শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৯ অপরাহ্ন

প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যারের টাইমলাইন থেকে

সুখ-দুঃখের সাতকাহন 


(৭ম কিস্তি)

(১৯)

১৯৮৩ সাল, ইংরেজি কোন মাস ছিল মনে পড়ছে না। ইন্ডিয়ার ভিসা সংগ্রহ করতে জেদ্দাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে গেলাম। অল্প সময়েই তারা ভিসা দিলেন এবং মজার ব্যাপার হল ভিসায় ফ্রেন্ডশীপ লেখা সীল মেরে কোন টাকা-পয়সা  নেননি। গ্রাটিস ভিসা পেলাম। ভারতের সাথে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের এরকমই সুসম্পর্ক বিরাজমান ছিল।

উযাইর শামস সহ আমি সঊদী এয়ার লাইন্স-এর বিমানে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম এবং জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি মধ্যম মানের আবাসিক হোটেলে উঠলাম। বিকেলে আশে-পাশেই ঘুরতে গেলাম। পায়ে হাঁটা দূরত্বে একটা মসজিদ ও মাদরাসা দেখে ভেতরে ঢুকে আছরের ছালাত আদা করে ইমাম সাহেবের সাথে আলাপের পর জানলাম, এটাই এক কালের বিশ্ব বিখ্যাত রাহমানীয়া মাদরাসার বর্তমান রূপ। খুবই স্তম্ভিত ও মর্মাহত হলাম! দেশের প্রথম সারির আলেম বলতে রাহমানী আলেমগণকে বুঝতাম। যেমন, সা‘দ ওক্কাস রাহমানী, হাবিবুল্লাহ খান রাহমানী, ড. আফতাব আহমাদ রহমানী, মুনতাসির আহমাদ রহমানী, আহমাদুল্লাহ রাহমানী প্রমুখ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমাম সাহেবের প্রচেষ্টায় আমরা সেই রাহমানিয়া মাদরাসার সেক্রেটারি মহোদয়ের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেলাম। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ মূহুর্তে তাঁর নাম স্মরণ করতে পারছি না। তিনি যখন শুনলেন আমরা সঊদী আরবের গবেষক, আমাদের তিনি রাতের খাবারের দাওয়াত দিলেন এবং মাদরাসার ইতিহাস ও বর্তমান  অবস্থায় আসার কারণ ব্যাখ্যা করবেন বলে জানালেন। বৈকালিক নাস্তার জন্য নিকটবর্তী একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। আমাদেরও দূরে কোন কর্মসূচি ছিল না, তাই আমরাও তাঁর সঙ্গে আড্ডায় সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রেস্টুরেন্টটি ছিল মূলত অভিজাত একটি মিষ্টি-মহল। টেবিলে বসেই মিষ্টির অর্ডার দিলেন। একটা বয় এসে জানতে চাইল, কোন মিষ্টি কি পরিমান? আমিই উর্দুতে বললাম, এহাঁও কোন্ সা লাড্ডু  মিলতা হ্যায়? যো খায়া, পশতায়া, যো না খায়া ওভি পশতায়া?

আমার কথা শুনে, আর বিদেশি মনে করে উপস্থিত সবাই হাসা-হাসি করলেন। এরপর  ‘হাফ-মন’ সাইজের তিনটি মিষ্টি তিন পেল্টে করে টেবিলে পৌঁছে গেল। দেখেই বুঝতে পারলাম, এর বিভিন্ন লিয়ারে নানা রঙের মধু মাখা রসে ভরপুর। অর্ধ চন্দ্র মিষ্টি, পুরোটা খেলে রাতের খাবারের আর প্রয়োজন হবে না, তবুও এসব খেলাম, আলহামদুলিল্লাহ।

আবার রাহমানিয়া মাদরাসায় ফিরে আসলাম। এশার পর সেক্রেটারি সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। উল্লেখ্য যে, মাদরাসার অধ্যক্ষ ও জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আতাউর রহমান যিনি আব্দুল মাতিন সালাফী সাহেবের শ্বশুর, তিনিও দাওয়াতে আমাদের সঙ্গী ছিলেন।

হোটেল পৌঁছে উযাইরকে বললাম, আগামীকাল কোথায় গন্তব্য? ও বলল, আমার তো সব দেখা, আমি শুধু গাইড হিসাবে থাকব। আপনি যেখানে যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব। পরদিন সকালে আলীগড় রওয়ানা হলাম।

