ণ বর্ণনাটি নেই, আমরা আশা করি আপনি এ বিষয়ে একদিন আলোচনা করলে আমরা উপকৃত হব।
তিনি বললেন, মাষ্টার পিএইচ.ডি পর্যায়ের গবেষকরা এটা কঠিন মনে করেন, তাই এই পর্যায়ে তোমাদের উপর আমি কঠিন কিছু চাপাতে চাইনি। তোমরা আগ্রহী হলে আমি তোমাদের এ বিষয়ে একদিন একটা লেকচার শোনাব ইনশাআল্লাহ, তবে এটা পরীক্ষায় আসবে না। ‘ছাত্রদের রেজাল্ট ভাল হোক এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সহজ হোক’ আদর্শ শিক্ষকরা এমনটিই কামনা করেন।
যাই হোক প্রিয় স্যার পরের ক্লাসেই বললেন, আজ তোমাদেরকে উম্মু মা‘বাদের মুখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শানে অলংকারপূর্ণ বর্ণনা সংক্ষেপে আলোচনা করব, তবে আমি একজন আরব হয়েও এখানে ব্যবহৃত শব্দ ভাণ্ডারের কুল কিনারা করতে পুরোপুরি সক্ষম নই। তোমাদের কারো এ বিষয়ে ভালো স্টাডি থাকলে আমাকে সহায়তা করবা। তিনি আলোচনা শুরু করলেন আর আমরা মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। উম্মু মা‘বাদ এর মুখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গুণাবলী যেন তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সর্বোত্তম অভিব্যক্তি। বিগত চৌদ্দ’শ বছর ধরে কেউই এমন অলংকার ও তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে সক্ষম হননি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা মুনাওয়ারার দিকে হিজরতের প্রাক্কালে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে সাথে নিয়ে প্রথমে বিপরীত দিকে ‘গারে ছাওর’ যান। সেখানে তিন দিন অবস্থান করে আবার মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়। তাঁরা সর্বমোট চারজন ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আবূ বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু), আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে আশ্রিত আমের বিন ফুহাইরা এবং পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ ইবনু উরাইকেত আল লাইসী। পথিমধ্যে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটি তাঁবূতে গিয়ে পানি চাইলেন, তাঁবূ থেকে বের হলেন এক বৃদ্ধা। বয়সের কারণে তার শরীর যুবতী নারীর মত পরিপূর্ণ আবৃত ছিল না। তিনি তাদের পানি পান করালেন। এরপর তাঁরা খাবার জন্য গোশত, খেজুর অর্থের বিনিময়ে পাবেন কিনা জানতে চাইলে বৃদ্ধা বললেন, আমার ঘরে তোমাদের দেয়ার মত আর কিছু নেই। পথিকদের ও পথের সম্বল যা কিছু ছিল সবই শেষ। তাই তাঁবূর অদূরে একটি জরাজীর্ণ ছাগল দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, মা! এই ছাগিটা কি দুধ দেয়? বৃদ্ধা বললেন, না, ওটা তো দুর্বলতার দরুন মাঠে চরতে যেতেও পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবারো বললেন, অনুমতি পেলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। বৃদ্ধা মুচকি হেসে বললেন, ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে দুধ দহন শুরু করলেন। পাত্রটি দুধে পরিপূর্ণ হল। এবার তিনি প্রথমে বৃদ্ধাকে দুধপান করার অনুরোধ জানান। বৃদ্ধা পরিতৃপ্ত হয়ে দুধপান করেন। অতঃপর তিনি সাথীদের পান করিয়ে নিজেও পান করেন এবং পুনরায় তিনি দুধ দহন করে, দুধে পরিপূর্ণ পাত্রটি বৃদ্ধার নিকট রেখে বিদায় হন।
