প্রশ্ন (২) : দেশের অধিকাংশ মসজিদের মেহরাবের দক্ষিণ দেয়ালে থুথু ফেলার জন্য ছোট্ট একটি জানালা রাখা হয়। এটা কি শরী‘আত সম্মত?
উত্তর : প্রয়োজন সাপেক্ষে জানালা রাখা যেতে পারে। সেটা হতে পারে থুথু ফেলার জন্য কিংবা আলো-বাতাসের জন্য অথবা অন্যকোন কারণে। হাদীছে বামদিকে থুথু ফেলার ব্যপারে কিছু বর্ণনা এসেছে। নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়ালে সে যেন তার সামনের (ক্বিবলার) দিকে থুথু না ফেলে। কারণ সে যতক্ষণ তার মুছাল্লায় থাকে, ততক্ষণ মহান আল্লাহ্র সাথে চুপে চুপে কথা বলে। আর ডান দিকেও ফেলবে না। তার ডান দিকে থাকেন ফেরেশতা। সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে থুথু ফেলে এবং পরে তা দাবিয়ে দেয়’ (ছহীহ বুখারী, হা/৪০৮, ৪১৬)। উক্ত হাদীছের আলোকে বামদিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে থুথু নিক্ষেপ করার অনুমোদন প্রমাণিত হয়। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মসজিদে থাকাবস্থায় যদি কারোর থুথু নিক্ষেপ করার প্রয়োজন হয়, তাহলে সে বামদিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে নিক্ষেপ করবে। তা না হলে রুমালে কিংবা কাপড়ে নিক্ষেপ করে মুছে ফেলবে’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৮/৪২৪ পৃ.)। ছাহাবী হুযাইফা ইবনু ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি ক্বিবলার দিকে থুথু নিক্ষেপ করে ক্বিয়ামতের দিন সে ঐ থুথু নিজের দু’চোখের মধ্যখানে পতিত অবস্থায় উপস্থিত হবে’ (আবূ দাঊদ, হা/৩৮২৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২২২)। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মসজিদের ভিতরে অথবা বাহিরে উভয়াবস্থাতেই ক্বিবলার দিকে এবং ডান দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে থুথু নিক্ষেপ করা নিষেধ’ (ফাৎহুল বারী, ১/৫১০-৫১২; আল-মাজমূঊ, ৪/১০০ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : সুলাইমান, টাঙ্গাইল।
প্রশ্ন (৩) : ত্বালাক্ব দেয়ার সময় স্ত্রীকে জানানো অথবা লিখিত দেয়া কি যরূরী? স্ত্রীকে না জানিয়ে ত্বালাক্ব দিলে সেই ত্বালাক কার্যকর হবে কি?
উত্তর : কেউ তার স্ত্রীকে না জানিয়ে ত্বালাক্ব দিলেও ত্বালাক্ব কার্যকর হবে। ফাত্বিমাহ বিনতু ক্বায়স (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তার স্বামী তার অনুপস্থিতিতে তাকে ত্বালাক্ব দেন। হাদীছে এসেছে যে,
أَنَّ أَبَا عَمْرِو بْنَ حَفْصٍ طَلَّقَهَا الْبَتَّةَ وَهُوَ غَائِبٌ فَأَرْسَلَ إِلَيْهَا وَكِيْلُهُ بِشَعِيْرٍ فَسَخِطَتْهُ ...
‘আবূ আমর ইবনু হাফছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অনুপস্থিতিতেই তাকে বায়েন ত্বালাক্ব দেন। এরপর সামান্য পরিমাণ যবসহ উকীলকে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। এতে তিনি তার স্বামীর উপর ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট হন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৮০)। শাইখ ইবনু উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ত্বালাক্বের ক্ষেত্রে স্ত্রীর উপস্থিতি ও সম্মতি যরূরী নয়। স্বামী তার স্ত্রীর অজ্ঞাতসারে ও অনুপস্থিতিতেও ত্বালাক্ব দিতে পারে। অতঃপর স্ত্রী সেই ত্বালাক্বে রাজি থাকুক বা না থাকুক, ত্বালাক্ব হয়ে যাবে (ফাতাওয়া লিক্বা আশ-শাহরী, লিক্বা নং-৫৫)।
প্রশ্নকারী : মুহাম্মাদ জুনায়েদ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন (৪) : কছর ছালাত কখন পড়তে হবে? বাড়ি থেকে কোন কাজের প্রয়োজনে বা বেড়ানোর উদ্দেশ্য ২/৩ দিনের জন্য ঢাকা বা অন্য কোন যেলায় গেলে কি ছালাত ক্বছর ও জমা করা যাবে?
উত্তর : সফরে ছালাত কছর করা যায় (সূরা আন-নিসা: ১০১; ছহীহ বুখারী, হা/১০৮১)। যদি বাড়ি হতে ভ্রমণস্থল দূরে হয়; এমন দূরে যেটাকে সফর বলে গণ্য করা সম্ভব তাহলে কছর করা যাবে (ছহীহ বুখারী, হা/১০৮১)। আর সফর অবস্থায় ক্বছর ও জমা করাই উত্তম (ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬)। ব্যক্তি যতদিন সফরে থাকবে ততদিন পর্যন্ত ক্বছর করতে পারবে। এ বিষয়ে নিদিষ্ট করে দিনের সংখ্যা উল্লেখ নেই।
প্রশ্নকারী : আরিফুল ইসলাম, যশোর।
প্রশ্ন (৫) : চাকুরীর বাধ্যবাধকতার কারণে পানি থাকা সত্ত্বেও হাত ও মুখে কসমেটিকস থাকায় তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করা যাবে কি?
উত্তর : কসমেটিকস লাগানোর অজুহাতে পানি থাকাবস্থায় তায়াম্মুম করা যাবে না। তায়াম্মুমের শর্তগুলো হল, (১) ব্যক্তি ও পানির মধ্যের দূরত্ব এক মাইল বা এর চেয়ে বেশি হওয়া (দারাকুৎনী, হা/৭৩১, ৭৩৪)। (২) পানি ব্যবহারের কারণে রোগ সৃষ্টি বা বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা অথবা প্রাণ বা অঙ্গহানির আশঙ্কা হলে (দারাকুৎনী, হা/৭৩১; কিতাবুল আসার, হা/৭৪; বায়হাক্বী, সুনানুন কুবরা, হা/১১০৫)। (৩) পানি এত কম যে ব্যবহার করে ফেললে নিজে অথবা অন্যরা পিপাসাকাতর হয়ে পড়বে (সুনানুল কুবরা, হা/১১৪৯)। (৪) পাশেই কূপ বা পুকুর আছে, কিন্তু পানি এত নিচে যে তা থেকে পানি উঠানোর কোন ব্যবস্থা নেই (ছহীহ বুখারী, ২/৬১ পৃ.)। (৫) পানি কাছেই আছে, কিন্তু দুশমন অথবা ভয়ংকর কোন পশু-প্রাণীর কারণে পানি অর্জন করতে অপারগ (ছহীহ বুখারী, ২/৭২ পৃ.)। ৬. প্রবল ধারণা যে ওযূ করতে গেলে ঈদ বা জানাযার ছালাত ছুটে যাবে, তখন তায়াম্মুম করা যাবে। কারণ সেগুলোর ক্বাযা বা বিকল্প নেই (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ৩/৩০০ পৃ.; মুছান্নাফে ইবনু আবী শায়বা, হা/১১৫৮৬)।
প্রশ্নকারী : আব্দুল্লাহ, মীরপুর, ঢাকা।
প্রশ্ন (৬) : এনজিও থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। পরবর্তীতে বিষয়টি বুঝতে পেরে খুবই অনুতপ্ত হই। এখন পিতার সম্পদ বিক্রয় করে যদি ‘এনজিও’-এর টাকা পরিশোধ করি, তাহলে কি ঐ ব্যবসা থেকে অর্জিত টাকা হালাল হবে?
উত্তর : সূদ দেয়া এবং নেয়া উভয়ই কাবীরা গুনাহ। সূদী ঋণ নিয়ে যে ব্যবসা হয়েছে সেটিও গর্হিত অন্যায়। তবে তওবার নিয়তে উক্ত এনজিও সংস্থার টাকা পরিশোধ করে ফেললে সেই ব্যবসাতে কোন সমস্যা নেই। এটা ঘটেছে একান্তই না জানার কারণে। আর এ অবস্থায় ফিরে আসলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِى الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوْا عَلَيْهِ ‘আল্লাহ্ আমার উম্মাতের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তার সে কাজ যা সে করতে বাধ্য হয়েছে’ (ইবনু মাজাহ, হা/২০৪৫, সনদ হাসান)। সূদের এই পাপ থেকে সবারই বিরত থাকা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, الرِّبَا سَبْعُوْنَ حُوبًا، أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ ‘সূদের গুনাহর সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হলো আপন মাকে বিবাহ (যেনা) করা’ (ইবনু মাজাহ, হা/২২৭৪; বায়হাক্বী, হা/৫১৩১; মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/২২৫৯)। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, لَعَنَ رَسُولُ اللهِ ﷺ آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَكَاتِبَهُ ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সূদখোর, সূদদাতা সূদের সাক্ষীদ্বয় ও সূদের (চুক্তি বা হিসাব) লেখককে অভিসম্পাত করেছেন’ (তিরমিযী, হা/১২০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৮)।
প্রশ্নকারী : শিমুল, জয়পুরহাট।
প্রশ্ন (৭) : কোন বিধবা কিংবা ডিভোর্সপ্রাপ্ত মহিলা তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোন পুরুষকে বিবাহ করতে পারবে কি? যদি বিবাহ করে, তাহলে শরী‘আতের দৃষ্টিতে এই বিয়ে কি সঠিক হবে?
উত্তর : কুমারী হোক কিংবা বিধবা বা ত্বালাক্বপ্রাপ্তা হোক কোন নারীর জন্য পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করা বৈধ নয়। যদি কেউ করে ফেলে তাহলে বিবাহ বাতিল হবে। অভিভাবকের সম্মতিতে পুনরায় বিবাহ পড়াতে হবে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যেকোন নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করবে, তার বিবাহ বাতিল! তার বিবাহ বাতিল! তার বিবাহ বাতিল!’ (তিরমিযী, হা/১১০২; মিশকাত, হা/৩১৩১)। উল্লেখ্য, বিধবা নারী নিজের ব্যাপারে অভিভাবকের চেয়ে বেশি হক্বদার (ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২১)। মর্মে বর্ণিত হাদীছের আলোকে কেউ কেউ বিধবা নারীর একাকী বিবাহ করার বৈধতা দিয়েছেন। কিন্তু তা সঠিক অর্থ নয়। বরং এর সঠিক অর্থ হলো, সে পসন্দ-অপসন্দের ব্যাপারে অধিক হক্বদার। একাকী বিবাহ করার ব্যাপারে নয় (নায়লুল আওত্বার, ৬/১৪৩ পৃ.; সুবুলুস সালাম, ২/১৭৫ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : আব্দুর রহমান, ধানমণ্ডি, ঢাকা।
প্রশ্ন (৮) : কোন ইমাম যদি নবী গায়েব জানেন, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, নবী নূরের তৈরি, নবী জীবিত প্রভৃতি আক্বীদা পোষণ করে, তাহলে ঐ ব্যক্তির পিছনে ছালাত হবে?