উল্লেখ্য যে, উযাইর আমার সহপাঠী হলেও আমার চেয়ে সে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট। আমি ঢাবি থেকে ১৯৭২ সালে মাষ্টার্স, আর ও ১৯৭৯ সালে ইবি মদীনা মুনাওয়ারা থেকে অনার্স। যাই হোক তার ইলমী দক্ষতা সমকালীন কারও সাথে তুলনা করা যায় না। আল্লাহ প্রদত্ত মেধাবী ছাত্র। তার মুখে আবূ তাম্মামের একটি লাইন শুনে আমি অধিক মনোযোগী হতে প্রেরণা লাভ করলাম। কবিতার লাইনটি হল,

ويصعد حتى يظن الورى - بأن له حاجة فى السماء

মর্মার্থ : ‘সে এমন গতিতে ও অভিনব ভঙ্গিতে উপর দিকে উঠে গেল যে পেছনের লোকেরা মনে করল, ওর বুঝি আকাশে কোন কাজ রয়েছে’।

আলীগড় একটা পল্লি অঞ্চল, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এখানে কোন শিল্প- কারখানা গড়ে উঠেনি। সবুজে ঘেরা নানা রঙের ও জাতের ফুল বাগানের মধ্যে আলীগড়  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহ। বেশ কয়েকটি হল। বিশাল লাইব্রেরীর নয়তলা ভবন। নাম, আবুল কালাম আজাদ লাইব্রেরী। সম্ভবত এটি একটি নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন লাইব্রেরী। যা ২৪ ঘন্টা পাঠকের জন্য খোলা থাকে। কর্মচারীগণ তিন শিফটে আট ঘণ্টা পর পর কাজে যোগদান করে থাকেন। প্রত্যেক ফ্লোরে হাজারের অধিক ছাত্র-ছাত্রী লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনা করতে পারেন। হল বা ছাত্রাবাসসমূহ কেবল ঘুম, গোসল ইত্যাদির জন্যই। প্রত্যেক হলে প্রসস্থ ডাইনিং হল রয়েছে। আমরা এস এস হলের ডাইনিং-এ গেষ্ট হিসাবে খাওয়া এবং একটি রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রদেরই শেরওয়ানি পরিধান করে ইউনিভার্সিটির একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখেছি। কারণ এটি ছিল ছাত্রদের নির্ধারিত ইউনিফর্ম।

আমরা আলীগড় ছেড়ে চলে আসার আগে আলীগড়ের শেরওয়ানী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এম হাসান-এ গেলাম। তিনি কাপড় হাতে নিয়ে বললেন, ছয় মাস সময় লাগবে। সাধারণত আমরা এক বছর সময় নিই। আপনার জন্য ছয় মাস। আমি সঊদী আরবের ঠিকানায় পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চলে আসলাম। তবে দু-তিন মাস পর শেরওয়ানী পেয়ে যায়। অতিরিক্ত দু’ টুকরো কাপড়ও তিনি ফেরত পাঠিয়েছিলেন যা দিয়ে বাচ্চাদের দু’টি প্যান্ট হয়েছিল।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাল ছিল ১৯২০ এর আগে। এখানে ১৮৭৫ সালে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম ছিল,

 গড়যধসবফধহ অহমষড় ঙৎরবহঃধষ ঈড়ষষবমব. আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল ১৮০০০। এখানে তিন শতাধিক কোর্স পড়ানো হয়। ২৫০ জন গবেষক পি-এইচ.ডি পর্যায়ে গবেষণা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম,

আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম

Taught man what he knwe not

(Quran Surah : 96 : 5)

স্যার সৈয়দ আহমাদ খান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১১৫৫ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিভার্সিটির সংক্ষিপ্ত নাম অগট। এখানের হলসমূহে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তাবলীগ জামাতের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। আমি প্রথমে গিয়েছিলাম আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। ঢাবির আবূ বকর সিদ্দিক সাহেব তখন ঐ  বিশ্ববিদ্যালয়ের পি-এইচ.ডি গবেষক ছিলেন। তবে তিনি সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। কোন কাজে দিল্লি গিয়েছিলেন। তাঁর মিসেস ছিলেন দেখাও হয়েছিল। সারা দিন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পরদিন সকালের ট্রেনে দিল্লি ফিরে আসলাম।

পরদিন ছিল শুক্রবার। দিল্লি জামে মসজিদে ছালাতুল জুমু‘আ আদায়ের লক্ষ্যে আগে ভাগেই মসজিদে পৌঁছে গেলাম। চাঁদনী চক এলাকায় একটা ছোট টিলা সাইজের পাহাড়ের উপর নির্মিত এই মসজিদটি দেখার সুযোগ হয়েছে ভাবতেও বিস্ময় লাগে। মসজিদের কাঠামো পাহাড়টিকে ঢেকে দিয়েছে।