মেহমানদের চলে যাবার কিছুক্ষণ পর ছাগলের পাল সহ বাড়ি ফিরলেন আবূ মা‘বাদ। তিনি বাড়ি ফিরে কেন যেন কিসের এক ‘আলামত অনুভব করছিলেন। হঠাৎ উম্মু মা‘বাদের সামনে দুধের পাত্র দেখে চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে দুধ দেয়ার মত কোন ছাগল নেই, অসময়ে এত দুধ কিভাবে আসল? উম্মু মা‘বাদ জবাব দিলেন, মক্কা শহরের কয়েকজন মুসাফির এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন কুরাইশী যুবক, তিনি এত সুন্দর, ভদ্র ও অমায়িক যে আমি তাঁর বর্ণনা দিয়ে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারব না।
আবূ মা‘বাদ বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন এবং বললেন, আমি শুনেছি যে, মক্কায় একজন নবী এসেছেন সম্ভবত তিনিই হয়ত আমাদের তাঁবূতে তাশরিফ এনেছিলেন। দুর্ভাগ্য যে আমি ছিলাম না, যাক তাঁর সম্পর্কে তুমি একটা নিখুঁত বর্ণনা দাও, আমি যেভাবেই হোক তাঁকে খুঁজে বের করবই, ইনশাআল্লাহ। উম্মু মা‘বাদ বললেন,
مر بنا رجل قريشى ظاهر الوضاءة أبلج الوجه حسن الخلق لم تعبه ثجلة ولم تزر به صعلة وسيم قسيم فى عينيه دعج وفى أشفاره وطف وفى صوته صحل وفى عنقه سطع أحور أكحل ازج اقرن شديد سواد الشعر.اذا صمت علاه الوقار وإن تكلم علاه البهاء اجمل الناس وابهاهم من بعيد واحسنه وأحلاه من قريب حلو المنطق فضل لا نزر ولاهذر كان منطقه خرزات نظمن يتحدرن ربعة لاتقحمه عين من قصر ولا تشنوه من طول غصن بين غصنين فهو أنظر الثلاثة منظرا واحسنهم قدرا له رفقاء يحفون به اذاقال استمعوا. لقوله واذا أمر تبادروا إلى أمره محفود محشود لا عابس ولا مفند
মর্মার্থ : ‘আমি এমন একজন বরকতময় কুরাইশী মানুষ দেখেছি, যার সারা শরীর আলোকোজ্জ্বল, চেহারাও হাস্যোজ্জ্বল, তাঁর পেটটি বুকের চেয়ে উঁচু নয়, অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন না, তাঁর চোখের কালো অংশ তুলনামূলকভাবে বেশি কালো, খুব পাতলা নন, আবার খুব মোটাও নন, চোখের ভ্রুর চুলগুলো লম্বাটে ও ধনুকের মত একটু বাঁকা, গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠস্বর, সার্বিক বিচারে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম ও সর্বাধিক সুন্দর, মুখমণ্ডল আকর্ষণীয় ও দর্শকের দৃষ্টি কাড়ার মতই, চুপ থাকলে গাম্ভীর্য বেড়ে যায়, কথা বললে সাবলীল ও সুতা ছেড়া মুক্তা-মালার দানার মত যেন গড়িয়ে পড়ে, অত্যন্ত আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, কথা বললে তাঁর মাথা উঁচু থাকত, দূর থেকে দেখলে তাঁর চেহারা অতি উজ্জ্বল ও চাকচিক্যময় দেখাত, কাছে থেকে দেখলে মনে হত সৌন্দর্য আরো অধিক বেড়ে গেছে, মিষ্টভাষী ও স্পষ্টভাষী ছিলেন, তবে খুব স্বল্পভাষী ছিলেন না, প্রয়োজন ছাড়া তিনি কথাও বলতেন না। অপ্রয়োজনীয় কথা এড়িয়ে চলতেন। আবার বাহুল্য কথাও বলতেন না। তাঁর কথাগুলো শ্রোতাদের এমনভাবে আকর্ষণ করত যে, তাঁর মজলিসে কেউ প্রবেশ করলে শেষ পর্যন্ত বসেই থাকতেন।