উত্তর : উক্ত আক্বীদাগুলো কুফ্র মিশ্রিত বিদ‘আতী আক্বীদা অর্থাৎ কুফুরী আক্বীদা। আর ইমামের আক্বীদা যদি কুফরী হয়, তাহলে তার পিছনে কোনভাবেই ছালাত হবে না। তবে যদি কুফর না করে শুধু বিদ‘আতে লিপ্ত থাকে, সেক্ষেত্রে সেই ইমামের পিছনে ছালাত বৈধ হবে, কিন্তু সেই ইমামকে পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৭/৩৬৭ পৃ.)। উল্লেখ্য যে, ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ এধরনের আক্বীদা বাতিল। আল্লাহর সত্তা সর্বত্র বিরাজমান নয়। বরং তাঁর ইলম ও কুদরত অর্থাৎ জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান (ত্বো-হা: ৪৬)। তিনি সপ্তম আসমানের উপরে আরশে সমুন্নত (সূরা আল-আ‘রাফ: ৫৪; ইউনুস: ৩; রা‘দ: ২; ত্বো-হা: ৫; আল-ফুরক্বান: ৫৯; সাজদাহ:৪; হাদীদ:৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৩৬; মিশকাত, হা/৩৩০৩)। মুআত্ত্বিলাগণ ‘আরশে অবস্থান’ সম্পর্কিত সর্বমোট সাতটি আয়াতের অর্থ করেছেন ‘মালিক হওয়া’, কেউ করেছেন ‘আরশ সৃষ্টির ইচ্ছা করা’ ইত্যাদি। এইভাবে এরা ২৫ প্রকারের সম্ভাব্য অর্থ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। ইমাম যাহাবী উক্ত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় ৯৬টি হাদীছ, ২০টি আছার ও আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণের ১৬৮টি বক্তব্য সংকলন করেছেন (‘মুখ্তাছারুল ‘উলু’)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) এসবের প্রতিবাদে ৪২টি যুক্তি পেশ করেছেন (ইবনুল ক্বাইয়িম, মুখতাছার ছাওয়ায়েকুল মুরসালাহ, ২/১২৬-১৫২)।
প্রশ্নকারী : শরীফ ইবনু আব্দুল ওয়াহেদ, লালমনিরহাট।
প্রশ্ন (৯) : সিজদায় কুরআনে বর্ণিত দু‘আ করা যাবে কি?
উত্তর : কুরআনে বর্ণিত দু‘আ সিজদায় পড়া যাবে। তবে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘...সাবধান! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে আমি যেন রুকূ‘ বা সাজদারত অবস্থায় কুরআন পাঠ না করি। তোমরা রুকূ‘ অবস্থায় মহান প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত বর্ণনা করবে এবং সাজদারত অবস্থায় অধিক দু‘আ পড়ার চেষ্টা করবে। কেননা তোমাদের দু‘আ ক্ববুল হওয়ার উপযোগী’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৪৭৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলী ইবনে আবূ ত্বালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, نَهَانِيْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ أَنْ أَقْرَأَ رَاكِعًا أَوْ سَاجِدًا ‘রাসূল (ﷺ) আমাকে রুকূ‘ বা সাজদায় কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করেছেন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮০)।
সাজদায় কুরআনে বর্ণিত দু‘আ পড়ার ব্যাপারে ইমাম বদরুদ্দীন আজ-জারকাশী, ইমাম নববী, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ), শাইখ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ ও সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ বলেন, لا بأس بذلك إذا أتى بها على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة للقرآن ‘তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য ব্যতীত শুধু দু‘আর উদ্দেশ্যে পাঠ করা দোষনীয় নয়’। কুরআনে বর্ণিত দু‘আমূলক আয়াতসমূহ পাঠ করলেও সাজদার হক্ব আদায় হয়ে যাবে, তবে হাদীছে বর্ণিত দু‘আ পাঠ করা অধিক উত্তম (তুহফাতুল মুহতাজ, ২/৬১; আল-আযকার, পৃ. ৫৯; আশ-শারহুল মুমতি‘, ৩/১৩৩; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৬৯৯৭; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৬/৪৪৩ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : আইয়ূব কাজী, গোপালগঞ্জ।
প্রশ্ন (১০) : সরকারি চাকরির জন্য কোন পড়াশোনা করেনি এমন অনেকেই আছে, যারা সরকারি চাকরি পরীক্ষায় প্রশ্ন কিনে উত্তীর্ণ হয় এবং চাকরি নিশ্চিত করার জন্য সাথে সাথে ঘুষও প্রদান করে, এদের বেতনের টাকা কি হালাল হবে?
উত্তর : তাদের বেতনের টাকা হালাল হবে না। নিঃসন্দেহে এটি এক প্রকারের প্রতারণা। চাকরী, পরীক্ষা, স্কলারশিপ, লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় বা অন্য যে কোন বিষয়ে ধোঁকা দেয়া হারাম। যে কোন পরীক্ষায় নকল করা বা চিট করা হারাম। এটা দেশের লক্ষ লক্ষ মেধাবী শিক্ষার্থীর সাথে বিরাট প্রতারণা। যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা এবং ঘুষ দেয়া ও নেয়া উভয়ই নিষিদ্ধ, তাই এ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي ‘যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা করে, সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১০১-১০২; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৫২; ইবনু মাজাহ, হা/২২২৪)। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন যে, كَرِهُوا الْغِشَّ وَقَالُوا الْغِشُّ حَرَامٌ ‘আলেমদের মতানুযায়ী প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি খুবই জঘন্য অপরাধ এবং তাঁরা বলেছেন, প্রতারণা করা হারাম’ (তিরমিযী, হা/১৩১৫)। সুতরাং যারা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে তারা আইনের চোখে অপরাধী এবং ধর্মের দৃষ্টিতে মহাপাপী। আর যারা এমন কাজকে প্রশ্রয় দেয় তারাও মস্ত বড় অপরাধী। শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
الغش محرم في الاختبارات، كما أنه محرم في المعاملات، فليس لأحد أن يغش في الاختبارات في أي مادة، وإذا رضي الأستاذ بذلك فهو شريكه في الإثم والخيانة "... انتهى
‘পরীক্ষায় নকল করা বা ধোঁকা দেয়া হারাম, যেরকম তা হারাম ব্যবসা-বাণিজ্যে, পরীক্ষায় কারোর জন্য কোন বিষয়ে নকল করা বা টুকলি করা বৈধ নয়। যখন কোন শিক্ষক তাতে সহযোগিতা করে, তখন সেও গুনাহ এবং খিয়ানতে অংশীদার হয়ে যায়’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৬/৩৯৭ পৃ.)। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الغش في الامتحانات محرم ، بل من كبائر الذنوب ‘পরীক্ষায় চিট করা বা নকল করা হারাম, বরং এটা কাবীরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত’ (ফাতাওয়া নূর আলাদ-র্দাব, ২/২৪ পৃ.)। অনুরূপভাবে রিশওয়াহ বা ঘুষ দেয়া ও নেয়া উভয়ই হারাম। আব্দুল্লাহ্ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়কেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লা‘নত বা অভিসম্পাত করেছেন (আবূ দাঊদ, হা/৩৫৮০; তিরমিযী, হা/১৩৩৭)।
প্রশ্নকারী : কাজী, ঢাকা।
প্রশ্ন (১১) : নবী (ﷺ)-এর হাসি-খুশি ও রসিকতার ধরন কেমন ছিল?
উত্তর : সত্যের আলোকে হাসি-খুশি ও বৈধ বিনোদন ইসলামের একটি অনুপম নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা এর বৈধতা দিয়ে বলেন, فَبِذٰلِکَ فَلۡیَفۡرَحُوۡا ‘কাজেই এতে তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত’ (সূরা ইউনুস: ৫৮)। নবী (ﷺ) মৃদু হাসতেন। কখনোই অট্টহাসি দিতেন না। তাঁর মুখমণ্ডলের উজ্জ্বল হাসির আভা ছড়িয়ে পড়ত সর্ব কোণে। তিনি সদা প্রফুল্ল থাকতেন। কখনোই গোমড়ামুখো থাকতেন না। তবে দুশ্চিন্তায় পড়লে তার ছাপ চেহারায় পড়ত এবং তখন তিনি ছালাতে রত হতেন (আবূ দাঊদ, হা/১৩১৯; ছহীহুল জামি‘, হা/৪৭০৩)। তিনি সত্যের আলোকে হালকা রসিকতা করতেন। যেমন:
একদিন স্ত্রী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকটে এসে তার এক বৃদ্ধা খালা রাসূল (ﷺ)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দু‘আ করুন যেন তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। জবাবে রাসূল (ﷺ) বললেন, হে অমুকের মা! কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একথা শুনে উক্ত মহিলা কান্না শুরু করল। তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, তাদের কী দোষ? জবাবে রাসূল (ﷺ) তাকে সান্ত¦না দিলেন এবং স্বীয় উক্তির অর্থ এই বর্ণনা করলেন যে, বৃদ্ধারা যখন জান্নাতে যাবে, তখন বৃদ্ধা থাকবে না, বরং যুবতী হয়ে প্রবেশ করবে। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করে শোনালেন।
اِنَّاۤ اَنۡشَاۡنٰہُنَّ اِنۡشَآءً- فَجَعَلۡنٰہُنَّ اَبۡکَارًا- عُرُبًا اَتۡرَابًا- لِّاَصۡحٰبِ الۡیَمِیۡنِ
আমরা জান্নাতী নারীদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের চিরকুমারী করেছি। সদা সোহাগিনী, সমবয়স্কা। ডান সারির লোকদের জন্য’ (সূরা আল-ওয়াক্বি‘আহ: ৩৫-৩৮; ইবনু কাছীর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জান্নাতবাসী নারী-পুরুষ সবাই ৩০ থেকে ৩৩ বছর বয়সী হবে’ (তিরমিযী, হা/২৫৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২১৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৯৮৭)।
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) আমাদের সাথে উৎফুল্ল মেজাজ ও সম্প্রীতি প্রদর্শন করতেন। এমনকি আমার ছোট ভাই আবূ উমায়ের একটি ‘নুগায়ের’ অর্থাৎ লাল ঠোট ওয়ালা চড়ুই জাতীয় পাখি পুষত। যা নিয়ে সে খেলা করত। রাসূল (ﷺ) যখন এসে তাকে খেলতে দেখতেন, তখন বলতেন, يَا أَبَا عُمَيْرٍ مَا فَعَلَ النُّغَيْرُ ‘হে আবূ উমায়ের! কী করছে তোমার নুগায়ের? ‘উমায়র-এর একটি ছোট্ট বুলবুল পাখি ছিল। সে সেটা নিয়ে খেলা করত। পাখিটি মরে গিয়েছিল’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬১২৯, ৬২০৩)।
প্রশ্নকারী : গোলাম রাব্বি, বরিশাল।
প্রশ্ন (১২) : ঈলা কী? এটা কি রাসূল (ﷺ)-এর জন্য কী খাছ, না-কি সকলের জন্য ‘আম?
