প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে
সুখ-দুঃখের সাতকাহন
(৩য় কিস্তি)
(৬)
গতকালের লেখা শেষ হয়েছিল দু’টি মা‘সূম শিশুর আহাজারি দিয়ে। তাদের মা তাদেরকে নিয়ে সঊদী আরব থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলেন। আমি নিজেও বাচ্চা মেয়ে দু’টির কোন খবর জানতে পারিনি, তবে এতটুকু শুনেছি যে বিধবা মহিলাটি নতুন এক সংসারের সদস্য হয়েছিলেন। লাইব্রেরীর আরেক কর্মচারী আব্দুল লতিফ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রাইভেট বাসায় ভাড়া থাকতেন। আব্দুল লতিফ সাহেব বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য অভিভাবক স্বরূপ ছিলেন। আমরা প্রায়ই বিকেলে তাঁর বাসায় আড্ডা দিতাম। কারণ তিনি বেশির ভাগ সময় পরিবার ছাড়াই থাকতেন। তাদের একমাত্র সন্তান পাভেলকে নিয়ে তার মা দেশে একটা সরকারি মহিলা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বড়সড় ছুটিতে তারা মক্কা মুকাররামায় মিলিত হতেন, সপরিবারেই থাকতেন।
যেহেতু তাঁর গাড়ি ছিল, তাই আমরা অবসর পেলেই এদিক সেদিক সফরে যেতাম। তাছাড়া প্রতিদিনই কোন না ওয়াক্তের ছালাত মাসজিদুল হারামে গিয়ে আদায় করতাম। ছালাত এবং ত্বাওয়াফ শেষে ৫/১০ লিটার যমযম সহ হোষ্টেলে ফিরতাম। দিনগুলো বড়ই সুখময় ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২/১৩ জন অধ্যাপকের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দু’জন অধ্যাপক ছিলেন বাংলাদেশী, তাঁরা পরস্পর আপন খালাতো ভাই ১. ড. সৈয়দ আলী আশরাফ, ২. ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। তাদের বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে তাদের খাট করতে চাই না, তবে শেষোক্ত ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন স্যারের কথা পরবর্তী সাতকাহন গুলোতে বহুবার নানা ভাবে ঘুরে ফিরে আসবে। কারণ তিনি ছিলেন আমার থিসিস -এর সম্মানিত Co-superviser.
এবার মা‘হাদ লুগাতিল আরাবিয়াতে ফিরে আসি, কারণ আমি এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। এখানে তিন বছর মেয়াদি ছয়টি সেমিষ্টার। প্রত্যেক সেমিষ্টারে ‘আলিফ’ ‘বা’ নামে দু’টি সেকশন ছিল। প্রতিটায় ৫০জন ছাত্র। প্রত্যেক ছাত্রের সাথে শিক্ষকদের যেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে সে লক্ষ্যেই পঞ্চাশ জনের গ্রুপ তৈরি করা হয়। সেমিষ্টারের শুরুতেই কোন্ শিক্ষক কী পড়াবেন, সে সম্পর্কে তাঁর সংকলিত বা রচিত একটি গ্রন্থ ছাত্রদের হাতে তুলে দেন শিক্ষক নিজেই। পঠিত/পঠিতব্য বিষয় সমূহের মধ্যে ছিল,
النصوص المقررة لمادة تفسير القران الكريم، النحو، الصرف، التاريخ الاسلامى، الثقافة، والحضارة، الاسلامية، الادب العربى شعرا ونثرا ،الفقه الاسلامى وهلم جرا
এই পরিচিত বিষয়গুলো এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে ছাত্রদের মধ্যে এ বিষয়ে অধীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ থাকা সত্ত্বেও অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। শিক্ষকদের সহানুভূতিশীল আচরণে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে যায়। এঁরা শুধু ক্লাসেই এমন আচরণ করেন তা নয়, পথে-ঘাটে, বাসে, মসজিদে, বাজারে সর্বত্রই দেখা হলেই পুরাতন বন্ধু বহুদিন পর দেখা ভাব নিয়ে হাসিমুখ ও নিরাহংকার মেজাজে কথা বলেন, তাকানোর মধ্যেই কেন যেন যাদু আছে মনে হয়। ছাত্ররা ভাবে এই মানুষটি আগামীকাল ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে লজ্জায় পড়তে হবে, অন্তত তাঁর বিষয়টি একটু পড়ে যাই, প্রস্তুতি নেই। মূলত সবাই প্রায়ই একই স্বভাবের।
ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া ফলপ্রসূ শিক্ষা দান অসম্ভব। আমি ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে আদর্শ শিক্ষক হওয়ার প্রেরণা পেয়েছি, এটা আমার জন্য এক চরম প্রাপ্তি।
এই সম্মানিত স্যারদের সবার বিস্তারিত তথ্য নেয়া হয়নি, তাদের আচরণ ও মুখের হাসি অন্তরের ক্যামেরা ধারণ করে রেখেছে। শুধু কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ বিষয়ে অভিব্যক্তি সমাপ্ত করব ইনশাআল্লাহ।
১. ড. আব্দুল মুন‘ঈম (মিসর) সূরা আন-নাবা পড়াতেন। আমার জীবনের সেরাদের সেরা শিক্ষক, একই আয়াত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে কথা বলতেন, শানে নুযূল, শব্দের বিশ্লেষণ, অলংকার শাস্ত্র ইত্যাদি আলোচনা করতেন মুখ দিয়ে, কিন্তু চেহারায় ফুটে উঠত তাক্বওয়ার ছাপ, পাণ্ডিত্য এবং আন্তরিকতা। একদিন তাফসীর পড়ানোর সময় সুপরিসর শ্রেণী কক্ষের দক্ষিণ দেয়ালের পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমাদেরকে বাহিরের দিকে তাকাতে বললেন, আমরা তাকিয়ে আছি, পুরাটাই মোটা স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল, ক্লাসে নীরবতা বিরাজ করছে, দেখলাম তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন, কিছুক্ষণ পর তিনি জানালার দিকে তাকিয়েই বললেন, কে কী দেখছ বলতো? মরুভূমির বুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে সবুজের সমারোহ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। আমরা প্রায় সবাই নানাভাবে এসব বর্ণনা দিয়ে আমরা সবাই ফুল মার্কস আশা করছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, তোমরা এ মুহূর্তে তাফসীর পড়ছ, এমন স্থানে বসে আছ যেখান থেকে গারে হেরা দেখা যাচ্ছে, প্রথম অহীর অবতরণস্থল তো এই পাহাড়ের চূড়ার উপরেই, দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে তোমরা সেই বর্ণনায় ব্যস্ত, অথচ তোমরা তাফসীর পড়ছ! আফসোস! এ ঘটনা থেকে কে কতটুকু শিখবেন জানি না তবে, আল্লাহভীতি ও নিষ্ঠা বা ইখলাছ ছাড়া দ্বীনের ইলম অর্জন হয় না, সনদ অর্জন হতে পারে।
--- 0 ---
(৭)
গতকালের লেখায় তাফসীর ক্লাসের মুহতারাম উসতায শায়খ ড. আব্দুল মুন‘ঈম-এর পাঠদান বিষয়ে স্মৃতিচারণ করছিলাম, শব্দ বাক্য ব্যবহার করে আমার অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন, তবুও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি। একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী সবটা তুলে ধরার শক্তি আমার নেই, এ কথা জেনেও শুধু প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। আমার ছাত্র-ছাত্রী ও শিষ্য ভক্তরা যেন দু‘আ করার সময় আল্লাহর দরবারে আমার ও আমার শিক্ষক সবার জন্য নাজাতের ফরিয়াদ ও মাগফিরাত কামনা করে। তিনি মাঝারি বয়সের মানুষ ছিলেন। কোন দিন নিজের জীবনের গল্প শোনাননি। আন্তর্জাতিক মানের একজন স্কলার হয়েও আত্ম-প্রচার বিমুখ ব্যক্তি ছিলেন। ক্লাশ শেষে পকেটে হাত দিয়ে একটি মাত্র রিয়াল বের করে সবাইকে দেখিয়ে প্রশ্ন করতেন, من يستحق منكم هذا؟ ‘আজকের ক্লাশে তোমাদের পারফরমেন্স বিবেচনায় কে এই রিয়ালের হক্বদার?