উম্মু মা‘বাদ তাঁর বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) কথা-মালায় যে অলংকার, সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষণের ছোঁয়া উপলব্ধি করেছেন, তা অল্প কথায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অতঃপর তাঁর দৈহিক বর্ণনা দিয়ে বলেন, তিনি উচ্চতায় ছিলেন পরিমিত, বেঁটেও না, দীর্ঘ দেহীও না, দু’টির মাঝামাঝি আরেকটি, ‘গুসনুন বায়না গুসনাইন’। তাঁর মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলতা, তিনজনের উজ্জ্বলতার সমপরিমাণ, অপূর্ব সুন্দর, কাজল চোখের অধিকারী এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন, তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ তাঁকে চারিদিক থেকে পরিবেষ্টন করে রাখতেন, তিনি কথা বললে সকলেই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, আদেশ করলে তা বাস্তবায়নে সকলেই তৎপর হয়ে উঠতেন, সব সময়ই তিনি সঙ্গী-সাথীদের সমাবেশে থাকতে পসন্দ করতেন, সবাইকে আপনজন মনে করতেন, তাঁরাও তাঁর আনুগত্য করতে আগ্রহী থাকতেন, আর এর কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্ব ও অনুকরণীয় মহত্তের জন্যই, সবার মনে তাঁর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসার কারণেই’।
উম্মু মা‘বাদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেযাজ ও মননের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনি ‘আবেস ও মুফান্নিদ’ ছিলেন না, তাঁর চোখে মুখে কখনো অবসন্নতা বা অজ্ঞতা পরিলক্ষিত হত না বরং সবসময় তাঁর মধ্যে ‘এভার-ফ্রেস’ ভাব বিরাজ করত, মুখমণ্ডলে বুদ্ধি-দীপ্তিও প্রজ্ঞাপূর্ণ চাহনি থাকত, কেউ কখনো তাঁকে নির্বোধ বা কম-বুদ্ধি সম্পন্ন ভাবার সাহস পেত না। এক কথায় তিনি ছিলেন ‘জামীলুল মুয়াশারা’। অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান, বাক্য বিনিময় ও সুন্দর সমাজ গঠনের সমূহ গুণাবলী সম্পন্ন মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী’। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা,
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)।
---0---
(১২)
পড়ে অনেকেই উম্মু মা‘বাদের পরিচিতি, অবস্থান ইত্যাদি জানতে চেয়েছেন, আমি আরবী টেক্সটি সফিউর রহমান মুবারকপুরীর ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ থেকে নিয়েছি, আরও বিভিন্ন গ্রন্থ দেখে আমার নিকট এই ‘মতন’ টিই অধিক বিশুদ্ধ মনে হয়েছে। উম্মু মা‘বাদ কুনিয়াত বা উপনাম, আসল নাম সাইয়্যেদা আতিকা বিনতে খালিদ আল খোযাইয়্যা, তবে তিনি উপনাম উম্মু মা‘বাদ নামেই অধিক পরিচিতা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সফর সঙ্গিরা হিজরতের প্রাক্কালে মক্কা থেকে মদীনায় যাবার সময় সেই পরিবারে কিছুক্ষণ মুসাফির হিসাবে অবস্থান করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং উম্মু মা‘বাদ এর মধ্যেকার কথোপকথনের সময় বেশ কিছু পয়েন্ট লক্ষণীয় ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন, তাঁকে মা বলেই সম্বোধন করেছেন, অথচ তিনি তখনও মুসলিম হননি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, অমুসলিমদের সাথে শোভন আচরণ, মার্জিত ভাষায় সম্বোধন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শ ও সুন্নাহ। পক্ষান্তরে পানি ছাড়া আর কিছু খাবার আছে কি না জানতে চাইলে উম্মু মা‘বাদ বলেছিলেন, ‘ফিদাকা আবী ও উম্মী’। এ বাক্যটির সারমর্ম হল- আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করব তবুও আপনার কোন অসুবিধা হতে দিব না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জরাজীর্ণ একটি ছাগলের দুধ দহনের আগে অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন? ‘আ-তা’যানীনা’। আপনি কি আমাকে অনুমতি দিবেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমরাও এভাবে মানুষের সঙ্গে শোভন আচরণ করতে পারি, মুসলিম-অমুসলিম ছোট-বড় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সাথে অমায়িক আচরণ করতে পারলে একদিকে ইত্তেবায়ে রাসূল হবে, আবার সমাজের চিত্রটাও বদলে যাবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মানুষের কল্যাণে কাজ করার শক্তি দিন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মু মা‘বাদ এর গৃহ ত্যাগের পূর্বে তাঁকে বাই‘আত বা আনুগত্যের শপথ পাঠ করিয়েছিলেন। সুতরাং উম্মু মা‘বাদ মহিলা ছাহাবী ছিলেন, রাদিয়াল্লাহু আনহা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শানে উম্মু মা‘বাদ-এর বর্ণনা হাদীছের প্রায় সব গ্রন্থেই উল্লেখ আছে এবং ছহীহ হাদীছ হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গুণাবলীর অতি সূক্ষ্ম বর্ণনা শুনে তাঁর স্বামী আবূ মা‘বাদ বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! ইনিই তিনি, এই সেই কুরাইশী যুবক। আমি বেশ কিছু দিন আগে মক্কা সফরে গিয়ে তাঁর সম্পর্কেই শুনে এসেছি, ইনিই শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)। আমি তাঁর সঙ্গী হবার জন্য সংকল্প করলাম, তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করলে আমার জীবন ধন্য হবে, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছাহাবী হয়ে ধন্য হব।
উম্মু মা‘বাদের গৃহে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা সমূহের বর্ণনা শুনে এবং হাড্ডিসার ও বাচ্চাবিহীন বকরী থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে আবূ মা‘বাদের ইলমুল ইয়াক্বীন (নিশ্চিতজ্ঞান) যেন আইনুল ইয়াক্বীনে (চাক্ষুষ জ্ঞানে) রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখন তিনি এটাকে হাক্কুল ইয়াকীনের পর্যায়ে পৌঁছাতে চান। তিনি আর স্থির থাকতে পারছেন না। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মিলিত হয়ে তাঁর সহচর হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন এবং আরব বেদুইনদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্বরচিত কাসীদা আবৃত্তি শুরু করেন,
جزى الله رب الناس خير جزائه
رفيقين قالا خيمتى ام معبد
هما نزلاها بالهدى واهتدت به
فقد فاز من أمسى رفيق محمد
فيا لقصى ما زوى الله عنكم
به من فعال لا يجازى وسؤدد
ليهن بنى كعب مقام فتاتهم
ومقعدها للمؤمنين بمرصد
سلوا اختكم عن شاتها واناءها
فإنكم إن تسئلوا الشاة تشهد
دعاها بشاة حائل فتحلبت عليه
صريحاً ضرة الشاة مزبد
فغادرها رهنا لديها لحالب
يرددها فى مصدر ثم مورد
মর্মার্থ :
মানব জাতির প্রতিপালক মহান আল্লাহ
দুই বন্ধুকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন,
তাঁরা দুপুরের উত্তাপে একটু বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে উম্মু মা‘বাদের তাঁবুতে আগমন করেন,
তাঁদের সাথে ছিল হেদায়াতের মশাল, ভাগ্যবতী উম্মু মা‘বাদ নিজেকে আলোকিত করেছেন।
আর সেই তো সফলকাম, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সঙ্গী
হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে যার।
ওহে কুসাই গোত্রের জনগণ!
মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য মর্যাদার দিগন্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন। এখন আর কেউ নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা পেতে তোমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পাবে না। কারণ তোমাদের বংশে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন হওয়ায় বানূ কা‘ব গোত্রের তরুণ প্রজন্মের জন্য সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ স্থান দখল সহজতর হয়েছে। মুমিনদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকবে সবসময় তোমাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই।
তোমরা তোমাদের বোন উম্মু মা‘বাদকে তাঁর
ছাগল এবং দুধের পাত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে দেখ, তোমরা জিজ্ঞেস করলেই উপযুক্ত প্রমাণ পাবে, তিনি একটি বাচ্চাবিহীন ছাগলের ওলান থেকে দুধের পাত্র ভরে দুধ দহন করে অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন, সোজা কথা ছাগলের ওলান যেন দুধের সরোবরে পরিণত হয়েছে, অতঃপর তিনি দুধে ভরা একটি পাত্র তাঁর কাছে রেখে উম্মু মা‘বাদের তাঁবু থেকে বিদায় নিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, আবূ মা‘বাদ এই কবিতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার আবৃত্তি করতে করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। ঐতিহাসিকগণ কেউ কেউ আরো একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করছেন, আবূ মা‘বাদ এর মুখে এই কবিতা উচ্চারিত হওয়ার মুহূর্তেই মক্কা শহরের লোকজন তা শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু কে বলছেন তা দেখতে বা বুঝতে পারেননি। আসমা বিনতে আবূ বকর এ কবিতা শুনে নিশ্চিত হয়েছেন যে, তাঁর বাবা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন। হিজরতের সময় মদীনা নামটি অধিক নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখা হয়েছিল। যদিও অধিকাংশ মানুষ জানত মদীনা অভিমুখেই মুহাম্মাদ হিজরত করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, জিনদের দ্বারাই এটি প্রচার পেয়েছিল, আল্লাহু আ‘লাম। (আমি বিগত তিরিশ বছর মক্কা মুকাররামায় ও মদীনা মুনাওয়ারায় ঘুরে ফিরে উম্মু মা‘বাদের তাঁবুর অবস্থান যতটুকু জেনেছি তাহল এটি মক্কা মদীনার মাঝখানে ‘রাবেগ’ অঞ্চল, ছোট বড় সব ধরনের যানবাহন এখানে বিরতি দিয়ে নাশতা পানি খায়, একটু বিশ্রাম নেয়। হয়তো তাঁদের বংশ পরম্পরায় কেউ আছেন হোটেল ব্যবসায়ী সেজে মানুষের সেবা করছেন)।
---0---
(১৩)
উম্মুল ক্বুরা ইউনিভার্সিটির অধীনে মা‘হাদ আল-লুগাহ আল-আরাবিয়ার ষষ্ঠ সেমিষ্টারে সর্বমোট ছয় মাস ক্লাস হয়েছিল। আমি এক মাস পর ভর্তি হওয়ায় পাঁচ মাস ক্লাস পাই। এখানে আরো কয়েকজন অধ্যাপকের সাথে সুমধুর স্মৃতি রয়েছে। সবার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ নেই, সংক্ষিপ্ত আকারে কয়েকজনের নামধাম উল্লেখ করেই এ প্রসঙ্গের ইতি টানব।
প্রফেসর আব্দুস সাত্তার
সত্তরের দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সঊদী আরবে অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে যোগদান করতে গিয়ে আফগানিস্তানে সরকার পরিবর্তনের ফলে তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। সঊদী আরবে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কিছু দিন ভাষা রপ্ত করে শিক্ষকতা শুরু করেন। ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। আরব শিক্ষকবৃন্দের কাছে পড়ালেখার পর আজমি শিক্ষকের ক্লাসে মজা পেতাম না, যদিও তিনি খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন।
