বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২১ অপরাহ্ন
উত্তর :‘ওয়াহ্হাবী’ কথাটি কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী আহলুল হাদীছ বা সালাফীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত গালি হিসাবে সমাজে প্রচলিত। এটা মিথ্যাচার, তথ্য সন্ত্রাস এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। অন্যান্য বিকৃত মাযহাবের মত এটা কোন মাযহাবও নয়। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) শিরক-বিদ‘আত ও জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে যে সংস্কার আন্দোলন করেছিলেন, সেটা ছিল রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কেরামের দাওয়াত ও তাবলীগের অনুকরণে একটি বিশেষ শুদ্ধি আন্দোলন। আর আহলেহাদীছগণও সারা বিশ্বে এই সংস্কারমূলক দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তাই পথভ্রষ্ট বিদ‘আতী ও মাযারপূজারীরা এই সংস্কার আন্দোলনকে সহ্য করতে না পেরে আহলেহাদীছ বা সালাফীদেরকে ‘ওয়াহ্হাবী’ নামে চিত্রিত করে এবং অপপ্রচার চালায়।

১২০০ হিজরী শতক বা ১৭০০ খ্রিষ্টীয় শতকে যখন সঊদী আরবের মুসলিমরা জাহিলিয়্যাতের যুগের ন্যায় পুনরায় শিরকের গভীর গহিনে হাবুডুবু খাচ্ছিল। বিদ‘আত ও কুসংস্কারের কালো মেঘে ঢাকা পড়েছিল সুন্নাতের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন আকাশ। ঠিক তখনই ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (রাহিমাহুল্লাহ) রাসূল (ﷺ)-এর দেখানো পদ্ধতিতে আরবের বুক থেকে শিরক ও বিদ‘আতকে উৎখাত করে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারীদের নিয়ে সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন। এটাই ছিল তাঁর অপরাধ। তিনি তৎকালীন সঊদী আরবের শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সাঊদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূপৃষ্ঠের উপর থেকে কুসংস্কার, জাহিলিয়্যাত ও শিরকের মূলোৎপাটন করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমেই সঊদী আরবকে শিরকমুক্ত করেছিলেন। এরপর থেকেই মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব নামটি মাযার পূজারী, ক্ববর পূজারী, বিদ‘আতীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, যখনই কেউ ক্ববর, মাযার বা বিদ‘আতের প্রতিবাদ করে, তখন তাঁকে ওয়াহ্হাবী, নবীর দুশমন ইত্যাদি অপবাদ দেয়া হয়।

‘ওয়াহ্হাবী’ নামটি এ আন্দোলনের কর্ণধার মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব বা তাঁর অনুসারীদের দেয়া নয়। পরবর্তীতে বিদ্বেষবশতঃ এই নামে চিত্রিত করা হয়েছে। হাসান ইবনু আব্দুল্লাহ আলে শায়খ এ সম্পর্কে বলেন, ‘ওয়াহ্হাবিয়্যাহ বিশেষণটি এ আন্দোলনের অনুগামীরা সৃষ্টি করেনি। বরং তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পৃথক করার জন্য এটা ব্যবহার করে যেন মানুষ তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং শ্রোতারা মনে করে যে, এ আন্দোলন প্রচলিত বড় বড় চারটি মাযহাবের বিপরীতে পঞ্চম একটি মাযহাব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এ আন্দোলনের কর্মীরা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ এবং তাদের দাওয়াতকে ‘সালাফী দাওয়াত’ বলে আখ্যায়িত করাকেই অধিক পসন্দ করতেন (আল-ওয়াহ্হাবিয়াহ ওয়া যাঈমুহা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব, ৮/৮২১ পৃ.)। ষড়যন্ত্রমূলক এই কথাটি আজও সারাবিশ্বে প্রচলিত। অথচ আসল রহস্য অনেকেই জানে না।


প্রশ্নকারী : আব্দুর রহমান, মাদারীপুর।
প্রশ্ন (২) : মসজিদে হারাম বা মসজিদে নববীর চত্বরে ছালাত আদায় করলে কি মূল মসজিদে ছালাত আদায় করার সমান ছাওয়াব পাওয়া যাবে?
উত্তর : অবশ্যই পাওয়া যাবে। রাসূল (ﷺ) বলেন,

‏صَلَاةٌ فِيْ مَسْجِدِيْ أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيْمَا سِوَاهُ إِلَّا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيْمَا سِوَاهُ‏.‏

‘মসজিদুল হারাম ব্যতীত অন্যান্য মসজিদের ছালাত অপেক্ষা আমার মসজিদের ছালাত হাযার গুণ শ্রেষ্ঠ (ফযীলতপূর্ণ)। অন্যান্য মসজিদের ছালাতের তুলনায় মসজিদুল হারামের ছালাত এক লক্ষ গুণ উত্তম (ফযীলতপূর্ণ)’ (ছহীহ বুখারী, হা/১১৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৯৪-১৩৯৫)। উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীর পরবর্তী সংযোজনগুলো বা আজও যে অংশগুলো ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সেগুলো একই নিয়মের আওতাধীন। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে মূল মসজিদে যেমন ছাওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়, ঠিক তেমনি এখানে ছালাত আদায় করলেও বহুগুণ বেশি নেকী অর্জিত হয়। যদিও এই বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে, তবে অধিকাংশ আলেমের মতানুযায়ী ‘নেকীর দিক থেকে মূল এবং সম্প্রসারিত স্থানের বিধান একই। মূল মসজিদে ছালাত আদায় করা হোক কিংবা পরবর্তীতে সম্প্রসারিত স্থানে, নেকীর পরিমাণ একই। অর্থাৎ মসজিদে নববী বা মসজিদে হারামের যে অংশেই ছালাত আদায় করা হোক না কেন, ১ হাজার গুণ বা ১ লাখ গুণ বেশি নেকী পাওয়া যাবে’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাত ইবনে বায, ১২/২৩১; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল ইবনে উছাইমীন, ২৩/৪২২; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩৬৫৭৮, ৪৫৭৮১৮)।