অধিকাংশ ছাত্রদের মতামতের ভিত্তিতেই তিনি রিয়ালটি একজনের হাতে তুলে দিতেন, ছাত্রকে কাছে ডেকে দিতেন না, তিনিই নিজে গিয়েই সেই ছাত্রের হাতে দিয়ে আসতেন। মাস শেষে যখন দেখলেন, রিয়াল একজন ছাত্রের পকেটেই যাচ্ছে, তখন তিনি বলতেন, ওমুক বাদে বাকিরা আমার প্রশ্নের জবাব দিবে। ছাত্রদের প্রতিযোগিতামুখি করার কী অভিনব পন্থা! শিক্ষকের একটি রিয়াল এন‘আম হিসাবে পাওয়া যেন দুনিয়া জয় করার আনন্দ! ভুক্তভোগী ছাড়া এ আনন্দ অন্যরা পাবে না। আগেই উল্লেখ করেছি তিনি আমাদের পড়াতেন সূরা আন-নাবা, মাত্র ৪০ আয়াত বিশিষ্ট এই সূরাটি তিনি ছয় মাস ধরে পড়িয়েছিলেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাশ হত, দু’দিন ছুটি, ক্লাসে সব সময় তিনি ‘হোম ওয়ার্ক’-এর জন্য নির্দেশনা দিতেন। এর আরবি পরিভাষা ব্যবহার করতেন, عمل الصنع। যে কোন কাজই ‘আমল’ কিন্তু বিশেষ আমল হল সান্‘আ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ ‘তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন’ (সূরা আল-আনকাবূত : ৪৫)। আল্লাহ ইরশাদ করেন, صُنۡعَ اللّٰہِ الَّذِیۡۤ اَتۡقَنَ کُلَّ شَیۡءٍ ‘এটা আল্লাহরই সৃষ্টি-নৈপুণ্য, যিনি সবকিছুকে করেছেন সুষম’ (সূরা আন-নামল : ৮৮)।
প্রত্যেকের হোম ওয়ার্ক এর বিষয় ভিন্ন ভিন্ন থাকত, যেন কেউ কারো পরিশ্রম বাগিয়ে নিতে না পারে।
মাক্কী সূরা সমূহের অন্যতম একটি সূরা, সূরা আন-নাবা। এই সূরাটি মক্কা যাওয়ার আগে কতবার নিজে পড়েছি, ছাত্রদের পড়িয়েছি, মসজিদে দরসে আলোচনা করেছি, কারণ ঢাকা আলিয়ায় ছাত্রাবস্থায় (১৯৬৯ সালে) চকবাজারের মৌলভী বাজার মসজিদে মুফতি দীন মোহাম্মদ সাহেবের তাফসীর ক্লাসের একজন ছাত্র হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
তিনি সর্ট-কোর্স ও লং-কোর্স নামে তাফসীরের দু’টো কোর্স আজীবন চালিয়ে গিয়েছেন। রামাযান মাসে এক খতম এবং শাওয়াল থেকে শা‘বান পর্যন্ত এক খতম, (জাযাহুল্লাহ খয়রান)। এজন্য তিনি অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে মাসে তিরিশ টাকা বৃত্তি দিতেন। ভর্তি ফরম এর মূল্য ছিল ‘এক টাকা’। এই এক টাকা নগদ না দিলে বাকিতে ফরম দেয়া হত না। ভর্তির জন্য যোগ্যতা ছিল ফাযিল অথবা দাওরা পাশ। সিট সংখ্যা ৩০টি। উল্লেখ্য যে, মুফতি দীন মোহাম্মদ সাহেব রামাযানে ক্লাশ শুরু করতেন সকাল আটটায় এবং শেষ হত ইফতারের একঘণ্টা আগে, ছালাত আদায়ের জন্য ১০/১৫ মিনিট বিরতি থাকত। আমি আসতাম খোলা মুড়া গুদারার পশ্চিম পাশের পাড়াটি থেকে। উল্লেখ্য যে, সোয়ারিঘাট থেকে খোলামুড়া যেতে ডিঙ্গি নৌকায় একঘণ্টা ময় লাগত, ভাড়া এক টাকা, আনুমানিক পাঁচ মাইল। (এ বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে কিছু লিখার ইচ্ছা রইল।)