ড. আব্দুল্লাহ আল-আব্বাস
তিনি আরবি ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আরবি ব্যাকরণের উপর তাঁর তিন খণ্ডের প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল। তিনি মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উপরও ভালো দখল ছিল। তাই তিনি জেদ্দা রেডিওতে উর্দূ প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন। একদিন তিনি আমাদের হাতের লেখা দেখবেন বললেন। আমরা বাড়ি থেকে পরদিন সবাই লিখে নিয়ে গেলাম। আমার ধারণা ছিল আমার হাতের লেখা টাইপ অনুসরণে। সুতরাং আজ আমি বাহবা পাব, কিন্তু দূঃখের বিষয় তিনি আমার খাতায় মন্তব্য লিখলেন, ‘লেখাটা খুউব কাঁচা’ (الخط رديئ جدا )। জীবনে প্রথম হোঁচট খেলাম, ছাপা অক্ষর অনুকরণ করার জন্য আজ এই ফল পেলাম। শুরু হল লেখার উপর পড়াশোনা, জানলাম, প্রতি শতাব্দীতে হাতের লেখা অসংখ্যবার পরিবর্তন হয়। বর্তমানে ‘খাত্তে রোকা’ হাতের লেখার জন্য স্ট্যান্ডার্ড মনে করা হয়। পাঠকদের জন্য লেখার কয়েকটি স্টাইল আজকের লেখা শেষে নমুনা স্বরূপ পরিবেশন করব, ইনশাআল্লাহ।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষা গ্রহণ, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, প্রশ্ন মডারেশন ও ফলাফল প্রকাশ বিষয়ের সাথে সঊদী আরবের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। সে দেশের বার্ষিক ক্যালেন্ডারে উল্লেখ থাকে যে, কবে কোন্ পরীক্ষা শুরু হবে, কোন্ দিন ফলপ্রকাশের তারিখ ইত্যাদি। শিক্ষকদের প্রতি আস্থা এত বেশি দেখেছি যে বলে শেষ হবে না। পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নে তারা খুব স্বাধীন। কোর্স টিচার একক হাতে তার কোর্স নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চশিক্ষা সব স্তরে একই ধারা লক্ষ্য করেছি। একই বিষয়ে দুই জন আলাদাভাবে প্রশ্ন করবেন, অতঃপর মডারেশন, এসবের কোন ঝামেলা নেই।
জানুয়ারি মাসের শেষ তারিখে ভর্তি হয়ে জুনের মধ্যেই ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করলাম। তারা আমার হাতে তৃতীয় শ্রেণীর (জাইয়্যেদ) একটা সার্টিফিকেট দিয়ে বললেন, পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি সম্পন্ন করতে না পারলে তোমার স্কলারশিপ বন্ধ থাকবে। উল্লেখ্য যে, আমি শুধু শেষ সেমিষ্টারের ছাত্র ছিলাম, আর ছয় সেমিষ্টারের নম্বর গড় করে ফাইনাল রেজাল্ট তৈরি করা হয়েছে, তাই এ অবস্থা। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাস গরমের ছুটি। পুরাতন ছাত্ররা ছুটিতে নিজ নিজ দেশে যাচ্ছে। আমার সহপাঠীদের অধিকাংশেরও ভর্তি কমপ্লিট। তাই তারাও টিকিট পাওয়ার জন্য তৎপর ছিল।
আমি হায়ার স্টাডি বা দিরাসাত আল-উলিয়া ছাড়া গ্রাজুয়েশন লেভেলে ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। হায়ার স্টাডির ডীন মহোদয় আমাকে বললেন, তোমার দেশের এম.এ সার্টিফিকেটের সাথে আমাদের দেশের সমতা বিধান (Equivalent) নেই, কেবল এইচ.এস.সি পরীক্ষার সাথে সমতা বিধান করা হয়েছে। অতএব তুমি উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর দরখাস্ত পাঠাও এবং তোমার সার্টিফিকেট এর কপি, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাগজপত্রসহ পাঠিয়ে দাও। সে অনুযায়ী দরখাস্ত পাঠিয়ে আমি অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকলাম। দেখতে দেখতেই সাড়ে তিন মাস পার হয়ে গেল। নিজ নিজ দেশে ছুটি কাটিয়ে ছাত্রদের ফেরা শুরু হল।