উত্তর : ‘ঈলা’ (إِيْلَاء) শব্দের অর্থ হল: শপথ, কসম ইত্যাদি। এটি রাসূল (ﷺ)-এর জন্য খাছ নয়, বরং শরী‘আত সম্মত প্রয়োজনে সকলের জন্য জায়েয। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা নিজেদের স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার শপথ (কসম) করে, তারা চার মাস অপেক্ষা করবে। অতঃপর তারা যদি (মিলনে) ফিরে আসে, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আর যদি তারা ত্বালাকই দিতে (বিবাহ বিচ্ছেদ করতে) সংকল্পবদ্ধ হয়, তবে আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২৬-২২৭)।
কোন স্বামী যদি কসম খায় যে, সে তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না। তবে তার চারটি দিক রয়েছে, প্রথমতঃ কোন সময় নির্ধারণ করল না। দ্বিতীয়তঃ চার মাস সময়ের শর্ত রাখল। তৃতীয়তঃ চার মাসের বেশী সময়ের শর্ত আরোপ করল। চতুর্থতঃ চার মাসের কম সময়ের শর্ত রাখল। বস্তুত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিকগুলোকে শরী‘আতে ‘ঈলা’ বলা হয়। অতঃপর কসমের নির্ধারিত সময়সীমা পূর্ণ করে সম্পর্ক কায়েম করে নেয়, তাহলে তাতে কোন কাফ্ফারা নেই। কিন্তু যদি নির্ধারিত সময়সীমা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই সম্পর্ক কায়েম করে, তাহলে কসমের কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে বিয়ে যথাস্থানে বহাল থাকবে। আর যদি চার মাসেরও অধিক সময়ের জন্য কসম খায় কিংবা যদি কোন সময় নির্দিষ্ট না করেই কসম খায়, তাহলে আলোচ্য আয়াতে এই ধরনের লোকদের জন্য সময় নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে যে, চার মাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর হয় সে স্বীয় স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত করে নেবে, নতুবা তাকে ত্বালাক দিয়ে দেবে। (তাকে চার মাসের অধিক ঝুলিয়ে রাখার অনুমতি নেই।) প্রথম অবস্থায় তাকে কসমের কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। আর যদি সে উভয় অবস্থার কোনটাই গ্রহণ না করে, তাহলে তাকে কোন একটি গ্রহণ করার জন্য আদালত বাধ্য করবে। হয় সে তার সাথে সম্পর্ক কায়েম করে নেবে অথবা তাকে ত্বালাক দেবে। যাতে মহিলার সাথে কোন প্রকার যুলুম না হয়। চার মাস হয়ে গেলেই আপনা-আপনিই ত্বালাক্ব হয়ে যাবে না। (যেমন কোন কোন আলেমের অভিমত।) বরং স্বামী ত্বালাক্ব দিলে তবেই ত্বালাক্ব হবে। আর এ কাজে আদালতও তাকে বাধ্য করবে। অধিকাংশ আলেমের এটাই মত (তাফসীরে ইবনে কাছীর, মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ৩২/২৭১; আল-মুগনী, ৮/৫৫১; ফাতাওয়া আল-লাজনাতুদ দায়িমাহ, ২০/২৬১; আশ-শারহুল মুমতি‘, ১৩/২১৮-২৩৩ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৯৮৮০)।
প্রশ্নকারী : আব্দুল আলীম ইবনু মঈনুল হক, ভারত।
প্রশ্ন (১৩) : বর্তমানে ফেসবুকে বিভিন্ন পণ্য বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে কূপনের মাধ্যমে লটারী ড্র করে উমরাহ পালন, মোরটসাইকেল, এসি, ফ্রিজসহ আরো অনেক কিছু উপহার দেয়া হয়। এগুলোতে অংশগ্রহণ করা যাবে কি?
উত্তর : এ ধরনের পদ্ধতি থেকে বিরত থাকা উচিত। এ মর্মে আলিমদের মধ্যে দু’টি প্রসিদ্ধ মত পরিলক্ষিত হয়। প্রথম অভিমত: সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ বলেন, ‘এরূপ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কেননা এটি নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর এর নিষিদ্ধতা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা' থেকে প্রমাণিত (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ১৫/১৯১ পৃ., ফৎওয়া নং-৫৮৪৭)। অন্যত্র তাঁরা বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকারের ভয়াবহতা, আশঙ্কা, ঝুঁকি, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ধোঁকাবাজি, ঠকবাজি, জুয়াচুরি ও শঠতার কারণে হারাম করা হয়েছে। এবং এর মধ্যে অবৈধ ও অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করাও শামিল আছে। যেমন: আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয় করার শর তো কেবল ঘৃণার বস্তু, শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা সেগুলোকে বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা আল-মায়িদা: ৯০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না...’ (সূরা আন-নিসা: ২৯)। হাদীছের মধ্যে নবী (ﷺ) প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং কাঁকর নিক্ষেপে ক্রয়-বিক্রয় নির্ধারিত করতে নিষেধ করেছেন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৫১৩; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৭৬; তিরমিযী, হা/১২৩০; নাসাঈ, হা/৪৫১৮; ইবনু মাজাহ, হা/২১৯৪)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে ভালো ও কল্যাণকর কাজ করার তাওফীক্ব দান করুন (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ১৫/১৯৫-১৯৬ পৃ., ফৎওয়া নং-১৮৩২৪, ১৯৫৬০)। শায়খ ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এরূপ ক্রয়-বিক্রয় জুয়া ও প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত। সূরা আল-মায়িদার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা একে হারাম ঘোষণা করেছেন (৫: ৯০)। সুতরাং শাসক, দায়িত্বশীল ও বুদ্ধিজীবীদের উচিত এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। কেননা এটি কুরআনের আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে হিদায়াত দান করুন এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন (মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ, সংখ্যা ১১৪৫, তারিখ ২৯/১০/১৪০৮ হি.)।
দ্বিতীয় অভিমতঃ শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ক্রেতার জন্য কুপনের মাধ্যমে লটারি ড্র করে পুরস্কার জেতার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার পর দু’টি শর্ত সাপেক্ষে জায়েয করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে কোম্পানীগুলো তাদের ক্রেতাদের যে সমস্ত পুরস্কার দিয়ে থাকে, আমরা বলি: দু’টি শর্ত সাপেক্ষে তা দোষনীয় নয়। যথা: (ক) দ্রব্যমূল্যটা প্রকৃত অর্থেই পণ্যের বর্তমান বাজার দর হতে হবে। পুরস্কারের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। যদি পুরস্কারের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে এটি জুয়া হয়ে যাবে, যা জায়েয নয়। (খ) মানুষ যেন শুধু পুরস্কার জেতার জন্য পণ্যটি ক্রয় না করে। কেউ যদি শুধু পুরস্কার জেতার জন্য ক্রয় করে, আদতে পণ্য ক্রয় করা উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে এটি জায়েয নয়। কেননা এর মধ্যে অর্থের অপচয় রয়েছে (লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং ১১৬২)। এক্ষেত্রে আমরা বিক্রেতার উদ্দেশ্যে বলব: আপনি পুরস্কারের জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেছেন কি-না? যদি করে থাকেন, তাহলে জায়েয নয়। কেননা যদি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয়, আর মানুষ তা ক্রয় করে, সেক্ষেত্রে তারা হয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে নতুবা লাভবান। উদাহরণ স্বরূপ যদি পণ্যের বাজার দর ১০ রিয়াল হয়, আর পুরস্কারের জন্য যদি তার মূল্য ১২ রিয়াল করে দেয়, তাহলে তা জায়েয নয়। কেননা এক্ষেত্রে ক্রেতা জিতলে লাভবান হবে আর না জিতলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর এটাই তো জুয়া ও প্রতারণা। পক্ষান্তরে বিক্রেতা যদি বাজার দর থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে, সেক্ষেত্রে তার অধিকার আছে মানুষকে আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ করার জন্য পুরস্কার দেয়ার। অতঃপর আমরা ক্রেতার উদ্দেশ্যে বলব: আপনি কি আপনার প্রয়োজনেই পণ্যটি ক্রয় করেছেন? যদি পুরস্কার না থাকতো তবুও কি আপনি ক্রয় করতেন? না-কি আপনি শুধু পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য ক্রয় করেছেন? যদি তিনি প্রয়োজনে ক্রয় করেছেন, তাহলে তা দোষনীয় নয়। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বাজার দর হিসেবেই আছে এবং আপনি আপনার প্রয়োজনেই পণ্যটি ক্রয় করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনি হয় লাভবান হবেন নতুবা নিরাপদ থাকবেন। ক্ষতির কোন ভয় নেই। পক্ষান্তরে যদি আপনি শুধু পুরস্কার জেতার জন্য ক্রয় করেছেন। সেক্ষেত্রে এটি জুয়া ও অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা আপনি জানেন না যে, আপনি পুরস্কার পাবেন কি-না! (লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং ৪৯, প্রশ্ন নং ৫)।
শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ইনশাআল্লাহ এই মতটিই দলীলের অধিক নিকটবর্তী। সুতরাং ক্রেতার অন্তর যদি এ বিষয়ে পরিতৃপ্ত হয় যে, তিনি উপরিউক্ত দু’টি শর্ত সাপেক্ষেই ক্রয়-বিক্রয় করেছেন, তবে তা দোষনীয় নয় (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২২৮৬২, ৯৭৬৪৮)। মোদ্দাকথা হল- যদি পুরস্কারের কুপনের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা না হয় কিংবা এর মাধ্যমে ক্রেতাদেরকে ধোঁকা দেয়ার ইচ্ছা না থাকে এবং ক্রেতা শুধু পুরস্কার পাওয়ার উদ্দেশ্যেই ক্রয় করে না থাকে তাহলে, এ ধরনের কোম্পানী থেকে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয হবে। সেই সাথে লটারিতে বিজয়ী হলে পুরস্কার গ্রহণ করাও জায়েয হবে। এটি মূলত মূল্য ছাড়েরই একটি পদ্ধতি। আল্লাহ তা‘আলাই অধিক অবগত।
প্রশ্নকারী : আব্দুল মালেক, রাজশাহী।
প্রশ্ন (১৪) : দেশে প্রচলিত শেয়ার বাজারের ব্যবসা শরী‘আতসম্মত কি?