কুরআন কারীমের এই একটি সূরাতেই এত কিছু রয়েছে! মক্কা আসার আগে কখনো এভাবে ভাবার সুযোগ পাইনি! এর প্রথম শব্দটি, عم يتساءلون
সারা দুনিয়ার মানুষ পরস্পর একে অন্যকে কী বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? এই প্রশ্নের জবাবই সূরা আন-নাবার বিষয়-বস্তু। এই সূরাটিতে আসমান-যমীন এবং এ দু’ইয়ের মাঝে দৃশ্যমান, অদৃশ্য অনেক কিছুর উল্লেখ আছে। যমীন কেন সৃষ্টি করা হয়েছে, পাহাড়-পর্বত কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? সূর্য কেন, এর কাজ কী? তোমাদের ঘুম কী এবং কেন এমন অসংখ্য পার্থিব ও পারলৌকিক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। বিজ্ঞান এ পর্যন্ত যা কিছু আবিষ্কার করেছে তা এই সূরায় বর্ণিত বিষয়বস্তুর কানা-কড়িও আবিষ্কার করতে পারেনি, বরং অক্ষমই রয়েছে। শুধু কিতাব পড়েই পণ্ডিত হওয়া যায় না, উপযুক্ত শিক্ষকের ভূমিকা-ই মুখ্য। ড. আব্দুল মুন‘ঈম স্যারের কাছে এ কথাটিই শিখেছি।
--- 0 --
(৮)
স্যারদের স্মৃতিতিচারণে সংক্ষেপী-করণ নীতিমালা অনুসৃত হয় না, তবুও আমাকে তা করতে হচ্ছে। ড. আব্দুল মুন‘ঈম স্যারের সাথে আমার স্মৃতির পাহাড় রয়েছে। মাত্র পাঁচ ছয় মাস পর তিনি আমাকে উচ্চ-শিক্ষা ভবনের বারান্দায় ঘোরা ফেরা করতে দেখে মা‘হাদ লুগাতিল আরাবিয়া ভবন থেকে একদিন হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন, তাই আমি তাঁর কক্ষে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তোমার পরিচিতদের নিকট থেকে আমি তোমার কাহিনী শুনেছি, আল্লাহ তোমাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিন এ দু‘আই করি।
এরপর বাসে, পথে ঘাটে যখনই সাক্ষাৎ হয়েছে, আগে সালাম দেয়া সম্ভব হয়নি, তিনিই আগে সালাম দিয়েছেন, সব সময়ই ‘আল-উসতায’, ‘আল মুহতরাম’, বলেই সম্বোধন করেছেন, মিসরের ঠিকানা দিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আল্লাহ তাঁকে ইহ-পরকালে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন দান করুন- আমীন!!
২. ড. ‘উছমান; সীরাহ নাবাবিয়ার উসতায, তিনিও সেমিষ্টারের শুরুতেই ছাত্রদের হাতে তাঁর নিজের সংকলন মুকাদ্দামতুস সীরাহ শিরোনামের ‘মুযাক্কেরা’টি উপহার দিয়েছিলেন। তবে ক্লাস কালীন তাঁর হাতে কখনো কোনো বই পুস্তক দেখিনি। তিনি অধ্যাপনা করতেন না অভিনয় করতেন বলা মুশকিল। তাঁকে কখনো দেখেছি রোম সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে জা‘ফর ইবন আবি তালিব এর ভূমিকায়, গুরু গম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করতে
ايها الملك! كنا قوما اهل جاهلية نعبد الأصنام وناكل الميتة ونأتى الفواحش..