ইবনু রজব হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মসজিদে নববী বা মসজিদে হারামের যে অংশসমূহ বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলোর গুরুত্ব-মাহাত্ম্য ও ছাওয়াবের পরিমাণ মূল মসজিদের সমতুল্য-ই। এই ব্যাপারে সালাফে ছালিহীনের কেউ কোন মতপার্থক্য করেননি। কেবল পরবর্তীতে কিছু আলেম মতপার্থক্য করেছেন। ‘কিতাবু আখবারিল মাদীনা’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি মসজিদে নববী বৃদ্ধি হতে হতে ‘জাবানাহ’ কিংবা ‘যুল হুলাইফাহ’ পর্যন্তও বিস্তীর্ণ হয়ে যায়, তবুও সেটি মসজিদের মূল অংশ হিসাবেই পরিগণিত হবে’ (ফাৎহুল বারী ইবনে রজব, ২/৪৭৯ পৃ.)। আর রাসূল (ﷺ)-এর যুগে মসজিদে হারাম বা মসজিদে নববীর যে আয়তন ছিল, চাহিদা অনুযায়ী যুগে যুগে তার বৃদ্ধিকরণ করা হয়েছে। ইবনে আবিদীন ও শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন, ‘মূল ও প্রসারিত অংশের ছাওয়াবের পরিমাণ একই। প্রকাশ থাকে যে, মসজিদে নববী বিভিন্ন সময়ে প্রসারিত করা হয়েছে। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু), উছমান ইবনু আফফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু), ওয়ালীদ অতঃপর মাহদীর যুগে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। অতিরিক্ত অংশটি যদি মূল মসজিদের সমতুল্য‌‌‌ না হত তাহলে নিশ্চয় খলীফাগণ বৃদ্ধি করতেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে বিস্তৃত অংশ সহ সমস্ত অংশটাকেই মসজিদে নববী বলা হয়। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী, উদ্বৃত্ত অংশে ছালাত আদায় করলেও হাদীছে বর্ণিত অতিরিক্ত নেকী পাওয়া যাবে’ (আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়্যাহ, ৩৭/২৫১ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : মুহাম্মাদ আতিক, বগুড়া।
প্রশ্ন (৩) : আম বা যেকোন ফলের গাছ ২/৫ বছরের চুক্তিতে অগ্রিম বিক্রি করা যাবে কি?
উত্তর : ফল পোক্ত হওয়া বা পাকার উপযুক্ত হওয়ার আগে বিক্রি করা নিষিদ্ধ। যেমন রাসূল (ﷺ) কয়েক বছরের চুক্তিতে ফলের গাছ বা বাগান বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম হা/১৫৩৬ ও ১৫৩৪)। অন্য হাদীছে বলেন,

لَا تَبْتَاعُوا الثَّمَرَ حَتَّى يَبْدُوَ صَلَاحُهُ وَتَذْهَبَ عَنْهُ الآفَةُ قَالَ يَبْدُوَ صَلَاحُهُ حُمْرَتُهُ وَصُفْرَتُهُ

ফল পরিপক্ক হওয়ার আগে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পূর্বে তোমরা ফল ক্রয় করো না। রাবী বলেন, খাওয়ার যোগ্য হওয়ার অর্থ হল, লাল বর্ণ ও হলদে রং ধারণ করা (মুসলিম হা/১৫৩৪; বুখারী হা/২১৮৩)। এ মর্মে আরো অনেক হাদীছ এসেছে। আর অধিকাংশ ফক্বীহ এটাই বলেছেন। তবে কেউ কেউ জমি লিজ নেওয়ার উপর ক্বিয়াস করে ফলের বাগান ভাড়া দেয়াকে জায়েয বলেছেন। যেমন ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইবনু উছায়মীন প্রমুখ (মাজমুউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৯শ খণ্ড, পৃ. ৫৯, ৩০শ খণ্ড, পৃ. ১৫১-১৫২; যাদুল মা‘আদ, ৫/৮২৫, ৬/২০৩-২০৮; আশ-শারহুল মুমৃিত‘, ৬/৯০)।


প্রশ্নকারী : আব্দুল আলীম বিন মঈনুল, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
প্রশ্ন (৪) : এমন সংগীত যেখানে বাদ্য-যন্ত্রের ব্যবহার খুব‌ই কম এবং মুহাম্মাদ রাফী, তালাত মাহমুদ প্রভৃতিদের গাওয়া গান কি শোনা জায়েয হবে? এ সকল গানে কোন অশ্লীলতা, কিংবা যৌন উত্তেজনা সম্পর্কিত কিছু নেই। এগুলো শোনা কি জায়েয হবে?
উত্তর : বাজনা বা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা ইসলামে হারাম (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১১/৫৩৫-৫৭৭; তাফসীরে ত্বাবারী, ২১/৪০; তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৩/৪৫১; ফাৎহুল বারী, ১০/৫৫ পৃ.)। অশ্লীলতার ধারক-বাহক ও প্রচারকদের শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ

‘নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ‌ জানেন, তোমরা জানো না’ (সূরা আন-নূর: ১৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতাকে, পাপাচারকে ও অসংগত বিদ্রোহকে’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ৩৩)।