উত্তর : শরী‘আত সম্মত পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ম-নীতি বজায় রেখে শেয়ার বাজারের মাধ্যমে জিনিস ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয। শারঈ ব্যবসার একটি নিয়ম হল- ‘মানুষ তার মালিকানাধীন ও অধিকারভুক্ত জিনিস ক্রয়-বিক্রয় করবে’। কিন্তু শেয়ার বাজারে দেখা যায় অধিকাংশ সময় মানুষ এমন জিনিস ক্রয়-বিক্রয় করে, যা তার মালিকানাধীন ও অধিকারভুক্ত নয়, এবং সেটি তার আয়ত্তেও নেই। শরী‘আতের আলোকে এরূপ ব্যবসা নিষিদ্ধ। সাধারণত শেয়ার ব্যবসায় পণ্য নিজ আয়ত্ত্বে না নিয়েই ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। অথচ শরী‘আতের দৃষ্টিতে ক্রয়কৃত বস্তু হস্তগত হওয়ার পূর্বে বিক্রয় করা হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আমরা রাসূল (ﷺ)-এর যুগে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতাম। তখন তিনি আমাদের নিকট এ মর্মে আদেশ দিয়ে লোক পাঠাতেন যে, ঐ ক্রয়কৃত মাল বিক্রয় করার পূর্বেই যেন ক্রয়ের স্থান হতে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বরং নিজেদের ঘরে তুলে নেয়ার আগেই বিক্রয় করলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হত’ (ছহীহ বুখারী, হা/২১৩৭, ২১৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৭)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করবে সে তা নিজ আয়ত্ত্বে নেয়ার পূর্বে বিক্রয় করতে পারবে না (ছহীহ বুখারী, হা/২১৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৫)। রাবী তাঊস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কিভাবে হয়ে থাকে? তিনি বললেন, এটি এভাবে হয়ে থাকে যে, দিরহামের বিনিময়ে আদান-প্রদান হয় অথচ পণ্যদ্রব্য অনুপস্থিত থাকে (ছহীহ বুখারী, হা/২১৩২, ২১৩৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৫)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রত্যেক পণ্যের ব্যাপারে অনুরূপ নির্দেশ প্রযোজ্য হবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/২১৩৫, ২১৩২; তাবয়ীনুল হাকায়িক, ৪/১১৯; আল মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ২৫/২১৮-২১৯)।
১৪০৪ হিজরীতে শেয়ারের মার্কেটের ভয়াবহতা সম্পর্কে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ’-এর অধীনস্থ ‘ইসলামী ফিক্বাহ একাডেমী’-এর একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাঁদের সুদীর্ঘ আলোচনায় হালাল-হারাম, বৈধ-অবৈধ ও কল্যাণ-অকল্যাণের বিবিধ দিক নিয়ে যে সমস্ত মতামত ও শর্তাবলী পেশ করেছেন, সেগুলো মেনে আজকের দিনে শেয়ার বাজারের ব্যবসা করা অসম্ভব (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৪৩১১)। এছাড়াও আরো অসংখ্য কারণে প্রচলিত শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা জায়েয নয়। যেমন: (১) ক্রেতার অনেক সময় সম্যক জ্ঞান থাকে না বা জানতে পারেন না যে কী বস্তুর শেয়ার তিনি ক্রয় করেছেন। অথচ রাসূল (ﷺ) হারাম বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছেন (আবূ দাঊদ, হা/৩৪৮৪, ৩৪৮৫, ৩৪৮৮, ৩৪৯০)। (২) যে বস্তুর শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তা অস্পষ্ট ও অজ্ঞাত থাকে। হাদীছের মধ্যে নবী (ﷺ) প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং কাঁকর নিক্ষেপে ক্রয়-বিক্রয় নির্ধারিত করতে নিষেধ করেছেন (ছহীহ মুসলিম, হা/১৫১৩; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৭৬)। (৩) শেয়ার ব্যবসায় ফাটকাবাজারীর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ পণ্য দেখে না। অথচ প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে, মিনিটে মিনিটে দর উঠা-নামা হয়। কেউ কেউ কয়েক মিনিটের মধ্যে শেয়ার বিক্রয় করে দেয়। বাস্তবে কিন্তু কেউ কোন কোম্পানীতে কয়েক মিনিটের জন্য অংশীদার হয় না। সেখানে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া অনেক সময় কোম্পানী প্রকৃত তথ্য গোপন রাখে। কখনো কারখানা তৈরি না করেই বাজারে তার শেয়ার ছাড়া হয় এবং নতুন শেয়ারে অধিক লাভ ধারণা করে সেটিকে লোকেরা অধিক মূল্যে ক্রয় করে। এছাড়াও নিত্যনতুন ছলচাতুরী শেয়ারবাজারে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। (৪) এতে সূদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ শেয়ার ব্যবসা সূদী ঋণের ভিত্তিতে করা হচ্ছে। অতএব শেয়ার ব্যবসা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। উল্লেখ্য যে, যদি সাধারণভাবে কোন শেয়ার ব্যবসা সূদমুক্ত, ধোঁকাবাজি, ঠকবাজি, জুয়াচুরি ও ছলচাতুরী মুক্ত হয়, তাহলে তা জায়েয। যৌথ ব্যবসার মুশারাকাহ্ বা শরীকানা ব্যবসা পদ্ধতি ইসলামে বৈধ। যাতে উভয়ে সম্পদ ও শ্রমে আনুপাতিক অংশীদার হবে (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৪/২৯৯-৩০০ পৃ.)।
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শেয়ার বাজার সম্পর্কে আমরা যেটা জানতে পেরেছি, সেটি হল- ‘হাওয়ায় কেনাবেচা’। শেয়ার বাজার তো আসলে কোন বাজারই নয়। এ এমন একটি বাজার যেখানে কোন মাল নেই, দোকান নেই। আছে কেবলই ক্রেতা। কাগজের রসিদ দেখিয়ে কেনাবেচা হয়। শেয়ার ব্যবসা একটি জুয়া মাত্র। যা হারাম ও নিষিদ্ধ। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ মাল দেখে না। অথচ অনবরত দর উঠা-নামা করে। একটি গ্রুপ কাজ করে হুজুগ লাগানোর জন্য। তারা ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করে। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার রঙিন স্বপ দেখিয়ে তাদেরকে শেয়ার কিনতে প্রলুব্ধ করে। তারপর তাদের টাকাগুলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হলেই তা লোপাট করে এই গোষ্ঠী সরে পড়ে। এটি নিষিদ্ধ, এটি অগ্রহণযোগ্য ব্যবসা, এটি ঠিক নয় (ফাতাওয়া আল-জামিউল কাবীর, ইবনে বায অফিশিয়াল ওয়েবসাইট, যঃঃঢ়ং://নরহনধু.ড়ৎম.ংধ/ভধঃধিং/১৮৭৩/%উ৮%অউ%)।
প্রশ্নকারী : আব্দুল্লাহ, বরিশাল।
প্রশ্ন (১৫) : বিবাহ বিচ্ছেদের হালাল উপায় কী?
উত্তর : স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সৎভাবে জীবন-যাপন কর, তোমরা যদি তাদেরকে (স্ত্রীদেরকে) ঘৃণা কর, তাহলে এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ যার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকে ঘৃণা করছ’ (সূরা আন-নিসা: ১৯; আল-মুনতাক্বা ইবনে ফাওযান, ৪/১১৭)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে উৎকৃষ্ট পন্থায় বার্তালাপ করা এবং উত্তম আচরণ প্রর্দশন করা স্বামীর উপর অপরিহার্য। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, ‘পুরুষদের যেমন নারীদের উপর অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি নারীদের রয়েছে পুরুষদের উপর ন্যায়-সঙ্গত অধিকার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২৮)।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলে প্রথমেই তালাকের পন্থা অবলম্বন করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার তোমরা আশঙ্কা কর, তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং তাদেরকে প্রহার কর। অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগতা হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোন পথ অন্বেষণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সুউচ্চ, সুমহান। আর যদি উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা কর, তাহলে তোমরা স্বামীর পরিবার হতে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার হতে একজন সালিস নিযুক্ত কর, যদি তারা উভয়ে নিষ্পত্তির ইচ্ছা রাখে, তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আন-নিসা: ৩৪-৩৫)। অর্থাৎ স্ত্রী অবাধ্য হলে প্রথমতঃ তাকে সদুপদেশ ও নসীহতের মাধ্যমে বুঝানো। দ্বিতীয়তঃ সাময়িকভাবে তার সংসর্গ ত্যাগ করে বিছানা পৃথক করে দিতে হবে। বুদ্ধিমতী মহিলার জন্য এটি একটি বড় সতর্কতার বিষয়। তৃতীয়তঃ এতেও যদি সে না বুঝে, তাহলে হালকাভাবে প্রহার করার অনুমতি আছে। তবে এই প্রহার যেন হিংস্রতা ও অত্যাচারের পর্যায়ে না পৌঁছে যায়! আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) এই যুলুমের অনুমতি কাউকে দেননি। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমরা কেউ নিজ স্ত্রীদেরকে গোলামের মত প্রহার করো না। কেননা, দিনের শেষে তার সঙ্গে তো আবার সহবাস করবে (ছহীহ বুখারী, হা/৫২০৪, ৪৯৪২)।
উল্লিখিত তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও যদি কোন ফল না হয়, সেক্ষেত্রে চতুর্থ ব্যবস্থা হল- সালিশি সভার আয়োজন করা। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, দু’জন বিচারক নিষ্ঠাবান ও আন্তরিকতাপূর্ণ হলে, তাদের সংশোধনের প্রচেষ্টা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। আর যদি তাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে ত্বালাক্বের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নেবে (তাফসীরে ত্বাবারী, ফাৎহুল ক্বাদীর এবং ইবনে কাছীর)।
প্রশ্নকারী : মুহাম্মাদ আল-আয়ান, নরসিংদী।
প্রশ্ন (১৬) : কখন রসিকতা করা জায়েয?