‘হে মহামান্য বাদশাহ! আমরা ছিলাম এক অজ্ঞ ও মুর্খ জাতি, পুতুল পূজা করতাম, মৃত জন্তু খেতাম, অশ্লীলতায় আছন্ন থাকতাম, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীর সাথে দুর্ব্যবহার করতাম, আমাদের শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর হামলিয়ে পড়ত, তাদের মান-সম্মান সহায়-সম্বল ভূলুন্ঠিত করা গর্বের বিষয় ভাবতাম’..... এভাবে তিনি জাহেলী যুগের অপরাধ জগতের সঠিক চিত্র তুলে ধরে শেষে বললেন,
فكنا على ذلك حتى بعث الله الينا رسولا نعرف نسبه وصدقه وامانته وعفافه....
‘এমন অসহনীয় পরিস্থিতিতে আল্লাহ আমাদের মাঝে এমন একজন রাসূল (ﷺ) পাঠালেন, আমরা তাঁর বংশ পরিচয় জানতাম, জানতাম তাঁর সত্যবাদিতা, আমানতদারি এবং সর্বোপরি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিষ্কলুষ ও নির্মল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে’।
উসতায ‘উছমান হঠাৎ রোম সম্রাট নাজ্জাশীর দরবার থেকে মক্কায় ফিরে আবূ তালিব এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভাতিজা মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সাথে মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনাট্য রমণী খাদীজাতুল কুবরার বিয়েতে খুতবা পড়ছেন,
الحمد لله الذى جعلنا من ذرية ابراهيم وزرع إسماعيل...........ثم إن محمد بن عبد الله من لا يوزن به فتى من قريش الا رجح عليه برا وفضلا وكرما وعقلا وان كان فى المال قل فإن المال ظل زائل...وله فى خديجة بنت خويلد رغبة ولها فيه مثل ذلك وما احببتم من الصداق فعلي.
‘আল্লাহর সব প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশে ও ইসমাঈলের নসল হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আমাদেরকে একটা নিরাপদ শহর দান করেছেন, ইবাদতের জন্য দুর্ভেদ্য একটি ঘর দান করেছেন, আমাদেরকে সাধারণ মানুষের খিদমত করার নিমিত্তে নেতৃত্ব দান করেছেন, অতঃপর আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ﷺ) যার সাথে কুরাইশী কোন যুবকের তুলনা হয় না, তরুণদের সেরা আমার এই ভাতিজা জ্ঞান, বুদ্ধি, সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে সেরাদের সেরা, তবে অর্থ সম্পদ তার সামান্য, আর সম্পদ সমৃদ্ধি তো ছায়ার মতই অস্থিতিশীল। উল্লেখ্য যে, খাদীজাকে স্ত্রী হিসাবে পেতে মুহাম্মাদ (ﷺ) আগ্রহী, খাদীজাও তদ্রুপ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে পেতে আগ্রহীণা, আপনারা মোহর হিসাবে যা পসন্দ করেন তা আমিই পরিশোধ করব।
--- 0 ---
(৯)
আল্লাহর স্মরণ চাচ্ছি, যেন আমি সুদূর অতীত রোমন্থন ও স্মৃতিচারণে অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হই, অবিল্লাহিত্ তাওফীক্ব। উম্মুল ক্বুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মা‘হাদু ল্লুগাহর সীরাহ নাবাবিয়্যার স্বনামধন্য শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় উসতায মুহতারাম ‘উছমান এখনও জীবিত কি না জানি না, তবে তাঁর শিক্ষা দানের অভিনব কৌশল, আন্তরিকতা, বৃদ্ধ বয়েসেও এমন প্রাণ-চাঞ্চল্যতায় আমি মুগ্ধ ও উজ্জীবিত হয়েছিলাম, মাত্র ছয় মাসের প্রাপ্তিতে আমি তৃপ্ত ছিলাম। তাঁর একদিনের এক অতি মাশহুর ঘটনার আলোচনায় তিনি বর্ণনা করছিলেন তা আজও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তিনি অভিনয়ের ভঙ্গিতে বর্ণনা করলেন,