গান-বাজনা ইসলামে চিরতরে হারাম। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কতক লোক মদের ভিন্নতর নামকরণ করে তা পান করবে। আর (পাপাসক্ত অবস্থায়) তাদের সামনে বাদ্যবাজনা চলবে এবং গায়িকা নারীরা গীত পরিবেশন করবে। আল্লাহ তা‘আলা এদেরকে মাটির নিচে ধসিয়ে দিবেন এবং তাদের কতককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন’ (ইবনু মাজাহ, হা/৪০২০; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৮৮)। সুতরাং গান গাওয়া ব্যক্তি মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম তাতে কোন যায় আসে না। আর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যতই কম থাকুক না কেন, তবুও হারাম। তবে হ্যাঁ, এমন মিউজিক বিহীন গান যার শব্দগুলো রুচিসম্মত এবং তা ইসলামিক চিন্তাধারার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়, এমন নাশীদ বা গীত শ্রবণ করা দোষনীয় নয়। যেমন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘মিউজিক এবং অতিরঞ্জিত নিষিদ্ধ কথাবার্তা থেকে মুক্ত গজল, কবিতা, দেশাত্মবোধক গান অথবা গীত শ্রবণ করা দোষনীয় নয়। দাফ্‌ ব্যতীত অন্য কোন বাজনা বা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হারাম।

অনুরূপভাবে পুরুষদের জন্য নারীদের কন্ঠ শ্রবণ করাও হারাম। তবে এর চাইতে উত্তম হল- নিজের অতিরিক্ত সময় কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, নির্ভরযোগ্য বক্তার বক্তব্য শ্রবণ অথবা কোন শাইখের দারস্ শ্রবণ করা। যা তার উভয় জগতের জন্যই কল্যাণকর হবে’ (লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ১৪/১১১ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৩৮০৯৩৩)। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম ও ইমাম শাত্বিবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন,  ِسَدُّ الذَّرَائِع ‘পাপের দরজা বন্ধ করার লক্ষ্যে বাজনা বিহীন হলেও গান শ্রবণ না করাই উচিত। এমন প্রত্যেক বৈধ কাজ যা মানুষকে অবৈধ কাজের দিকে ধাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তার মধ্যে যদি কোন শারঈ কল্যাণ না থাকে, তবে সেটি অবৈধ হিসাবেই বিবেচিত হবে’ (ফাতাওয়া আল-কুবরা, ৪/৪৬৫; ইগাছাতুল লাহফান, ১/৪২৬-৪২৭; আল-মুওয়াফিক্বাত, ৫/১৭৯-১৮২ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : আহমাদ আবিদ, লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী।
প্রশ্ন (৫) : এক সন্তানের বয়স ১৫ বছর, আরেক সন্তানের বয়স ৯ বছর। তাদের আক্বীক্বা দেয়া হয়নি। এখন তাদের আক্বীক্বা দেয়া যাবে কি? গরু বা মহিষ দ্বারা আক্বীক্বা করা যাবে কি?
উত্তর : সপ্তম দিনে আক্বীক্বা করা সুন্নাত (আবুদাঊদ হা/২৮৩৮; ইবনু মাজাহ হা/৩১৬৫, সনদ ছহীহ)। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না (নায়লুল আওত্বার, ৬/২৬১ পৃ.)। তবে সঙ্গত কারণে যদি সময়মত আক্বীক্বা করা সম্ভব না হয়, পরবর্তীতে সুযোগ মত যেকোন সময় আক্বীক্বা করা যায় (ইবনুল ক্বাইয়িম, তুহফাতুল মাওদূদ, পৃ. ৬৩; আলবানী, সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, অডিও ক্লিপ নং-১৯৯; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমা, ফৎওয়া নং-১৭৭৬; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল লিউছায়মীন, ২৫/২১৫ পৃ.)। বিদ্বানগণের মতে, সাত দিনে আক্বীক্বার বিষয়টি সীমা নির্দেশমূলক নয়, বরং এখতিয়ার মূলক। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সাত দিনে আক্বীক্বার অর্থ হল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না’ (নায়লুল আওত্বার, ৬/২৬১ পৃ.)। অভিভাবক আক্বীক্বা না দিলে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে নিজেই নিজের আক্বীক্বা করতে পারে (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, মাসআলা নং-৭৮৯৮; মাজমূঊ ফাতাওয়া বিন ইবনি বায, ২৬/২৬৬ পৃ.)। খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি আমি জানতাম যে, আমার পক্ষে আক্বীক্বা দেয়া হয়নি, তবে অবশ্যই আমি নিজেই নিজের আক্বীক্বা করতাম (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/২৪৭১৮; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭২৬-এর আলোচনা দ্র.)। হাসান বছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন যে, ‘যদি তোমার পক্ষ থেকে আক্বীক্বা দেয়া না হয়, তবে তুমি নিজেই নিজের আক্বীক্বা দাও, যদিও তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তি হও’ (ইবনু হাযম, মুহাল্লা, ৬/২৪০ পৃ.; সনদ হাসান, আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৭২৬-এর আলোচনা দ্র.)। আক্বীক্বার ক্ষেত্রে গরু ও মহিষ দেয়ার ছহীহ দলীল নেই।


প্রশ্নকারী : ইয়াসমিন, রাণীগঞ্জ, দিনাজপুর।
প্রশ্ন (৬) : এক সফরে একাধিক ওমরাহ করা যাবে কি?
উত্তর : এক সফরে একটি ওমরা করা সুন্নাত। এটাই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কারণ রাসূল (ﷺ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম এক সফরে একাধিক উমরা করেছেন মর্মে কোন দলীল পাওয়া যায় না। রাসূল (ﷺ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম এক সফরে অনেক দিন মক্কায় অবস্থায় করেছেন, কিন্তু তাঁরা একাধিক ওমরা করেননি। তাছাড়া ঋতুবতী হওয়ার কারণে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হজ্জের পরে তানঈম থেকে তাঁর ভাই আব্দুর রহমান-এর সাথে যে উমরাহ করেছিলেন, সেখানে শুধু আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ইহরাম বেঁধে ওমরা পালন করেছিলেন। আব্দুর রহমান ওমরা করেননি (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৬২৬-এর আলোচনা দ্র.; ছহীহ মুসলিম, হা/১২১১; ছহীহ বুখারী, হা/১৭৮৪ ও ২৯৮৪)। একাধিক ওমরা করার অনুমতি থাকলে আব্দুর রহমানও তাঁর সাথে ওমরা করতেন। তাই আমাদের উচিত তাঁদের মানহাজ অনুসরণ করা। আর ইখতিলাফী বিষয় হিসাবে একে গুরুত্ব দেয়ার কোন প্রসঙ্গ নেই।