উত্তর : শর্তসাপেক্ষে মজা, কৌতুক, রসিকতা করা বৈধ। যেমন- (১) ঠাট্টা ও কৌতুক করার সময় সামান্য পরিমাণেও দ্বীনকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা যাবে না। কারণ এটি হল ইসলাম ভঙ্গের অন্যতম কারণ (সূরা আত-তাওবা: ৬৫-৬৬)। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টাকারী ব্যক্তি ঈমান আনার পরেও কাফির হয়ে যায়’। অনুরূপভাবে সুন্নাতকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করার ব্যাপারটিও খুবই ভয়ঙ্কর, যা বর্তমানে খুবই বিস্তার লাভ করেছে। যেমন: দাড়ি, পর্দা ও টাখনুর উপর কাপড় পরিধান করা ইত্যাদি। এ সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রব, রিসালাত, অহী ও দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা ও কৌতুক করা হারাম। ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা বা কাউকে হাসানোর জন্য এরূপ কাজ করা কারোর জন্য বৈধ নয়। যদি কেউ এরূপ করে তবে সে কাফির। কারণ সে মূলত আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব ও তার শরী‘আত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করল। উপরিউক্ত কেউ এরূপ কাজ করে ফেললে, তার কর্মের কারণে মহান আল্লাহর নিকট তাকে তাওবাহ করতে হবে। কারণ এটি এক প্রকারের নিফাক্ব (মুনাফিক্বী)। তার উচিত হল: মহান আল্লাহর কাছে তাওবাহ ও ইসতিগফার করা, তার কৃতকর্মকে সংশোধন করে নেয়া, তার অন্তরে মহান আল্লাহর ভয় রাখা, তাঁকে সম্মান করা ও তাঁকে ভালোবাসা (আল-মাজমূ’উছ ছামীন, ১/৬৩)।
(২) ঠাট্টা ও কৌতুক সত্য হতে হবে, মানুষকে হাসানোর জন্যও মিথ্যা বলা যাবে না। ইসলামে হাসি-মস্করা, আনন্দ ও বিনোদনকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্ত সে জন্য মিথ্যা বলা বৈধ করা হয়নি। রাসূল (ﷺ) নিজে হাসি-মস্করা করতেন, কিন্তু মিথ্যা পরিহার করতেন। ছাহাবীগণও হাসি-মস্করা করতেন, তবে মিথ্যা বর্জন করতেন। এ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, وَيْلٌ لِلَّذِيْ يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ ‘ঐ ব্যক্তির জন্য দুর্ভোগ! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য দুর্ভোগ! তার জন্য দুর্ভোগ!’ (আবূ দাঊদ, হা/৪৯৯০; তিরমিযী, হা/২৩১৫)।
(৩) ঠাট্টার ছলেও কাউকে ভয় দেখানো যাবে না: বিশেষ করে শক্তিশালী ব্যক্তি কর্তৃক দুর্বল ব্যক্তিকে হাতে অস্ত্র নিয়ে অথবা লোহার টুকরা নিয়ে অথবা লাঠি নিয়ে কোন ব্যক্তিকে ঠাট্টা ও কৌতুক করা যাবে না। কারণ এতে করে তারা ভীত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবূ লাইলা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাথীরা (ছাহাবীরা) আমাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা একদিন নবী (ﷺ)-এর সাথে সফর করেছিলেন। এমন সময় তাদের মধ্যকার এক লোক ঘুমিয়ে পড়লে তাঁদের কেউ কেউ গিয়ে একটা রশি এনে ঐ লোকের সামনে ধরলে সে ভয় পেয়ে যায়। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُرَوِّعَ مُسْلِمًا ‘কোন মুসলিমকে ভয় দেখানো কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়’ (আবূ দাঊদ, হা/৫০০৪)।
(৪) ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করার ছলে কটাক্ষ ও বদনাম না করা: মানুষের স্তর বহু রকমের হয়। এটা হয় তার জ্ঞানের দিক থেকে ব্যক্তিত্বের দিক থেকে। কতক মানুষ মনের দিক থেকে দুর্বল হয়। নিজের চেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকের সাথে মানুষ ঠাট্টা-বিদ্রƒপ ও কটাক্ষ করে। অথচ এটা নিষিদ্ধ (সূরা আল-হুজুরাত: ১১)। এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ আয়াত থেকে উদ্দেশ্য হল: তাদেরকে তুচ্ছ মনে করা, হেয় পতিপন্ন করা ও ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা। আর এগুলো হারাম যা মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য হবে। রাসূল (ﷺ) ঠাট্টা-বিদ্রƒপ তথা উপহাস ও কষ্ট দেয়া থেকে সাবধান করেছেন, কারণ তা শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষের রাস্তা (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; তিরমিযী, হা/১৯২৭; ছহীহুল জামি‘, হা/৬৭০৬)।
(৫) ঠাট্টা ও কৌতুক বেশি পরিমাণে না করা: কিছু মানুষ অতিরিক্ত ঠাট্টা ও কৌতুক করে। এর ফলে সে মানুষের নিকট মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অথচ এটি একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। আত্মার প্রশান্তির জন্য ও সুস্থ বিনোদনের জন্য এর অনুমোদন আছে। উমার ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اتقوا المزاح، فإنه حمقة تورث الضعينة ‘তোমরা ঠাট্টা ও কৌতুক থেকে সাবধান থাক। কেননা তা হল নির্বুদ্ধিতা, যা বিদ্বেষ ও শত্রুতা ছড়ায়’।
(৬) মানুষের পরিমাপ জানা: কতক মানুষ বাছ-বিচার না করেই সবার সাথে ঠাট্টা ও কৌতুক করে। অথচ জ্ঞানী ব্যক্তির (আলিমের) হক আছে, বড় মানুষের হক আছে, মুরুব্বী মানুষেরও হক আছে। এজন্য মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আগে জানা উচিত। বোকা, নির্বোধ ও পাগলের সাথে ঠাট্টা করা উচিত নয়। অনুরূপভাবে অপরিচিত ব্যক্তির সাথেও। এ বিষয়ে উমার ইবনু আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,اتقوا المزاح، فإنه يذهب المروءة ‘তোমরা ঠাট্টা ও কৌতুক থেকে সাবধান থাক, কেননা তা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে যায়’।সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,إقتصر فى مزاحك، فإن الإفراط فيه يذهب البهاء، ويجرىّ عليك السفهاء ‘তুমি ঠাট্টা ও কৌতুক কম কর, কেননা তা বেশি করা সৌন্দর্য ও জ্যোতিকে নিয়ে যায়। আর তোমাকে নির্বুদ্ধিতার উপর ছেড়ে যায়’।
(৭) ঠাট্টা ও কৌতুকের পরিমাণ তরকারীতে লবনের পরিমাণের মত হবে: এ বিষয়ে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, لَا تُكْثِرِ الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيْتُ الْقَلْبَ ‘তোমরা বেশি বেশি হাসিও না, কারণ অতিরিক্ত হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে’ (তিরমিযী, হা/২৩০৫; সনদ হাসান, ছহীহুল জামি‘, হা/৭৪৩৫)।
(৮) ঠাট্টা ও কৌতুকের মাঝে গীবত না থাকা: এটা একটা অপবিত্র রোগ। কিছু মানুষ এটা ঠাট্টা-বিদ্রƒপের ছলে করে বসে। তবুও এটা গীবত হবে। কারণ নবী (ﷺ) বলেছেন, ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهٗ ‘তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় উল্লেখ করা যা সে অপসন্দ করে’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৯; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭৪)।
(৯) ঠাট্টা ও কৌতুক করার জন্য একটি উপযোগী সময় নির্বাচন করা: সেটা হতে পারে শীতকালীন ছুটি অথবা গ্রীষ্মকালীন ছুটি অথবা বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সময়। তার সাথে বুদ্ধি খাটিয়ে, আশ্চর্যজনক বিষয়ে যাতে চিন্তার খোরাক থাকে এমন সামান্য পরিমাণে ঠাট্টা ও কৌতুক করবে। যাতে করে অন্তরে ভালোবাসা বৃদ্ধি হয় এবং মনে আনন্দ হয়। (বিস্তারিত দ্র.: আব্দুল মালিক আল কাসিম-এর ‘মা হিয়া শুরূতুল মিযাহিশ্ শারঈ’ নামক প্রবন্ধ, ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২২১৭০)।
প্রশ্নকারী : আল-আমীন, ঢাকা।
প্রশ্ন (১৭) : জনৈক মৃত ব্যক্তির ১ জন স্ত্রী রয়েছে, ৩ জন কন্যা সন্তান রয়েছে, কোন পুত্র সন্তান নেই, ১ জন বোন রয়েছে এবং ৮ জন ভাতিজা রয়েছে। তবে ঐ মৃত ব্যক্তির কোন ভাই জীবিত নেই। এক্ষণে ঐ মৃতের সম্পদে কে কতটুকু অংশীদার হবে?
উত্তর : তিন কন্যা ও স্ত্রীর নির্ধারিত অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট অংশে ‘আস্বাবাহ’ সূত্রে এক বোন ও ভাতিজারা অংশীদার হবেন। কন্যাদের অংশ: এক্ষেত্রে কন্যারা মোট পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) পাবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘কিন্তু দু’এর অধিক কন্যা থাকলে, তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ, আর মাত্র একজন কন্যা থাকলে, তার জন্য অর্ধাংশ’ (সূরা আন-নিসা: ১১)। তাহলে এখানে তিন কন্যা পাবে সমস্ত মালের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ (১০০স্ট৩=৩৩.৩৩) মানে ৬৬.৬৬ শতাংশ। এবার ঐ ৬৬.৬৬ শতাংশ তিন কন্যার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করতে হবে। তাহলে প্রত্যেকে (৬৬.৬৬স্ট৩) ২২.২২ শতাংশ করে পাবে। স্ত্রীর অংশ: সন্তানের উপস্থিতিতে স্ত্রী পরিত্যাক্ত সম্পত্তির এক-অষ্টমাংশ (১/৮) পাবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তোমাদের সন্তান না থাকলে তাদের (স্ত্রীদের) জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ, আর তোমাদের সন্তান থাকলে তাদের (স্ত্রীদের) জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-অষ্টমাংশ। তোমরা যা ওয়াছিয়্যাত কর তা কার্যকর ও ঋণ পরিশোধ করার পর’ (সূরা আন-নিসা: ১২)।
অর্থাৎ যদি স্বামী মারা যায় এবং তার কোন সন্তান না থাকে, তবে ঋণ পরিশোধ ও ওয়াছিয়্যাত কার্যকর করার পর স্ত্রীরা মোট সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ পাবেন। আর যদি মৃত স্বামীর সন্তান থাকে, এ স্ত্রীর গর্ভজাত হোক কিংবা অন্য স্ত্রীর, তবে ঋণ পরিশোধ ও ওয়াছিয়্যাত কার্যকর করার পর স্ত্রীরা এক-অষ্টমাংশ পাবেন। স্ত্রী একাধিক হলেও উপরিউক্ত বিবরণ অনুযায়ী এক অংশ সকল স্ত্রীর মধ্যে সমহারে বণ্টন করা হবে। তাহলে এখানে স্ত্রী এক-অষ্টমাংশ (১০০স্ট৮) অর্থাৎ ১২.৫ শতাংশ পাবে।
স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে, তা তাদের অন্যান্য ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। তবে প্রথমে দেখা উচিত যে, স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা হয়েছে কি-না, যদি না হয় তবে অন্যান্য ঋণের মতই প্রথমে মোট পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে মোহরানা পরিশোধ করার পরে ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। মোহরানা পরিশোধ করার পর যদি মৃত স্বামীর সম্পত্তি অবশিষ্ট না থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মত সম্পূর্ণ সম্পত্তি মোহরানা বাবদ স্ত্রীকে সমর্পণ করা হবে এবং কোন ওয়ারিশই অংশ পাবে না। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘শর্তসমূহের মধ্যে যা পূর্ণ করার সর্বাধিক দাবী রাখে তা হল সেই শর্ত যার দ্বারা তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের হালাল করেছ’ (ছহীহ বুখারী, হা/২৭২১, ৫১৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪১৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩০৪; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন, ১৮/৩১; ই‘লামুল মুওয়াক্কিইন, ৩/৮১; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৯/৫৬; বাবুল লিক্বা আশ-শাহরী, ২/৩৬১-৩৬২ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৫৮৫৫; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-১৩১৩৪৬)। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘সা‘দ ইবনু রাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর স্ত্রী সা‘দের ঔরসজাত তাঁর দুই কন্যাসহ রাসূল (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এরা সা‘দ ইবনু রাবীর দুই মেয়ে। এদের বাবা উহুদের যুদ্ধে আপনার সাথে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছেন। এদের সমস্ত ধন-সম্পদ এদের চাচা নিয়ে নিয়েছে, এদের জন্য সামান্য কিছুও রাখেনি। এদের কোন ধন-সম্পদ না থাকলে এদের বিয়েও তো হবে না। তিনি বললেন, এ বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলাই সমাধান করে দিবেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মীরাছ বণ্টন বিষয়ক আয়াত অবতীর্ণ হয়। তাদের চাচাকে রাসূল (ﷺ) ডেকে এনে বললেন, সা‘দের দুই মেয়েকে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি এবং তাদের মাকে এক-অষ্টমাংশ সম্পত্তি দিয়ে দাও, তারপর যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে তা তোমার’ (তিরমিযী, হা/২০৯২; আবূ দাঊদ, হা/২৮৯১; ইবনু মাজাহ, হা/২৭২০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৮৪০)।
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘অতঃপর অবশিষ্ট সম্পত্তি ‘আছাবাহ সূত্রে’ অর্থাৎ সবচেয়ে নিকটাত্মীয় উত্তরাধিকারী হিসাবে ভাই ও বোনদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। কিন্তু যেহেতু এখানে কোন ভাই জীবিত নেই, তাই অবশিষ্ট সম্পত্তি বোন পেয়ে যাবেন। আর বোনের উপস্থিতিতে ভাতিজারা বঞ্চিত হবে। যেমন ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সূত্রে রাসূল (ﷺ) বলেন, সুনির্দিষ্ট অংশের অধিকারীদের নিকট মীরাছ পৌঁছে দাও। অতঃপর যা বাকী থাকবে তা (মৃতের) নিকটতম পুরুষের জন্য (ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৩২, ৬৭৩৫, ৬৭৩৭, ৬৭৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬১৫)। হুযাইল ইবনু শুরাহবীল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে কন্যা, পুত্রের কন্যা এবং বোনের (মীরাছ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তখন তিনি বললেন, কন্যার জন্য অর্ধেক আর বোনের জন্য অর্ধেক। তিনি বললেন, তোমরা ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর কাছে যাও, তিনিও হয়তো আমার মতই বলবেন। অতঃপর ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে জিজ্ঞেস করা হল এবং আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যা বলেছেন সে সম্পর্কেও তাঁকে জানানো হল। তিনি বললেন, (ও রকম সিদ্ধান্ত দিলে) আমি তো পথভ্রষ্ট হয়ে যাব, হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকব না। আমি এ ব্যাপারে ঐ ফায়সালাই দিচ্ছি, যে ফায়সালা নবী (ﷺ) প্রদান করেছিলেন। কন্যা পাবে অর্ধাংশ আর পৌত্রী পাবে ষষ্ঠাংশ। এভাবে দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণ হবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ পাবে বোন। এরপর আমরা আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে আসলাম এবং ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) যা বললেন, তা তাকে জানালাম। তখন তিনি বললেন, এই অভিজ্ঞ মনীষী যতদিন তোমাদের মাঝে জীবিত থাকবেন, ততদিন আমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করো না (ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৩৬, ৬৭৪২)। তাহলে এখন অবশিষ্ট ২০.৮৪ অংশ বোন পেয়ে যাবেন। আর ভাতিজারা বঞ্চিত হবেন (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুশ শাইখ ইবনে বায, ২০/১৯৫-১৯৭; মাজাল্লাতুল বাহূছিল ইসলামিয়্যাহ সংখ্যা ১৮, সাল ১৪০৭ হি., ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ, ৩/৫৯ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩০৯৬১)।
প্রশ্নকারী : আবু হুরায়রা সিফাত, মান্দা, নওগাঁ।
প্রশ্ন (১৮) : কোঁকা কোলা কিংবা এমন পণ্য যা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত দেশের তৈরি, অথচ তা সরকার বয়কট করতে বলে না, তা কী ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সামাজিকভাবে বর্জন করা যাবে?