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুওত ও রিসালাত লাভের বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা, ছেলে ধরা চক্রের কবলে পড়ে এক ইয়ামানি শিশু যায়দ বিন হারেছা, মক্কার নাক্কাসা বাজারে আনীত হয় এবং নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি হয়, মক্কার অভিজাত পরিবারের ধনাট্য রমণী খাদীজাতুল কুবরার গৃহে শিশু দাস হিসাবে তার জীবন শুরু হয়। এমতাবস্থায় খাদীজার সাথে যখন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শাদী হয়, এ সময় পাত্রি পক্ষ জামাতা মুহাম্মাদকে উপঢৌকন স্বরূপ শিশু যায়দকে উপহার দেন। এই শিশুর সাথে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আচরণ ছিল অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসা ও আদর যত্নের এক মূর্তমান ছবি।
হজ্জ সফরে আসা ইয়ামানি কয়েকজন হাজী সাহেবানের নযরে পড়ে এই শিশুটি, তারা তাকে চিনে ফেলে এবং কথা বলে নিশ্চিত হন এই সেই হারিয়ে যাওয়া শিশু যায়দ বিন হারেছা। হাজীগণ হজ্জ শেষে দেশে ফিরে ঘটনা বর্ণনা করলে যায়েদের বাবা এবং মামা ছেলে কে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মক্কায় আসেন, ঠিকানা অনুযায়ী তাঁরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বাসায় আসেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বলেন, আমাদের হারানো সন্তানকে ফিরিয়ে দেন, আমরা শুধু এ উদ্দেশ্যেই এসেছি, সবকিছু শুনে মুহাম্মাদ (ﷺ) বললেন,
আপনাদের সন্তান আপনাদের কাছে ফিরে যাবে এজন্য টাকা দিচ্ছেন কেন? সে যদি আপনাদের সাথে ফিরে যায়, এ তো আনন্দের কথা। যায়েদকে ডাকা হল, মুহাম্মাদ (ﷺ) বললেন, তুমি কি এদের চিনতে পারছ? যায়দ বলল, হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা, আরেকজন আমার মামা।
এবার যায়েদের বাবা দু’হাত বাড়িয়ে হারানো সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরল, প্রচুর অশ্রু ঝরল, অনেক সময় নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। এরপর বাবা বললেন, তোমার মা তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে দুর্বল হয়ে পড়েছে, চল বাড়ি ফিরে যাই! এবার যায়েদের মুখে তার শিশু সুলভ অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল,
والله لن اعود يا والدى! فأنى وجدت خير أب وخير خال
‘বাবা! আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কখনই তোমাদের সঙ্গে ফিরব না, কারণ আমি পৃথিবীর সেরা বাবা এবং শ্রেষ্ঠ মামা পেয়েছি, আমি তাঁকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না, তোমরা ফিরে যাও’।
রহমাতুল্লিল আ‘লামীনের মায়াবী মায়ার পরশে সিক্ত যায়েদের মুখে যাদু-মাখা বক্তব্য শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে মুহাম্মাদ (ﷺ) বেরিয়ে পড়লেন। সোজা বায়তুল্লাহর সামনে আসলেন এবং উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা দিলেন, اشهدوا يا معشر قريش هذا زيد ابنى يرثنى وانا ارثه ‘হে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ! তোমরা সাক্ষি থাক, আজ থেকে যায়দ আমার পুত্র, আমার সম্পদ সে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হবে এবং আমিও তার সম্পত্তিতে অংশ পাব’।
যায়েদের পিতা এবং মামা এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক। তারাও আনন্দ অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়ে বলতে থাকলেন, বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধায়ক মুত্তালিবের পৌত্র কুরাইশী যুবক আল-আমীন। তাঁর সন্তানের মর্যাদা পাওয়া যায়দের জন্য আমাদের আর কোনো সংশয় রইল না, আমরা এখন গর্বিত এবং আনন্দিত।
--- 0 ---
(১০)