তাছাড়া ওমরা করার সময় মাথা মুণ্ডন করা বা চুল ছোট করা ওয়াজিব (সূরা আল-ফাত্হ ২৭; সূরা আল-বাক্বারাহ ১৯৬; ছহীহ বুখারী, হা/১৭২৮)। এই ওয়াজিব পালনের জন্য মাথায় চুল গজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যরূরী। তাই বিরতিহীনভাবে পর পর ওমরা করলে মাথার চুল গজাবে কিভাবে এবং মুণ্ডন করবে কিভাবে? আর রাসূল (ﷺ) মাথার চুল মুণ্ডন করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন (ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮ ও ১২১৬; মিশকাত হা/২৫৫৫)। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সন্তান বলেন,

كُنَّا مَعَ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ بِمَكَّةَ فَكَانَ إِذَا حَمَّمَ رَأْسُهُ خَرَجَ فَاعْتَمَرَ

আমরা আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে মক্কায় ছিলাম। যখন তাঁর মাথায় চুল উঠে কালো হয়ে যেত, তখন তিনি বের হতেন এবং ওমরা করতেন (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৮৭৩০; মুসনাদুশ শাফেঈ হা/৭৭৮)। আত্বা ইবনুস সায়েব বলেন, إنْ شَاءَ  বলেন, اعْتَمَرْنَا بَعْدَ الْحَجِّ فَعَابَ ذَلِكَ عَلَيْنَا سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ. ‘আমরা কিছু লোক হজ্জের পরে ওমরা করেছিলাম। তাই সাঈদ ইবনু জুবাইর আমাদেরকে দোষারোপ করেন’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/২৬৫ পৃ.)। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

إذَا اعْتَمَرَ فَلَا بُدَّ مِنْ أَنْ يَحْلِقَ أَوْ يُقَصِّرَ وَفِي عَشَرَةِ أَيَّامٍ يُمْكِنُ حَلْقُ الرَّأْسِ

‘যখন কেউ ওমরা করবে তখন তার জন্য ওয়াজিব হল, মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করা। আর দশ দিন অতিবাহিত হলে মাথার চুল মুণ্ডন করার মত হয়’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/২৭০ পৃ.)। ইমাম ইবনু কুদামা (৫৪১-৬২০ হি.) বলেন, فَظَاهِرُ هَذَا أَنَّهُ لَا يُسْتَحَبُّ أَنْ يَعْتَمِرَ فِي أَقَلَّ مِنْ عَشَرَةِ أَيَّامٍ. ‘এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, দশ দিন বিরতির কমে ওমরা করা উচিত নয় (আল-মুগনী, ৩/২২০ পৃ.)।

বুঝা যাচ্ছে যে, এক ওমরার থেকে আরেক ওমরার মাঝে বেশ কিছুদিন ব্যবধান রাখা উচিত। অন্তত মাথায় চুল গজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ইবনু কুদাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

أَقْوَالُ السَّلَفِ وَأَحْوَالُهُمْ تَدُلُّ عَلَى مَا قُلْنَاهُ وَلِأَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَصْحَابَهُ لَمْ يُنْقَلْ عَنْهُمْ الْمُوَالَاةُ بَيْنَهُمَا، وَإِنَّمَا نُقِلَ عَنْهُمْ إنْكَارُ ذَلِكَ، وَالْحَقُّ فِي اتِّبَاعِهِمْ

‘সালাফদের কথা ও তাঁদের অবস্থা দ্বারা সেটাই প্রমাণিত হয় যা, আমরা আলোচনা করলাম। কারণ নবী করীম (ﷺ) ও তাঁর ছাহাবীদের থেকে ধারাবাহিকভাবে ওমরা করার কথা বর্ণিত হয়নি। বরং তাঁদের থেকে বিপরীতটাই বর্ণিত হয়েছে। আর হক্ব তাঁদের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে (আল-মুগনী, ৩/২২০ পৃ.)। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বলেন,

لَا يُسْتَحَبُّ الْإِكْثَارُ مِنْ الْعُمْرَةِ لَا مِنْ مَكَّةَ وَلَا غَيْرِهَا بَلْ يَجْعَلُ بَيْنَ الْعُمْرَتَيْنِ مُدَّةً وَلَوْ أَنَّهُ مِقْدَارُ مَا يَنْبُتُ فِيْهِ شَعْرُهُ وَيُمْكِنُهُ الْحِلَاقُ

‘মক্কা থেকে বা মক্কার বাইর থেকে বেশি বেশি ওমরা করা উচিত নয়। বরং দুই ওমরার মাঝে কিছুদিন ব্যবধান থাকা উচিত। যদিও সময়টি মাথায় চুল গজানো এবং চুল মুণ্ডন করার অবস্থা পর্যন্ত হয়, তুবও ব্যবধান রাখা উচিত (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৪৫ পৃ.)। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেন,

مَنْ يَرَى الْعُمْرَةَ مِنْ مَكَّةَ كُلَّ يَوْمٍ عُمْرَةً أَوْ عُمْرَتَيْنِ فَهَذَا مَكْرُوْهٌ بِاتِّفَاقِ سَلَفِ الْأُمَّةِ لَمْ يَفْعَلْهُ أَحَدٌ مِنْ السَّلَفِ بَلْ اتَّفَقُوْا عَلَى كَرَاهِيَتِهِ

‘কেউ যদি মক্কায় অবস্থান করে প্রত্যেক দিন একটি বা দুইটি করে ওমরা করে, তাহলে সেটা সালাফদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে মাকরূহ হবে। সালাফদের কেউ এভাবে ওমরা করেননি। বরং তারা মাকরূহ হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/২৭০ পৃ.)। অন্য এক ফৎওয়ায় তিনি বলেন,