উত্তর : মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফিরদের পণ্য বয়কট করে তাদের আর্থিকভাবে দুর্বল করা আমাদের জন্য ঈমানী দায়িত্ব। ইমাম ইবনু বাত্ত্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সমস্ত রকমের কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয। তবে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত কাফিরদেরকে এমন কোন সরঞ্জাম ও হাতিয়ার বিক্রয় করা যাবে না, যেগুলো তারা মুসলিমদের নিধন করার কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিংবা এমন কোন লেনদেন করা যাবে না, যার ফলে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী হয়ে যায়’ (শারহুল বুখারী, ৬/৩৩৮ পৃ.)। চাপ সৃষ্টি করার জন্য এবং তাদের দ্বারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও গৃহহীন মুসলিমদের সাহায্য করণার্থে ইসরায়েলী পণ্য বয়কট করা অথবা ইসরায়েলী কোম্পানীগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করা আবশ্যক। তাই তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্য সমস্ত রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সর্ব যুগেই মাল-সম্পদ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসাবে চিহ্নিত। মুসলিমদের উচিত সর্বদা যুলুম, অন্যায় ও পাপাচারের বিরোধিতা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাক্বওয়ায় পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যধিক কঠোর’ (সূরা আল-মায়িদা: ২)। মুসলিমরা কখনো কোন ইয়াহুদী, খ্রিস্টান অথবা অন্যান্য অমুসলিমদের এমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না, যার ফলে তারা ফুলেফেঁপে আরো শক্তিশালী হয়ে যায়। রাসূল (ﷺ) স্পষ্ট ভাষায় বলেন, তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্পদ, জীবন ও কথার দ্বারা জিহাদ করো’ (আবূ দাঊদ, হা/২৫০৪)। ফিলিস্তীনী মুসলিমদের উপর ইসরায়েলী হানা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে দৃশ্যমান কোন প্রতিবাদ হয়নি। তাই ইসরায়েলী পণ্য বয়কটের মাধ্যমে আমরা প্রতিবাদ করতে পারি। সেই সঙ্গে ইসরায়েলে গার্মেন্টস পন্যের রফতানি বন্ধ করে সেই বস্ত্র সহায়সম্বলহীন ফিলিস্তীনীদের বিনামূল্যে দান করে তাদের পাশে থাকতে পারি। মোদ্দাকথা হল- যুদ্ধরত কাফিরদের পণ্য বয়কট করে তাদের আর্থিকভাবে দুর্বল করা জায়েয এবং খুবই ভালো উদ্যোগ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ১৩/১৮ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২০৭৩২, ২৬১৮২২)।
প্রশ্নকারী : আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ফাইয়াজ, চাঁদপুর।
প্রশ্ন (১৯) : ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর শর্তগুলো জানা কি প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয? না জানলে কি ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে?
উত্তর : ইসলামী শরী‘আর সুবিদিত ও স্থিরীকৃত বিষয় হলো: তাওহীদের বাণী তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’-এর অর্থ জানে ও সে মোতাবেক আমল করে সেই এর প্রকৃত ধারক। এই বাণী আখিরাতে তাকে উপকৃত করবে, সে ব্যক্তি জান্নাতবাসী হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। শায়খ সুলাইমান ইবনু আব্দুল্লাহ্ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উবাদা ইবনু ছামেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, এক আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই; তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল; ঈসা আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল ও তাঁর বাণী; যা তিনি মারিয়ামের প্রতি নিক্ষেপ করেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ এবং জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য। আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; তার আমল যেমনই হোক না কেন। হাদীছের উক্তি: ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, এক আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই বাণীর অর্থ জেনে ও এর দাবী মোতাবেক প্রকাশ্যে ও গোপনে কর্ম করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই বাণী উচ্চারণ করবে; যেমনটি নির্দেশ করছে আল্লাহ তাআলার বাণী: فَاعۡلَمۡ اَنَّہٗ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ ‘অতএব জেনে নিন, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই’ (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, اِلَّا مَنۡ شَہِدَ بِالۡحَقِّ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ‘তবে যারা জেনে সত্য সাক্ষ্য দেয় তাদের কথা আলাদা’ (সূরা আয-যুখরুফ: ৮৬)। তবে এর অর্থ না জেনে ও দাবী মোতাবেক আমল না করে এই বাণী মুখে উচ্চারণ করলে, আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে এটি কোন উপকারে দিবে না’ (তাইসীরুল আযীযিল হামিদ, পৃ. ৫১)।
তবে প্রত্যেক মুসলিমের উপর এই বাণীর অর্থ ও দাবী সামগ্রকিভাবে জানা ফরয। এটাই যথেষ্ট। নবী (ﷺ) থেকে এমনটি জানা যায় না যে, তিনি প্রত্যেক নও মুসলিমের জন্য এই শর্তগুলো কিতাবপুস্তকে যেভাবে বিস্তারিতভাবে সেইভাবে ব্যাখ্যা করতেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কোন সন্দেহ নেই যে, রাসূল (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন সেটার প্রতি সাধারণ ও এজমালিভাবে (সামগ্রিকভাবে) ঈমান আনা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয। এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, রাসূল (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা ফরযে কিফায়া। কেননা তা আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ)-কে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন সেটা পৌঁছিয়ে দেয়ার মধ্যে পড়ে। কুরআন তাদাব্বুর (অনুধাবন), অনুধ্যান, বুঝা, কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান, যিকির মুখস্থকরণ, কল্যাণের দিকে আহ্বান, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ, হেকমত-ওয়ায-উত্তম পন্থায় তর্কের মাধ্যমে প্রভুর দিকে ডাকা ইত্যাদি যা আল্লাহ উম্মাহ্র উপরে ফরয করেছেন সেটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এটি তাদের উপর ফরযে কিফায়া’ (দারউ তাআরুযিল আক্বলী ওয়াল নাকল, ১/৫১ পৃ.)।
শাইখ হাফেয আল-হাকামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ কেবল মৌখিকভাবে বলার দ্বারা ব্যক্তি উপকৃত হবে না; যতক্ষণ না এই সাতটি শর্ত পূর্ণ না করে। শর্তগুলো পূর্ণ করার অর্থ হলো: বান্দার মধ্যে এগুলো পাওয়া যাওয়া এবং বান্দা এগুলোর উপর অটল থাকা; এগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক কিছু ব্যতিরেকে। এর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, গুণে গুণে এ শর্তগুলোর শব্দাবলী মুখস্ত করা। কত সাধারণ মানুষের মাঝে এ শর্তগুলো পাওয়া যায় এবং এগুলো তিনি পূর্ণ করেন; কিন্তু তাকে যদি বলা হয়: শর্তগুলো বলেন তো; বলতে পারবেন না। আবার এ শর্তগুলোর শব্দাবলী মুখস্থকত হাফেয রয়েছে; কিন্তু সে এ শর্তগুলোর মধ্যে তীরের মত ছুটাছুটি করে। আপনি দেখবেন যে, সে এমন অনেক কিছুতে লিপ্ত হয় যা এই শর্তবলীর সাথে সাংঘর্ষিক। তাওফীক আল্লাহর হাতে এবং আল্লাহই সহায়’ (মা‘আরিজুল কাবুল, ২/৪১৮ পৃ.)।
শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সকল মুসলিমের উপর ফরয হলো: এই কালিমা বাস্তবায়ন করা; এর শর্তগুলো রক্ষা করার মাধ্যমে। যখনই কোন মুসলিমের মাঝে এই শর্তগুলোর মর্ম পাওয়া যাবে এবং এর উপর অবিচলতা পাওয়া যাবে তখনই সে মুসলিম; যার রক্ত ও সম্পদ হারাম; এমনকি সে যদি এই শর্তগুলো বিস্তারিতভাবে না জেনে থাকে তবুও। কেননা উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। যদিও কোন মুমিন শর্তগুলোর বিস্তারিত বিবরণ না জানে’ (মাজমূঊ ফাতাওয়াস লিশ শাইখ ইবনি বায, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৫৮)।
প্রশ্নকারী : রুকনুযযামান, দামকুড়াহাট, রাজশাহী।
প্রশ্ন (২০) : মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর লাইভ আযানের উত্তর দিলে তার ছওয়াব পাওয়া যাবে কি?