মুহতারাম উসতায ‘উছমান সাহেবের প্রাণবন্ত আলোচনার মধ্যে আরও একটি চমকপ্রদ আলোচনা এখনও আমার স্মৃতিতে ভাসছে। তাহল- কুফ্ফার মুশরিকদের নানাবিধ অপপ্রচার স্বত্ত্বেও ইসলাম প্রচার বন্ধ না হয়ে বরং দিন দিন যখন ছড়িয়ে পড়তে লাগল, এবার তারা আরো এক অভিনব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে এক ফন্দি আঁটল। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, ভালো মানের একজন কবিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মুহাম্মদ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে ইসলাম প্রচার আটকাবে। যেমন সিদ্ধান্ত তেমনি বাস্তবায়ন শুরু। আরবের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক হাসসান বিন ছাবেতের হাতে স্বর্ণ মুদ্রার একটি থলে দিয়ে তারা অনুরোধ জানিয়ে বলল, এই পথেই মুহাম্মাদ (ﷺ) আসা যাওয়া করে, এখন সে বায়তুল্লাহয় অবস্থান করছে, বাড়ি ফেরার সময়ও হয়েছে, তার বাড়িও হারাম এর মাঝে অবস্থিত আবূ জাহলের বাড়ি, তার দক্ষিণে আবূ কোবেস পর্বতের পাদদেশ দিয়েই পায়ে চলা পথ, এখানে এক উঁচু চওড়া পাথরের উপর দাঁড়িয়েই তুমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে শুনিয়ে শুনিয়ে দারাজ গলায় তাঁর নামে কুৎসা গাইবে।
জনগণ কুৎসাপূর্ণ কবিতার টানে তোমার কাছে ভিড় করবে, আর এভাবেই তাঁর মিশন ব্যর্থ হবে। টাকার লোভ সামলাতে ব্যর্থ হয়েই কবি হাসসান রাজি হন, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, মনে মনে ভাবেন আমি তো তাঁকে চিনি না! কত মানুষ আসে আর চলে যায়। অবশেষে দেখেন সাফা পর্বতের দিক থেকে একটা মানুষ আসছেন, সন্ধ্যাবেলার আলো আঁধারের সময় পূর্ব দিগন্তে পূর্ণিমার চাঁদের উদয়কালে যেমনটি হয়। তাঁর মুখমণ্ডলে কোন প্রকার দাগ নেই, যেখানে যা মানানসই তাই-ই আছে, সঠিক মাপের উপর এক বিন্দু বেশি বা কম নয়। এত সুন্দর নিখুঁত মডেল হাস্সান ইতোপূর্বে কখনই দেখেননি, তাই কবি স্বভাব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন,
واحسن منك لم تر قط عينى . واجمل منك لم تلد النساء
خلقت مبرء من كل عيب . كانك قد خلقت كما تشاء
আমার চোখ এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য, ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। এত সুদর্শন সন্তান, কোন রমণী কখনো প্রসবও করেনি।
সব ধরনের ত্রুটি মুক্ত করেই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেন আপনি যেমনটি কামনা করেছেন সে ভাবেই আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
হাস্সানের মুখে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শানে সর্বকালের সেরা প্রশংসা শুনে কাফিররা হায়! হায়! শুরু করে দিল। হাস্সান তাদের দেয়া স্বর্ণ মুদ্রার থলেটি ঘৃণা ভরে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘উদিত সূর্যের বিরুদ্ধে কিছু বলে এর দীপ্তি নেভানো অসম্ভব এবং কেবলই অসম্ভব’। খ্যাতিমান কবির দু’ লাইনের কবিতার ফলে বিশ্বনবীর খ্যাতি জনসাধারণের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। পক্ষান্তরে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য এটা বুমেরাং হয়ে তাদের মুখেই যেন চুনকালি লেপন করা হল। উল্লেখ্য যে কবি হাস্সান বিন ছাবেতের আয়ুকাল ছিল ১২০ বছর, এর মধ্যে ৬০ বছর ইসলাম পূর্ব যামানায়। ইসলাম গ্রহণের পর অবশিষ্ট ৬০ বছর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর খিদমত করেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সভাকবি ও শায়ের। তিনি (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, لسانى صارم ‘জিহ্বাই আমার তীক্ষ্ম তরবারি’।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
প্রসঙ্গসমূহ »:
স্মৃতিচারণ