وَكَذَا الْخُرُوجُ مِنْ مَكَّةَ لِعُمْرَةِ تَطَوُّعٍ بِدْعَةٌ لَمْ يَفْعَلْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا أَصْحَابُهُ عَلَى عَهْدِهِ لَا فِي رَمَضَانَ وَلَا فِي غَيْرِهِ

‘অনুরূপভাবে নফল ওমরার জন্য মক্কা থেকে বের হওয়াও বিদ‘আত। কারণ রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবীগণ তাঁর যুগে এমনটি করেননি। রামাযানেও করেননি, রামাযানের বাইরেও করেননি’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ৫/৩৮৪ পৃ.)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ)ও একই আলোচনা করেছেন (যাদুল মা‘আদ, ২/৮৯ পৃ.)। শায়খ উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,

هَذَا مِنَ الْبِدَعِ فِيْ دِيْنِ اللهِ؛ لِأَنَّهُ لَيْسَ أَحْرَصَ مِنَ الرَّسُوْلِ ﷺ وَلَا مِنَ الصَّحَابَةِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَالرَّسُوْلُ ﷺ دَخَلَ مَكَّةَ فَاتِحاً فِيْ آخِرِ رَمَضَانَ وَبَقِيَ تِسْعَةَ عَشَرَ يَوْمًا فِيْ مَكَّةَ وَلَمْ يَخْرُجْ إِلَى التَّنْعِيْمِ لِيُحْرِمَ بِعُمْرَةٍ وَكَذَلِكَ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ فَتَكْرَارُ الْعُمْرَةِ فِيْ سَفَرٍ وَاحِدٍ مِنَ الْبِدَعِ

‘এটা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতী কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। কারণ রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কেরাম চেয়ে ইবাদতের জন্য অধিক আগ্রহী আর কেউ নেই। অথচ রাসূল (ﷺ) রামাযানের শেষে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেছেন এবং ১৯ দিন অবস্থান করেছেন, কিন্তু ওমরার ইহরাম বাঁধার জন্য তিনি তানঈমের দিকে যাননি। অনুরূপ ছাহাবায়ে কেরামও যাননি। সুতরাং এক সফরে একাধিক ওমরা করা বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত’ (ফাতাওয়া উছায়মীন, ২২/২৬৮ পৃ.)। ইবনু কুদামাও অনুরূপ বলেছেন,

قَدْ اعْتَمَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعَ عُمَرَ فِيْ أَرْبَعِ سُفُرَاتٍ، لَمْ يَزِدْ فِيْ كُلِّ سُفْرَةٍ عَلَى عُمْرَةٍ وَاحِدَةٍ، وَلَا أَحَدٌ مِمَّنْ مَعَهُ، وَلَمْ يَبْلُغْنَا أَنَّ أَحَدًا مِنْهُمْ جَمَعَ بَيْنَ عُمْرَتَيْنِ فِيْ سَفَرٍ وَاحِدٍ مَعَهُ

‘নবী করীম (ﷺ) চার সফরে চারটি ওমরা করেছেন। কিন্তু কোন সফরে একটির বেশি ওমরা করেননি। তাঁর সাথে যারা ছিলেন তারাও করেননি। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে কেউ এক সফরে একত্রে দু’টি ওমরা করেছেন সেই সংবাদও আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেনি’ (আল-মুগনী, ৩/২২১ পৃ.)। সিনিয়র তাবেঈ ত্বাঊস ইবনু কায়সান (১২-১০৬ হি.) বলেন,

الَّذِيْنَ يَعْتَمِرُوْنَ مِنْ التَّنْعِيْمِ مَا أَدْرِي يُؤْجَرُوْنَ عَلَيْهَا أَوْ يُعَذَّبُوْنَ؟ قِيْلَ لَهُ: فَلِمَ يُعَذَّبُوْنَ؟ قَالَ: لِأَنَّهُ يَدَعُ الطَّوَافَ بِالْبَيْتِ، وَيَخْرُجُ إلَى أَرْبَعَةِ أَمْيَالٍ وَيَجِيءُ، وَإِلَى أَنْ يَجِيءَ مِنْ أَرْبَعَةِ أَمْيَالٍ قَدْ طَافَ مِائَتَيْ طَوَافٍ، وَكَلَّمَا طَافَ بِالْبَيْتِ كَانَ أَفْضَلَ مِنْ أَنْ يَمْشِيَ فِيْ غَيْرِ شَيْءٍ

‘যারা তানঈম থেকে ওমরা করছে, আমি জানি না তাদেরকে নেকী দেয়া হবে, নাকি শাস্তি দেয়া হবে? প্রশ্ন করা হল, কেন শাস্তি দেয়া হবে? উত্তরে তিনি বললেন, কারণ তারা বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ বাদ দিয়ে প্রায় চার মাইল দূরে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। অথচ চার মাইল পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসতে আসতে দুইশ বার ত্বাওয়াফ করা যাবে। আর বায়তুল্লাহ ত্বাওয়াফ করা অন্য যেকোন কাজে যাওয়ার চেয়ে অনেক উত্তম’ (আল-মুগনী, ৩/২২১ পৃ.; সিলসিলা ছহীহহা, হা/২৬২৬-এর আলোচনা দ্র.)।