আদ-দিরাসাতুল উলইয়ায় ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য নোটিশ বোর্ডে একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে ডীন মহোদয়ের অফিসে খোঁজ নিতে গেলাম, আমার আবেদনের জবাব এসেছে কিনা জানতে চাইলে তারা বললেন, ‘লিস সা‘ মা গা-শ’ কথ্য ভাষায় আরবি ভাষার কী দূরবস্থা! তারা বললেন, এখনও তোমার আবেদনের জবাব আসেনি। মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার বিনা তদবীরে কিছু হবে না। আর রিয়াদ গিয়ে তদবীর করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। গরমের সময়ে চার মাসের জন্য রাজধানী রিয়াদ থেকে তায়েফে স্থানান্তরিত হয়, এ কথা জানা ছিল না। ভাবলাম ভর্তি হতে না পারলে দেশে ফিরতে হবে। অতএব তায়েফ শহরটা একটু দেখে আসি। কারণ, যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের সবচেয়ে দূঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। ‘সাপতকো’ সরকারি পরিবহনে তায়েফ রওয়ানা হলাম। আমার মনে আছে সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। মক্কা থেকে পূর্ব দিকে ৪৪ কিলোমিটার যাওয়ার পর তায়েফ পর্বত দেখলাম ‘উজ’ নামক এক উপত্যকার পাশে। শুরু হল উপরে উঠার পালা। গাড়ি চলছে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে। প্রায় আড়াই কিলো উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠতে সময় লেগেছিল আধ ঘন্টা, মক্কা থেকে সর্বমোট ৮৮ কিলোমিটার গাড়ির মিটার অনুযায়ী। তায়েফ পাহাড়ের পশ্চিম দিক থেকে আমাদের গাড়িটি উঠেছিল। পূর্ব দিকটা তুলনায় ঢালু, তবে দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় রাস্তা ছিল না।
গাড়ি থেকে নেমে আবহাওয়া মনে হল, আমি কোন শীতের দেশে এসেছি। মেঘের উপর এক মনোরম পরিবেশে এসে পড়েছি। যে দিকেই যাই সবুজ আর সবুজের সমারোহ। প্রকৃতিকে খুবই চেনা চেনা লাগে। মসজিদে আব্বাসের পাশের একটি খাবার হোটেল ছিল সেখানে কিছু খাবার উদ্দেশ্যে ঢুকলাম। গেইটেই এক অল্প বয়সী ছেলে ‘রাস-মিন্ডি রাস-মিন্ডি’ বলে জোর গলায় হাঁক ছাড়ছে। বুঝতে চেষ্টা করলাম, ক্লিয়ার বুঝলাম না। তাই ওটা খেয়েই বুঝব বলে অর্ডার দিলাম। দেখলাম আস্ত একটা ছাগলের মাথা, ঝোলে ডুবান অবস্থায় রেখে গেল। আরেক প্লেটে টমেটো সস দিয়ে রান্না করা লাল ভাত। মসুরের ডাল আর সাদা ভাত খাওয়া বাঙালি, কাঁচা মরিচ চাইলাম, তা-ও পেলাম, সংগে দিল কাল রঙের কচি শসা, টমেটো কুঁচি। ক্ষুধার্ত ছিলাম তাই ভাত তো খেলাম। তবে মাথা! মাথা দেখে আমারই মাথা ব্যাথা শুরু হল। খাসীর কাল্লা আমার প্রিয়, তা সত্ত্বেও এই মাথার খুলি ভাঙার বুদ্ধি পেলাম না। এছাড়া ঝোলে ডুবান মগজ খাওয়া সম্ভব হল না। দশ রিয়াল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ইতোমধ্যে যোহরের আযান হল। এবার ওযূ করে মসজিদে গেলাম। মসজিদের পাশেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কবর। দূর দেখে কবরবাসীর জন্য মাসনূন তরীকায় সালাম উচ্চারণ করলাম। কেউ কেউ কবরের উঁচু দেয়ালের ওপারটা দেখার জন্য কবরের দেয়াল ধরার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পুলিশের বাধায় তারা কাছে ঘেঁষতে পারেননি। আমি মসজিদ থেকে বের হলাম।
এবার কোথায় গন্তব্য ভাবছি, এমন সময় এক দেশি ভাই সালাম দিয়ে বললেন, আপনি কি তায়েফে প্রথম এসেছেন? বললাম হ্যাঁ, তিনি সিটি করপোরেশনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী। আরবি ভাষায় শহরের এক নাম বালাদ। মক্কা শহরকে কুরআন কারীমে ‘আল-বালাদুল আমীন’ বলা হয়েছে। এখানে নিরাপদ অর্থে আমীন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বালাদ উন্নয়নকারী সংস্থা ‘বালাদিয়্যা’ নামে আরব দেশে পরিচিত। বাঙালি ভাইয়েরা এই শব্দটি বিকৃত করে ‘বলদিয়্যা’ নাম দিয়েছেন। আমি সেই ভাইটির সাহায্য নিয়ে শহরটি ঘুরে ফিরে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সময়ের ব্যবধানে ওঁর নাম স্মরণ করতে পারছি না।