উত্তর : মোবাইল বা টেলিভিশনের মাধ্যমে মক্কা-মদীনার মুওযযিনের আযান যদি সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচারিত হয়, সেক্ষেত্রে দর্শক বা শ্রোতারা আযানের উত্তর দিতে পারবে এবং ছওয়াবও হবে ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে আযানের জবাব সংক্রান্ত সাধারণ হাদীছগুলোই দলীল হিসাবে প্রযোজ্য। যেমন আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেছেন, إذَا سَمِعْتُمُ النِّدَاءَ فَقُوْلوْا مِثْلَ مَا يَقُوْلُ الْمُؤَذِّنُ ‘যখন তোমরা আযান শুনতে পাও তখন মুআযযিন যা বলে তোমরাও তাই বলে আযানের জবাব দাও’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬১১; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৮৩-৩৮৪; আবূ দাঊদ, হা/৫২২-৫২৩; তিরমিযী হা/২০৮, ৩৬১৪; নাসাঈ, হা/৬৭৮; ইবনু মাজাহ, হা/৭২০)।
তবে রেকর্ডকৃত আযান সম্প্রচার করা হলে সেই আযানের জবাব দেয়া শরী‘আতসম্মত নয়। কারণ এগুলো মৌলিক আযান নয়। তাছাড়া আযান একটি ইবাদত আর ইবাদতের জন্য যরূরী হচ্ছে একজন ব্যক্তি সরাসরি সে কাজটা করবে। সুতরাং যখন মুআযযিন সরাসরি আযান দিবে তখন যদি আমরা শুনি তবে তার জবাব দিলে ছাওয়াব রয়েেেছ। কিন্তু কোনও একসময় আযান দেয়া হয়েছে বা স্টুডিওতে আযান দেয়া হয়েছে পরবর্তীতে তা ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে বা রেকর্ডিং প্লে করে শোনানো হচ্ছে তাহলে তার জবাব দেয়া ঠিক নয়। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১০/৩৬৩; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ইবনে উছাইমীন, ১২/১৯৬ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৮৮৭১)।
প্রশ্নকারী : ইমরান, ঢাকা।
প্রশ্ন (২১) : অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা করা যাবে কি?
উত্তর : সাধারণভাবে ইহুদী, খ্রিস্টান অথবা অন্যান্য অমুসলিমের সঙ্গে লেনদেন বা ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয। নবী (ﷺ) ও ছাহাবীগণ মদীনার ইহুদীদের সঙ্গে আদান-প্রদান ও লেনদেন করেছেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, নবী (ﷺ) জনৈক ইহুদীর কাছ হতে নির্দিষ্ট মেয়াদে খাদ্য শস্য খরিদ করেন এবং নিজের বর্ম তার কাছে বন্ধক রাখেন (ছহীহ বুখারী, হা/২৫০৯, ২০৬৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী (ﷺ)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর বর্মটি ত্রিশ ছা‘ যবের বিনিময়ে এক ইহুদীর নিকট বন্ধক ছিল (ছহীহ বুখারী, হা/২৯১৬)। ইবনু দাক্বীক্ব আল-‘ঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অমুসলিম, কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে লেনদেন করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে এটিই দলীল’ (ইহকামুল আহকাম, ২/১৪৫ পৃ.)। আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি ইহুদী বাগান মালিকের কূপ থেকে এক একটি উত্তম খেজুর প্রদানের শর্তে এক বালতি করে পানি উত্তোলন করেছি’ (ইবনু মাজাহ, হা/২৪৪৭; সনদ হাসান, আত-তা‘লীক্বাতুর রাযীয়্যাহ, ২/৪৪২ পৃ.)। বিষয়টি আরো স্পষ্টীকরণার্থে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘মুশরিক ও শত্রু রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সাথে ক্রয়-বিক্রয়’ নামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেন (অধ্যায় নং-৩৪, অনুচ্ছেদ নং-৯৯)। অতঃপর নিম্নোক্ত হাদীছটি বর্ণনা করেন। আব্দুর রহমান ইবনু আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা নবী (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। সে সময়ে এলোমেলো লম্বা লম্বা চুল বিশিষ্ট এক মুশরিক ব্যক্তি তার বকরী হাঁকিয়ে উপস্থিত হলো। নবী (ﷺ) তাকে বললেন, ‘এটা কি বিক্রির জন্য, না-কি দান হিসাবে’, অথবা তিনি বললেন, ‘না হিবাহ্ হিসাবে’? সে বলল, বিক্রির জন্য। তখন তিনি তার নিকট হতে একটি বকরী কিনে নিলেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/২২১৬, ২৬১৮, ৫৩৮২)।
প্রশ্নকারী : তানভীর, সিরাজগঞ্জ।
প্রশ্ন (২২) : অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করা, শুভেচ্ছা জানানো, ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করা এবং তাদের উৎসবে অংশগ্রহণ করা কি জায়েয।
উত্তর : মুসলিমদের জন্য এ সমস্ত কাজ করা হারাম। এতে ঈমান এবং ইসলাম ভঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ এগুলো মূর্তিপূজার উৎসব, যা কুফ্র ও শিরকে পরিপূর্ণ। এ ধরনের কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করা যাবে না এবং তাদের নীতি অবলম্বন করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাক্বওয়ায় পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরষ্পরে সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যধিক কঠোর’ (সূরা আল-মায়িদা: ২)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে (আল-মায়িদাহ ৫১)। রাসূল (ﷺ) বলেন, যে অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে (আবুদাঊদ হা/৪০৩১, সনদ ছহীহ)। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
لَا تَدْخُلُوا عَلَى الْمُشْرِكِينَ فِي كَنَائِسِهِمْ يَوْمَ عِيدِهِمْ فَإِنَّ السَّخْطَةَ تَنْزِلُ عَلَيْهِمْ
তোমরা মুশরিকদের উৎসবের দিন তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশ কর না। কারণ তাদের উপর গযব নাযিল হয় (বাহয়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৮৮৬১, সনদ ছহীহ)। অন্যত্র তিনি বলেন,
اجْتَنِبُوا أَعْدَاءَ اللهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى فِي عِيدِهِمْ يَوْمَ جَمْعِهِمْ , فَإِنَّ السَّخَطُ يَنْزِلُ عَلَيْهِمْ فَأَخْشَى أَنْ يُصِيبَكُمْ
তোমরা আল্লাহর শত্রু ইহূদী-নাছারাদের উৎসব থেকে বিরত থাক। কারণ তাদের উপর গযব নাযিল হয়। আমি আশঙ্কা করছি যে, সেই গযব তোমাদের উপরেও নাযিল হবে (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৮৯৪০)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
مَنْ بَنَى بِبِلَادِ الْأَعَاجِمِ وَصَنَعَ نَيْرُوزَهُمْ وَمِهْرَجَانَهُمْ وَتَشَبَّهَ بِهِمْ حَتَّى يَمُوتَ وَهُوَ كَذَلِكَ حُشِرَ مَعَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ "
যে ব্যক্তি অমুসলিম দেশে বাড়ী তৈরি করবে এবং তাদের অনুকরণে নববর্ষ ও তাদের উৎসব পালন করে মারা যাবে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে তাদের সাথেই উঠানো হবে (বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৮৮৬৩, সনদ ছহীহ)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَأَمَّا التَّهْنِئَةُ بِشَعَائِرِ الْكُفْرِ الْمُخْتَصَّةِ بِهِ فَحَرَامٌ بِالِاتِّفَاقِ কাফেরদের বিশেষ প্রতীক ব্যবহার করে শুভেচ্ছা জানানো সকলের ঐকমত্যে হারাম (আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ১/৪৪১ পৃ.)। উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
يحرم على المسلمين التشبه بالكفار بإقامة الحفلات بهذه المناسبة، أو تبادل الهدايا أو توزيع الحلوى، أو أطباق الطعام، أو تعطيل الأعمال ونحو ذلك
কাফেরদের অনুকরণে উৎসব আয়োজন করা, শুভেচ্ছা বা উপহার বিনিময় করা, মিষ্টান্ন বিতরণ, রকমারি খাদ্য তৈরী করা, ছুটি ঘোষণা করা মুসলিমদের জন্য হারাম (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৪৬ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : মুনীর, ময়মনসিংহ।
প্রশ্ন (২৩) : রাসূল (ﷺ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে সমস্ত নবীর ক্বিবলাহ বাইতুল মাক্বদিছ ছিল এই কথাটি কি সঠিক?
উত্তর : কথাটি ডাহা মিথ্যা। শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
أن الكعبة كانت قبلة الأنبياء كلهم وأن اتجاه اليهود إلى بيت المقدس والنصارى إلى المشرق كان من جملة تحريفهم الذي حرفوا به دينهم
‘সমস্ত নবীর ক্বিবলাহ কা‘বা-ই ছিল, পরবর্তীতে ইয়াহুদীরা বাইতুল মাক্বদিছের দিকে এবং খ্রিস্টানরা পূর্ব দিকে পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন, তারা তাদের ধর্মের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে’ (শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন, তাফসীরুল কুরআনিল কারীম, সূরাতুল বাক্বারাহ-এ ২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.; যঃঃঢ়ং://িি.িধষধঃযধৎ.হবঃ/যড়সব/বংড়ঁহফ/রহফবী.ঢ়যঢ়?ড়ঢ়=পড়ফর্বাপড়রফ=৯১৭৫০)। আবূ জা‘ফর ইবুন জারীর (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন,
بأن القبلة (الكعبة) هي قبلة إبراهيم، وقبلة الأنبياء من بعده، وأهل الكتاب يعرفون هذا، ومع هذا أحدثوا قبلة أخرى، كما سبق
‘কা‘বা হল ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ক্বিবলাহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণেরও। আহলে কিতাবরা এটি জানত। তারপরেও তারা অন্য ক্বিবলাহ তৈরি করেছিল’ (তাফসীরুত্ব ত্বাবারী, ৩/১৮৭-১৮৮; তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১/৪৬২ পৃ.)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আহলে কিতাবদের ক্বিবলা পরিবর্তন করার বিষয়টি অহীর বিধান বা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অনুযায়ী হয়নি। বরং তারা নিজেরাই পরামর্শ করে করেছে। আল্লাহ তা‘আলা কখনো ইঞ্জিল বা অন্য কোথাও খ্রিস্টানদেরকে পূর্ব দিকে ক্বিবলা নির্ধারণ করার আদেশ দেননি। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাওরাত বা অন্য কোথাও ইয়াহুদীদেরকে ‘ছখরাহ আল-বাত্তাহ’-এর দিকে ক্বিবলাহ নির্ধারণ করার আদেশ দেননি। বরং তারা নিজেরাই সেদিকে মুখমণ্ডল করে ছালাত আদায় করত’ (আল-বাদাঈয়ু ওয়াল ফাওয়াঈদ, ৪/১৬০৫ পৃ.)। শায়খ তাহির ইবনু ‘আশূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখুন, ইয়াহুদীরা বাইতুল মাক্বদিসকে নিজেদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী ক্বিবলাহ বানিয়েছে। তাদের দ্বীনে এ সম্পর্কে কোন নির্দেশনা নেই। তাওরাতের কোন খণ্ডে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না’ (আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ২/৯-১০ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : খালেদ আহমাদ, ঢাকা।
প্রশ্ন (২৪) : কুরআনের হাফিয ১০/৭০ জনের জন্য সুপারিশ করবে এ মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে কি?