দিল্লি জামে মসজিদ

সম্রাট শাহজাহান আগ্রার তাজমহল নির্মানের জন্য ধর্মভীরু শ্রেনীর কিছু মানুষের সমালোচনা লক্ষ্য করেন। তিনি দিল্লির অভিজাত এলাকায় নতুন করে রাজধানীর জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তাঁর অফিস থেকে মাত্র পশ্চিম দিকে এক হাজার গজের দূরত্বে একটি সুরম্য মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আইকনিক অঞ্চলে উর্দু রোড সংলগ্ন এলাকায় মুগল আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ। ৬ অক্টোবর ১৬৫০ খৃষ্টাব্দে শুরু করে ১৬৫৬ খৃষ্টাব্দ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। লাল মার্বেল পাথরের তৈরি এই মসজিদে এক সাথে পঁচিশ হাজার মুছল্লি ছালাত আদায় করতে পারবেন। এর দৈর্ঘ্য চল্লিশ মিটার (১৩০ ফুট), প্রস্থ ২৭ মিটার ৮৯ ফুট, গুম্বুজ তিনটি, বড় বড় দু’টি মিনার এবং প্রশস্থ সাহন বা চত্তর। মসজিদে প্রবেশের জন্য তিন দিকে তিনটি সিঁড়ি শতশত মুছল্লির একসাথে উঠার জন্য এই সব সিঁড়ি পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশের জন্য। পশ্চিম দেয়ালে মোট সাতটি মিহরাব। মাঝেরটি ইমাম সাহেবের মুছাল্লা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মসজিদটির প্রথম খতীব ছিলেন সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ্ বুখারী। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই শাহী মসজিদের মুতাওল্লী ছিলেন মুঘল সম্রাটগণ।

এই মসজিদটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল এক মিলিয়ন রুপি। পক্ষান্তরে তাজ মহল নির্মাণ ব্যয় ছিল বত্রিশ মিলিয়ন রুপি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সত্তর বিলিয়ন রুপির সমান। ইংরেজ আমলেও এই মসজিদটি ইসলামী ঐতিহ্য ও শক্তির প্রতীক ছিল। কালের বিবর্তনে ‌এলাকাটি পুরাতন দিল্লির ব্যস্ততম এলাকা এখন। এরপরে আরো একাধিক বার এই মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করেছি। কিন্তু প্রথমবারের অনুভুতির মত আর শিহরণ জাগেনি।

(২০)

রাহমানিয়া মাদরাসার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

বিগত সাতকাহন-১৯ এর কমেন্ট পড়ে বুঝলাম, পাঠকদের অনেকেই রাহমানিয়া মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও তা এখন বিলুপ্ত কেন? বিষয়সমূহ জানতে চান। এ বিষয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যা কিছু পেলাম এবং হিন্দুস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের অফিস থেকে প্রাপ্ত পূরাতন কিছু মূল্যবান ম্যাগাজিন দেখলাম। মাদরাসা দারুল হাদীস রাহমানিয়ার মুখতাসার তারিখ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেলাম। আমি যেন আকাশের ধ্রুব তারা হাতে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করতে লাগলাম। পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে আপ্রান চেষ্টা করব, অবিল্লাহিত তাওফীক্ব।

শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান নামের এক বিত্তবান দানবীর আলেম ভারতীয় উপমহাদেশে একদল দক্ষ, অভিজ্ঞ ও চরিত্রবান আলেম তৈরির লক্ষ্যে একটি উন্নত মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, এর নামকরণ করা হয় ‘মাদরাসা দারুল হাদীস আর রাহমানিয়া’। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং প্রধান প্রশাসক ছিলেন। ১৯২১ সালে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর তিনি প্রতিদিন বিকেলে ছাত্রদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মাঠে নিয়ে যেতেন। হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করতেন ও রাতের খাবার নিজে চেক করতেন। প্রতি শুক্রবার শিক্ষকদের নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে পড়ার মানোন্নয়নে পরামর্শ করতেন এবং তাদের উন্নত মানের খাবার খাওয়াতেন। ছাত্রদের তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন, ফজর ছালাত আদায়ের জন্য অতি প্রত্যুষে নিজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের ঘুম থেকে জাগাতেন। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি ইন্তিকাল করেন।

এরপর মাদরাসার প্রশাসন ও শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠাতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাজী আতাউর রহমান। তিনি নিজে আলেম ছিলেন না, তবে প্রকৃত অর্থেই আলেম-ওলামার বন্ধু ছিলেন। তিনিও আগের মতোই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে মাদরাসা পরিচালনা করতেন। এখানে প্রধান মুহাদ্দিস ছিলেন মুহাম্মদ ইবরাহীম সিয়ালকোটি, আহমাদুল্লাহ প্রতাপগড়ী। শিক্ষাদান ও পরীক্ষা প্রধান ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হাফেজ আব্দুল্লাহ রোপড়ি, মাদরাসার উন্নয়ন ও বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন রোপড়ি পরিবারের সদস্যবৃন্দ।