চলতে চলতে দূর থেকে একটা গোলাপী রঙের ভবন নযরে পড়ল, জিজ্ঞেস করলাম এত চকচকে এই বিল্ডিংটি কিসের? একজন বললেন, এখন তো সঊদী আরবের রাজধানী এখানে। হয়তো কোন মন্ত্রণালয়ের অফিস, দূর থেকে মনে হচ্ছিল দেয়ালে পানির স্রোত ঢেওয়ের মত গড়িয়ে পড়ছে। আসলে রোদের কিরণে মরিচিকার কারসাজি ছিল। কাছে গিয়ে দেখলাম দারুল ইফতার অফিস, ভাবলাম ঢুকে যদি গ্রা- মুফতি শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সাথে সাক্ষাৎ পাই, তবে জীবনটা ধন্য হবে।
তাই প্রহরির বাধায় দমে না গিয়ে বললাম, মক্কা ভার্সিটিতে পড়ি, দেশে ফিরার আগে শায়খকে একটু স্বচক্ষে দেখতে এসেছি। লোকটা আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকে অনেকক্ষণ পর এসে বললেন, এস এখানে অপেক্ষা করতে থাক, মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। প্রশস্ত এক হল রুমে প্রবেশ করলাম। বহু মানুষ আগে থেকেই বসে ছিলেন। বসার জন্য ঘরের মধ্যে চেয়ার টেবিল ছিল না তবে দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছু সোফা ছিল। ফাঁকা দেখে বসলাম। কেউ কারো সাথে কথা বলছিলেন না, প্রায় ঘুম ঘুম ভাব, সামনে আল-মদীনা দৈনিক পত্রিকা ছিল পড়তে থাকলাম।
এমন সময় একজন মধ্যবয়সী মানুষের কাঁধে হাত রেখে গ্রা- মুফতি হলে প্রবেশ করলেন। তিনিই সালাম উচ্চারণ করলেন, তাঁর জন্য নির্ধারিত সোফায় তিনি বসলেন, সিরিয়াল মেইন -টেইন করেই একে একে সবাই শায়খের সাথে মিলিত হবার সুযোগ পান। আমার পালা আসলে আমিও যাই, সালাম দিয়ে বসতেই তিনি বললেন, কী পড়? দেশ কোথায়?
তাঁর কথাগুলো খুব আস্তে ও ক্ষীন স্বরে ছিল, পাশে বসা একজন দোভাষী ছিলেন, তবে যেহেতু আমি শায়খের কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি এবং শায়খের ছোট ছোট প্রশ্নের জবাব আরবিতে দিতে পারছিলাম, দোভাষীর কোন ভূমিকা ছিল না। শায়খের নিকট আমার সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম, এমন সময় তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন এবং ধীরে ধীরে সেই হাত মুখম-ল হয়ে দাড়ি স্পর্শ করলেন, বুঝতে পারলাম তিনি আমার দাড়ির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সবশেষে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশে সঊদী রাষ্ট্রদূতের নাম কী? আমার জবাব শুনে মনে হল তিনি খুব খুশি হলেন, কারণ মুচকি হেসে বললেন, حتى اليوم هو فى بنغلاديش ‘আজও কি তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন?’
মুফতি সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম তার কয়েক মিনিট আগে সোফায় বসে বসে দৈনিক পত্রিকাগুলো দেখছিলাম, একটা শিরোনামের উপর আমার দৃষ্টি পড়েছিল, ‘বাংলাদেশে সঊদী রাষ্ট্রদূত ছুটি কাটাতে দেশে ফিরে জেদ্দায় জামাইর বাসায় অবস্থান করছেন’। পত্রিকা পড়ার সুফল পেলাম হাতে হাতে। ইতোমধ্যে তাঁর সেক্রেটারি দোভাষী আসলেন, গ্রা- মুফতি শায়খ ইবনু বায সেক্রেটারিকে কানে কানে কী যেন বলে দিলেন, তিনি আমাকে পাশের কামরায় ডেকে নিয়ে বললেন, শায়খ তোমার কথায় খুব খুশি। আমাকে বলেছেন, তুমি দোভাষী হিসাবে শায়খের অফিসে কাজ করতে আগ্রহী হলে একটা দরখাস্ত লিখ। এক্ষুণি তোমাকে নিয়োগ পত্র দেয়া হবে।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
প্রসঙ্গসমূহ »:
স্মৃতিচারণ