অতএব এক সফরে একটি ওমরা করাই দলীল সম্মত। যদিও শায়খ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)সহ কেউ কেউ একাধিক ওমরা করা জায়েয বলেছেন। তবে তারা বলেছেন, একটা করাই উত্তম, যাতে প্রথমবার ওমরাকারীরা সহজে ওমরা করতে পারে, ভিড়ের মধ্যে পড়ে তারা যেন কষ্ট না পায় (ফাতাওয়া ইবনে বায, ফাতাওয়া ইসলাম, ফৎওয়া নং-৪৯২০; ফাতাওয়া ফাওযান, ফৎওয়া নং-২৮৬)। এ সময় হারামে অবস্থান করে বেশি বেশি নফল ছালাত আদায় করবে, কুরআন তেলাওয়াত করবে, দু‘আ করবে এবং যিকির-আযকার করবে (ফাতাওয়া উছায়মীন, ২২/২৬০ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : সাখাওয়াত, ঢাকা।
প্রশ্ন (৭) : নাকের অপারেশন করলে ওযূ এবং ছালাত কিভাবে আদায় করতে হবে?
উত্তর : যে কোন অসুস্থতার কারণে পানি ব্যবহারে অক্ষম হলে তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করবে (সূরা আল-মায়েদাহ: ৬)। অসুস্থ ব্যক্তি তার সুবিধা অনুযায়ী বসে শুয়ে সালাত আদায় করবে। ইমরান ইবনু হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

كَانَتْ بِي بَوَاسِيرُ فَسَأَلْتُ النَّبِيَّ ﷺ عَنِ الصَّلَاةِ فَقَالَ صَلِّ قَائِمًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِدًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ‏‏.‏

‘আমার অর্শরোগ ছিল। তাই আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর খিদমতে ছালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম, তিনি বললেন, দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে, তা না পারলে বসে; যদি তাও না পার তাহলে শুয়ে’ (ছহীহ বুখারী, হা/১১১৭)।


প্রশ্নকারী : শাহরিয়ার নাফিজ, কুমিল্লা।
প্রশ্ন (৮) : জনৈক ব্যক্তি জর্জ কোর্টে মুহুরীর সহযোগী হিসাবে কাজ করে। মজুরী হিসাবে টাকাও পায়। কিন্তু যার সহযোগী হিসাবে কাজ করে সে মানুষের কাছ থেকে মিথ্যা/প্রতারণা করে টাকা নেয় এবং বিভিন্ন সময় তাকেও মিথ্যা কথা বলতে হয়। এ ধরনের চাকরী করা বৈধ হবে কি?
উত্তর : অবৈধ কাজের মাধ্যমে মজুরী গ্রহণ করা হারাম। আর মিথ্যা কথা বলা কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত আর মিথ্যা বলা ও প্রতারণা করা সবই অন্যায়ের শামিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘নেককাজ ও তাক্বওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না’ (সূরা আল-মায়েদা: ২; ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৭৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮)। তাই এ ধরনের চাকরী ছেড়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে।


প্রশ্নকারী : ছিয়াম শিকদার, চিতলমারী, বাগেরহাট।
প্রশ্ন (৯) : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার উদ্দেশ্যে মুহরিম ব্যক্তির জন্য গোসল করা কি জায়েয? মুহরিমের জন্য ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যাবে কি?
উত্তর : মুহরিমের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্দেশ্যে গোসল করা জায়েয আছে। কেননা হাদীছে নবী (ﷺ) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি ইহরাম অবস্থায় গোসল করেছেন। অনুরূপভাবে ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করে অন্য অতিরিক্ত পরিষ্কার বা নতুন কোন কাপড় পরিধান করা জায়েয। অনুরূপভাবে মুহরিমের জন্য এসি বা আরামদায়ক অন্য কোন জিনিস ব্যবহার করার জায়েয’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল লিইবনি উছাইমীন, ২২/১৪৪ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : মীযানুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রশ্ন (১০) : জনৈক ব্যক্তি রাগ সংবরণ করতে না পেরে তার স্ত্রীকে মাঝে মাঝেই এক ত্বালাক্ব দুই ত্বালাক্ব, তিন ত্বালাক বলে উল্লেখ করত। পরক্ষণে আবার স্বাভাবিক হত এবং পূর্বের অবস্থায় সংসার চলত। প্রশ্ন হল, তাদের মাঝে কি তালাক সংঘটিত হয়েছে?
উত্তর : যদি সজ্ঞানে পবিত্র অবস্থায় ত্বালাক্ব দিয়ে থাকে এবং তিনবার বা ততোধিক বার ত্বালাক্ব দেয়, তাহলে তিন তালাক সংঘটিত হয়েছে এবং স্ত্রী তার জন্য হারাম হয়ে গিয়েছে। কারণ দু’বার পর্যন্ত ত্বালাক্ব দিয়ে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে, কিন্তু তৃতীয়বার ত্বালাক্ব দিলে সেটাই শেষ ত্বালাক্ব হিসাবে বিবেচিত হয় (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২৯-২৩০)। অর্থাৎ যে ত্বালাক্বে স্বামীর (ইদ্দতের মধ্যে) স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার থাকে, তার সংখ্যা হল দুই। তৃতীয়বার ত্বালাক্ব দেয়ার পর ফিরিয়ে নেয়ার অনুমতি নেই। জাহিলিয়্যাতে ত্বালাক্বের ও ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কোন নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। ফলে নারীর উপর বড়ই যুলুম হত। মানুষ বার বার স্বীয় স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিত। এইভাবে না তাকে নিয়ে সঠিকভাবে সংসার করত, আর না তাকে মুক্ত করত। মহান আল্লাহ এই যুলুমের পথ বন্ধ করে দিলেন। পরন্তু প্রথমবার ও দ্বিতীয়বারে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেননি। তা না হলে যদি প্রথম ত্বালাক্বেই চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদের নির্দেশ দিতেন, তাহলে এ থেকে পারিবারিক যে সব সমস্যার সৃষ্টি হত, তা কল্পনাতীত। পক্ষান্তরে যদি সন্তান প্রসবোত্তর বা ঋতুবতী অবস্থায় অথবা যে ত্বাহুরে সহবাস করেছে সেই ত্বাহুরে ত্বালাক্ব দেয়া হয়, তাহলে জামহুর আলেমের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী এই তিন অবস্থায় ত্বালাক্ব সংঘটিত হবে না (ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৩২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭১; নাসাঈ, হা/৩৫৫৯; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ্ দারব্ ইবনে বায, ২২/১০৬-১১০ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : এরশাদ মিয়া, নতুন পাড়া, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ।
প্রশ্ন (১২) : আয়না দেখার প্রসিদ্ধ দু‘আটি কি ছহীহ?
উত্তর : হ্যাঁ, উক্ত দু‘আটি সঠিক (আহমাদ, হা/৩৮২৩; মিশকাত, হা/৫০৯৯, সনদ ছহীহ)।