এখানে ছাত্রদের হাতে কলমে শিক্ষা দানের লক্ষ্যে লেখার উপর জোর দেয়া হত। শিক্ষণ- প্রশিক্ষণ ও হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা থাকত এবং সৃজনশীল লেখক সৃষ্টির নিমিত্তে দেয়ালিকা প্রকাশ করা হত। এমনকি ছাত্রদের গবেষণা কাজে অভ্যস্ত করতে গবেষণা-ধর্মী একটি মাসিক পত্রিকা ‘মুহাদ্দিছ’ বের করা হয় ১৯৩৩ খৃ.। পত্রিকাটির প্রথম আতœপ্রকাশ থেকে দেশ ভাগের দিন পর্যন্ত চালু ছিল।

মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এবং অধিকাংশ আসাতিযায়ে কেরাম পাকিস্তানের লাহোর শহরে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ লাহোর, কেউ করাচী। দেশ ভাগের পর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নানা কারণে মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। সর্বমোট ২৭ বছর টিকে ছিল মাদরাসা। এই অল্প সময়ে অগণিত দক্ষ ও অভিজ্ঞ আলেম তৈরি হয়ে উপমহাদেশের বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং তাদের হাতে অসংখ্য দক্ষ আলেম তৈরি হন।

আফতাব আহমদ রহমানী স্যার ছহীহ বুখারীর ভাষ্য-গ্রন্থ ফৎহুল বারীর রচয়িতার উপর গবেষণা করে দেশে এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু দু’টো পি-এইচ. ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

মুনতাসির আহমদ রহমানী সাহেব দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সিনিয়র এডিটর হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। আহমাদুল্লাহ রাহমানী যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে অবসরপ্রাপ্ত হন। এছাড়াও এদের সিনিয়র ও জুনিয়র বেশ কজন রাহমানী আলেম যশ ও খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে অমর হয়ে আছেন। আল্লাহ তাঁদের সবাইকে জান্নাতবাসী করুন-আমীন!!

উক্ত কর্তৃপক্ষ যারা লাহোর শহরে হিজরত করেন তাঁরা মাদরাসাটিও স্থানান্তরিত করেন। লাহোরের রাহমানিয়া মাদরাসাটি বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুখ্যাতি অর্জন করেছে এবং এখনো রাহমানিয়া মাদরাসার ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

রাহমানিয়া মাদরাসার বহু পূর্বে দিল্লি শহরে একটি ঐতিহ্যবাহী দীনী মাদরাসা ছিল। এর নাম রাহিমিয়া মাদরাসা। এটি প্রতিষ্ঠা করেন শাহ্ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী। তাঁর পিতা আব্দুর রহীমের নামানুসারে এই মাদরাসার নামকরণ করা হয়। শাহ ওলীউল্লাহর ইন্তিকালের পর তাঁর বড় ছেলে শাহ আব্দুল আযীয এই মাদরাসার প্রধান ছিলেন এবং তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা শাহ আব্দুল গণী, শাহ্ আব্দুল কাদের সাহেবান এই মাদরাসার মুহাদ্দিসীন কেরাম ছিলেন। এই মাদরাসার কৃতি ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন শাহ ইসমাইল শহীদ। যিনি একবার বিহারের রাজধানীতে সপ্তাহ ব্যাপী দাওয়াত তাবলীগের জন্য আসেন।

তাঁর আকর্ষণে বিহারের গ্রাম থেকে আসা এক যুবক আকৃষ্ট হয় এবং তাদের সাথে দিল্লি শহরে এসে  রহিমীয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়। কালের বিবর্তনে এই বালকটি রহিমীয়া মাদরাসার প্রধান মুহাদ্দিছ হয়ে ইলমে হাদীছ-এর দারস তাদরিসে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি হলেন সৈয়দ নাযীর হুসেইন মুহাদ্দিছ দেহলভী। নাযীর হোসেন সম্পর্কে এত তথ্য আছে যা স্বতন্ত্র পুস্তকে লিখেও সমাপ্ত হবে না। (জ্ঞাতব্য : ২১ ও ২২ পর্বে সৈয়দ নাযীর হুসেইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর জীবনী আলোচনা হয়েছে। যা সেপ্টেম্বর ২০২১-প্রকাশিত হয়েছে)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)




প্রসঙ্গসমূহ »: বিবিধ জীবন কথা

ফেসবুক পেজ