উত্তর : উক্ত মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না। কুরআনের হাফিয ১০ জনের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যঈফ। যেমন- ‘যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে এবং মুখস্থ রাখে, এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মনে করে। তাকে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশজন লোক সম্পর্কে তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম অনিবার্য ছিল’। হাদীছটি অত্যন্ত যঈফ। ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
هَذَا حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ لَا نَعْرِفُهُ إِلَّا مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَلَيْسَ إِسْنَادُهُ بِصَحِيْحٍ . وَحَفْصُ بْنُ سُلَيْمَانَ يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيْثِ.
‘এ হাদীছটি গরীব। আমরা শুধু উপরিউক্ত সূত্রেই এ হাদীছ জেনেছি। এর সনদ ছহীহ নয়। হাফছ ইবনু সুলাইমান হাদীছ শাস্ত্রে দুর্বল’ (তিরমিযী, হা/২৯০৫)। ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীছটি দুর্বল (যঈফুল জামে‘, হা/৪৬৬২; যঈফ তিরমিযী, হা ২৯০৫; তাখরীজু মিশকাত, হা/২০৮৩)। শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর সনদে হাফ্ছ ইবনু সুলাইমান নামক রাবী পরিত্যাজ্য (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৭/৩২৩ পৃ.)। ৭০ জনকে সুপারিশ করবে মর্মে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
প্রশ্নকারী : মাযহার, গাজীপুর।
প্রশ্ন (২৫) : হিজড়ারা জিনের সন্তান। এ দাবী কি সঠিক?
উত্তর : প্রশ্নে উল্লেখিত কথাটি সঠিক নয়। কেননা এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে যে উক্তিটি বর্ণনা করা হয়ে থাকে, তা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, যঈফ হাদীছের আলোকে শরী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয় না। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি বলেছেন, ‘হিজড়ারা জিনের সন্তান। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে জিজ্ঞেস করা হল যে, এটা কী করে সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) ঋতুবতী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যখন কোন ব্যক্তি ঋতুবতী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে আসে তখন শয়তান তার উপর বিজয়ী হয়। ফলস্বরূপ স্ত্রী গর্ভবতী হয় এবং হিজড়া সন্তান প্রসব করে’ (আকামুল মারযান ফী আহকামিল জান্ন, ১/৯৩ পৃ.)। ইবনু আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বর্ণনাটি জাল ও বানোয়াট’ (আল-কামিল ফিয যু‘আফা, ৬/২৯৫ পৃ.)। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বর্ণনাটি মুনকার বা প্রত্যাখ্যাত’ (মীযানুল ই‘তিদাল, ৪/৩৬৩ পৃ.)। ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বর্ণনাটি মুনকার বা অস্বীকৃত’ (আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ৬০/৭৯ পৃ.)।
ইসলাম এদের মানবসন্তান হিসাবেই আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে, যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সব বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়াটা মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাক্বওয়াই হল মান-মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৩২০০৮৯)।
প্রশ্নকারী : আব্দুল মালেক, শেরপুর।
প্রশ্ন (২৬) : জমি বন্ধক রাখা কি জায়েয? উভয়ের সম্মতি অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একবিঘা জমি নিলাম। যতদিন টাকা আমাকে ফেরত না দিবে ততদিন জমি ভোগ করব। এটা কি শরী‘আত সম্মত?
উত্তর : উক্ত পদ্ধতিতে জমি বন্ধক রাখা এবং তার দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। এটা স্পষ্ট সূদী ঋণের অন্তর্ভুক্ত, যা হারাম (বুখারী, হা/৩৮১৪; বায়হাক্বী, শু‘আাবুল ঈমান হা/৫৫৩৩; মিশকাত, হা/২৮৩৩)। ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ঋণের নিরাপত্তা স্বরূপ জমি-জায়গা, গৃহ, বৃক্ষ, দোকান, গাড়ি, পোশাক, অলংকার অথবা এছাড়া অন্য কিছু বন্ধক রাখা দোষনীয় নয়। কিন্তু যদি বন্ধকগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত উক্ত জমি চাষ করে লাভবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তবে তা সূদ হিসাবে বিবেচিত হবে, আর এটি নাজায়েয। কেননা এর অর্থ এটিই যে, সে ঋণ প্রদানের বিনিময় স্বরূপ তার থেকে লাভবান হচ্ছে, সুতরাং এটি জায়েয নয়। এই রকম হারাম বাহানা বা অজুহাত থেকে সতর্ক থাকা অপরিহার্য। রাসূল (ﷺ)-এর ছাহাবীগণ ঋণ প্রদানের বিনিময় স্বরূপ ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে কোন কিছু গ্রহণ করা সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটি সূদের অন্তর্ভুক্ত। জমি বা বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন ফসলে বন্ধকগ্রহীতার কোন অংশ নেই। বরং উক্ত ফসল বা ফল জমির মূল মালিকের হবে, অথবা ঋণদাতা ইজারা বা লীজ (খবধংব) হিসাবে চাষ করতে পারে, সেক্ষেত্রে সেই এলাকার বাজারদর হিসাবে লীজের মূল্য মূল মালিককে প্রদান করতে হবে, অথবা সেই পরিমাণ ঋণ বিয়োগ করতে হবে’ (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব ইবনে বায, ১৯/২০০-২০৪; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১৯/৩১০-৩১১ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৮৩৩২১)।
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘ঋণদাতার জন্য ঋণগ্রহীতার নিকট ঋণ প্রদানের বিনিময়ে লাভবান হওয়ার শর্তারোপ করা জায়েয নয়। আলেমগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সুতরাং ঋণ প্রদানের বিনিময়ে জমি থেকে উৎপন্ন ফসল দ্বারা লাভবান হওয়া জায়েয নয়। কেননা বন্ধকের উদ্দেশ্যে হল- মালের নিরাপত্তা ও ঋণ আদায়ে সহায়তা করা, লাভবান করা নয়’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ১৪/১৭৭-১৭৮ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : ওয়াহিদুল ইসলাম, নওগাঁ।
প্রশ্ন (২৭) : কোন ফার্মাসিস্ট বাচ্চা নষ্ট করার ওষুধ বিক্রয় করলে গুনাহ হবে কি?
উত্তর : যে জিনিসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হারাম কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা তৈরি করা, বিক্রয় করা ও মেরামত করাও হারাম। সেজন্য সকল মুসলিমের উচিত এমন প্রত্যেক জিনিসের বিক্রয় থেকে বিরত থাকা যা ন্যায়ের তুলনায় অন্যায় কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২৬/২৭৩ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১০১০১, ২৯১১৬৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی، وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ، وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ
‘তোমরা সৎকর্ম ও তাক্বওয়ায় পরস্পর সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা কর না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যধিক কঠোর’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ২)। সুতরাং সর্বদা হালাল-হারামের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে এবং হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে থাতে হবে। ইসলামী শরী‘আতের স্থিরীকৃত নীতিমালাসমূহের মধ্যে রয়েছে যে, إذا اجتَمَع الحلالُ والحرامُ غُلِّبَ الحرامُ ‘যখন কোন বিষয়ে হালাল ও হারামের মাসআলা একত্রিত হয়, তখন হারামের মাসআলা প্রাধান্য পায় অর্থাৎ সেটাকে হারাম বলে গণ্য করতে হবে’।
নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট, আর উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে, আর যে লোক সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯)।
প্রশ্নকারী : মাইনুল ইসলাম, কুমিল্লা।
প্রশ্ন (২৮) : ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’-এটি কি ছহীহ হাদীছ?
উত্তর : হাদীছটি বানোয়াট। এর সনদে মূসা বিন মুহাম্মাদ বিন ‘আত্বা নামে একজন রাবী রয়েছে, সে মুনকার এবং হাদীছ চোর (ইবনু ‘আদী, আল-কামেল ফীয যু‘আফা, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৬৪)। তবে এ মর্মে বর্ণিত নিম্নের হাদীছটি ছহীহ। যেমন, মু‘আবিয়াহ বিন জাহিমাহ আস-সুলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
أَنَّ جَاهِمَةَ جَاءَ إِلَى النَّبِىِّ ﷺ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيْرُكَ. فَقَالَ هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ. قَالَ نَعَمْ. قَالَ فَالْزَمْهَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا
‘একদা মু‘আবিয়াহ বিন জাহিমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি যুদ্ধে যেতে চাই। আর এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কামনা করছি। উত্তরে তিনি বলেন, তোমার মা জীবিত আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাঁর খিদমতে লেগে থাক। কারণ জান্নাত তাঁর দু’পায়ের নিচে’ (নাসাঈ, হা/৩১০৪; সনদ হাসান)।
প্রশ্নকারী : আখতার, ঝিনাইদহ।
প্রশ্ন (২৯) : মসজিদে একই কাতারের বাম পাশ অপেক্ষা ডান পাশে বসা বা ছালাত আদায় করার মধ্যে বিশেষ কোন ফযীলত আছে কি?
উত্তর : কাতারের ডান বা বাম পাশে বসা বা ছালাত আদায় করার মধ্যে বিশেষ কোন ফযীলত নেই। প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর ফযীলত রয়েছে (বুখারী, হা/৭২১; মুসলিম, হা/৪৩০)। কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানোর ফযীলত সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তা যঈফ (আবুদাঊদ, হা/৬৭৬)। বরং ডান কিংবা বাম দিক থেকে কাতার পূরণ না করে ইমামের পিছন থেকেই কাতার করতে হবে। আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, صَلَّى النَّبِىُّ ﷺ فِىْ بَيْتِ أُمِّ سُلَيْمٍ فَقُمْتُ وَيَتِيْمٌ خَلْفَهُ وَأُمُّ سُلَيْمٍ خَلْفَنَا . ‘একদা নবী করীম (ﷺ) উম্মু সুলাইমের বাড়ীতে ছালাত আদায় করলেন। আমি এবং একজন ইয়াতীম তাঁর পিছনে দাঁড়ালাম। আর উম্মু সুলাইম আমাদের পিছনে দাঁড়ালেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৮৭৪)।
প্রশ্নকারী : আবুল কালাম, সিলেট।
প্রশ্ন (৩০) : জনৈক আলেম বলেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন আগে আগে মসজিদে উপস্থিত হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ মর্মে কোন দলীল আছে কি?
উত্তর : যার মাঝে পাঁচটি গুণ থাকবে সে জান্নাতে যাবে। ঐ পাঁচটি গুণের একটি হল, জুম‘আর দিনে আগে আগে মসজিদে যাওয়া। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ أبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ خَمْسٌ مَنْ عَمِلَهُنَّ فِيْ يَوْمٍ كَتَبَهُ اللهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ مَنْ عَادَ مَرِيْضًا وَشَهِدَ جَنَازَةً وَصَامَ يَوْمًا وَرَاحَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَأَعْتَقَ رَقَبَةً
আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি এক দিনে পাঁচটি আমল করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতের অধিবাসী করবেন। যে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায়, কোন জানাযায় উপস্থিত হয়, এক দিন ছিয়াম পালন করে, জুমার দিন আগে আগে মসজিদে যায় এবং ক্রীতদাস স্বাধীন করে দেয় (ইবনে হিব্বান হা/২৭৬; সনদ ছহীহ)।
প্রশ্নকারী : ছিফাত, মাদারীপুর।