প্রশ্নকারী : আবুল ফযল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।
প্রশ্ন (১৩) : কোন ব্যক্তি যদি আরোগ্য লাভের আশায় নিজে কুরআন তেলাওয়াত করে বা কুরআন খতম করে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা খায়, তাহলে জায়েয হবে কি? মৃত ব্যক্তির জন্য কি কুরআন খতম করা যাবে?
উত্তর : খেতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ نُنَزِّلُ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ مَا ہُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحۡمَۃٌ  لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ‘আর আমরা নাযিল করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৮২)। তবে মৃত্যু ব্যক্তির জন্য কুরআন খতম করা যাবে না (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৩৯)।


প্রশ্নকারী : মনোয়ার, বিরল, দিনাজপুর।
প্রশ্ন (১৪) : কারো খাবার হালাল না-কি হারাম এটা যদি জানা না যায়, তাহলে তার খাবার গ্রহণ করা যাবে কি?
উত্তর : মেজবান যদি হারাম উপার্জনকারী হন, তাহলে মেহমানের জন্য তা হারাম হবে না। রাসূল (ﷺ) ইহূদীর বাড়ীতে দাওয়াত খেয়েছেন ও তাদের হাদিয়া গ্রহণ করেছেন (ছহীহ বুখারী, হা/২৬১৫-১৮; মিশকাত, হা/৫৯৩১)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তার নিকটে জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, আমার একজন প্রতিবেশী আছে, যে সূদ খায় এবং সর্বদা আমাকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়। এক্ষণে আমি তার দাওয়াত কবুল করব কি? জওয়াবে তিনি বললেন, তোমার জন্য এটি বিনা কষ্টের অর্জন এবং এর গোনাহ তার উপরে পতিত হবে’ (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/১৪৬৭৫; ইমাম আহমাদ আছারটি ‘ছহীহ’ বলেছেন; ইবনু রজব হাম্বলী, জামিঊল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ২০১)। তবে উক্ত ব্যক্তির সংশোধন বা তাকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে যদি কেউ সাময়িকভাবে দাওয়াত গ্রহণ না করে, তবে সেটাই উত্তম হবে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৮/২০৬ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : সাব্বির, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।
প্রশ্ন (১৫) : আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। আমার ফ্যামিলির মূল উপার্জন হারাম উপায়ে অর্জিত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় আমি হালাল ইনকাম করে আলাদা কিনে খেলে বা হোটেলে খেলে আব্বা আম্মা খুব কষ্ট পান। প্রশ্ন হল- আমি যদি তাদের খাবারই খাই কিন্তু প্রতি খাবার প্রতি মাস শেষে বিল দিয়ে দেই, তাহলে এটা কি আমার জন্য বৈধ হবে কি?
উত্তর : এমতাবস্থায় সাধ্যানুযায়ী পিতা-মাতাকে দ্বীন বুঝানোর চেষ্টা করবেন এবং তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট প্রাণ খুলে দু‘আ করবেন। পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার বা তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তাদেরকে খাবার বাবদ খরচ দিয়ে খেতে পারেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, فَاتَّقُوا اللّٰہَ  مَا  اسۡتَطَعۡتُمۡ  ‘সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে’ (সূরা আত-তাগাবুন: ১৬)।


প্রশ্নকারী : আব্দুল্লাহ, খুলনা।
প্রশ্ন (১৬) : মুসলিমদের প্রথম কিবলা কোনটি?
উত্তর : মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলাও কা‘বা, শেষ ক্বিবলাও কা‘বা। পরবর্তীতে ইয়াহুদীরা বিদ্বেষবশত বাইতুল মাক্বদিসের দিকে এবং খ্রিস্টানরা পূর্ব দিকে পরিবর্তন করে ফেলে, যেমন: তারা তাদের ধর্মের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে (শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন- তাফসীরুল কুুরআনিল কারীম, সূরাতুল বাক্বারাহ ২৮, https://www.alathar.net/home/esound/index.php?op=codevi&coid=91750)।

সালাফে ছালিহীনও জানতেন কা‘বাই ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) সহ সমস্ত নবী রাসূলের ক্বিবলা। যেমন ইমাম সুদ্দী, ক্বাতাদাহ, রাবীঈ, যাহ্হাক এবং ইবনু জারীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

بأن القبلة (الكعبة) هي قبلة إبراهيم، وقبلة الأنبياء من بعده، وأهل الكتاب يعرفون هذا، ومع هذا أحدثوا قبلة أخرى، كما سبق

‘কা‘বা হল- ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ক্বিবলাহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণেরও, আহলে কিতাবরা এটি জানত, তার পরও তারা অন্য ক্বিবলাহ তৈরি করেছিল’ (তাফসীরুত্ব ত্বাবারী, ৩/১৮৭-১৮৮; তাফসীরে ইবনু কাছীর, ১/৪৬২ পৃ.)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আহলে কিতাবদের ক্বিবলাহ পরিবর্তন করার বিষয়টি অহীর বিধান বা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অনুযায়ী হয়নি। বরং তারা নিজেরাই পরামর্শ করে করেছে। আল্লাহ তা‘আলা কখনো ইঞ্জিল বা অন্য কোথাও খ্রিষ্টানদেরকে পূর্ব দিকে ক্বিবলাহ নির্ধারণ করার আদেশ দেননি। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাওরাত বা অন্য কোথাও ইয়াহুদীদেরকে ছাখরাহ আল-বাত্তাহ-এর দিকে ক্বিবলাহ নির্ধারণ করার আদেশ দেননি। বরং তারা নিজেরাই সেদিকে মুখমণ্ডল করে ছালাত আদায় করত (আল-বাদাঈয়ু ওয়াল ফাওয়াঈদ, ৪/১৬০৫ পৃ.)। শায়খ ত্বাহির ইবনু ‘আশূর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখুন, ইয়াহুদীরা বাইতুল মাক্বদিসকে নিজেদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী ক্বিবলাহ বানিয়েছে। তাদের দ্বীনে এ সম্পর্কে কোন নির্দেশনা নেই। তাওরাতের কোন খণ্ডে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না (আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ২/৯-১০ পৃ.)।

অনুরূপভাবে রাসূল (ﷺ)-এর ক্বিবলাও কা‘বা। শুধু পরীক্ষা স্বরূপ ১৬/১৭ মাস বাইতুল মাক্বদিসের দিকে মুখমণ্ডল করে ছালাত আদায় করেছেন। বারআ ইবনু আযিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) মদীনায় আসার পর হতে ১৬ অথবা ১৭ মাস বাইতুল মাক্বদিসকে ক্বিবলা করে ছালাত আদায় করলেন। রাসূল (ﷺ)-এর আন্তরিক বাসনা ছিল কা‘বার দিকে ফিরে ছালাত আদায় করা। তারপর মহান আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন, ‘আপনার বারবার আকাশের দিকে মুখ করে তাকানোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আপনার আকাক্সিক্ষত ক্বিবলার দিকে আমরা তোমার মুখ ফিরিয়ে দিচ্ছি। এখন হতে মসজিদে হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৪৪)। তিনি কা‘বার দিকে মুখ ফিরালেন, আর তিনি এটাই চাচ্ছিলেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭২৫২; তিরমিযী, হা/৩৪০; ইবনু মাজাহ, হা/১০১০; আহমাদ, হা/১৮৭০৭)।

অতএব বায়তুল মাক্বদেস মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা এটা ঐতিহাসিক মিথ্যাচার এবং ইহুদীদের তৈরি করা কথা। কোন মুসলিম এ ধরনের কথা বলতে পারে না।


প্রশ্নকারী : নাজমুল হুসাইন, চাটমোহর, পাবনা।
প্রশ্ন (১৭) : সৎ সন্তান লাভের জন্য কোন দু‘আ পড়া উচিত? বিশেষ কোন আমল আছে কি?
উত্তর : নেক সন্তান পাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট বড় অনুগ্রহ। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল’ (সূরা আশ-শু‘আরা: ৪৯ ও ৫০)। তাই সুসন্তান লাভের জন্য কয়েকটি আমল করা যায়-
(১) বেশি বেশি দু‘আ করা: (ক) ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর দু‘আ। যেমন رَبِّ ہَبۡ  لِیۡ  مِنَ  الصّٰلِحِیۡنَ ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সুসন্তান দান করুন’ (সূরা আছ-ছাফ্ফাত: ১০০)। এই দু‘আর ফলে মহান আল্লাহ তাঁকে ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)-কে দান করেন। (খ) যাকারিয়া (আলাইহিস সালাম)-এর দু‘আ। যেমন قَالَ رَبِّ ہَبۡ لِیۡ مِنۡ لَّدُنۡکَ ذُرِّیَّۃً طَیِّبَۃً ۚ اِنَّکَ سَمِیۡعُ  الدُّعَآءِ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আপনি আপনার নিকট থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’ (সূরা আলে ইমরান: ৩৮)। (গ) رَبَّنَا ہَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন যারা হবে আমাদের জন্য চোখজুড়ানো। আর আপনি আমাদেরকে করুন মুত্তাক্বীদের জন্য অনুসরণযোগ্য’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ৭৪)।

(২) বেশি বেশি তাওবাহ-ইস্তিগফার করা: ইস্তিগফার করলে আল্লাহ সন্তান ও প্রাচুর্য দান করেন। যেমন নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং বলেছি, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন। এবং তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন বহু বাগান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা’ (সূরা আন-নূহ: ১০-১২)। (৩) সহবাসের সময় দু‘আ পড়াও সন্তান লাভের একটি সুন্দর আমল। আল্লাহ চাইলে সহবাসের সময় দু‘আ করার কারণে আপনার মনোবাসনা পূরণ হতে পারে। ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গত হতে চাইলে সে বলবে,

بِاسْمِ اللهِ، اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ، وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا

‘আল্লাহর নামে শুরু করছি, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন এবং আপনি আমাদেরকে সহবাসের ফলে যে সন্তান দান করবেন তা থেকেও শয়তানকে দূরে রাখুন’। তারপর তাদের এ মিলনের মাঝে যদি কোন সন্তান নির্ধারিত থাকে তা হলে শয়তান এ সন্তানকে কক্ষনো ক্ষতি করতে পারবে না’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৮৮)।


প্রশ্নকারী : এ কে এম সাইফুল্লাহ সাইফ, মীরপুর, ঢাকা।
প্রশ্ন (১৮) : সব শী‘আ কি কাফের? অনেক আলেমও বলে থাকেন যে, শী‘আরা কাফের। কিন্তু সালাফী আলেমগণ ঐভাবে বলতে নিষেধ করেন, কারণ অনেক শী‘আ আছে যারা কাফের নয়। প্রকৃত বিষয়টি কী?
উত্তর : প্রথমতঃ নাহুবিদ বা ব্যাকরণবিদরা বলেন, الشاذُّ يُحفَظ ولا يُقاس عليه ‘অল্পসংখ্যকের উপর ভিত্তি করে কোন নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠিত হয় না’। ‘উছূলুল ফিক্বহ’-এর নীতিমালা হল- الحكم للغالب والنادر لا حكم لها ‘অধিকাংশের উপর ভিত্তি করে বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়, পক্ষান্তরে অল্পসংখ্যকের উপর ভিত্তি করে কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয় না’ (উছূলুল ফিক্বহ আলা মানহাযি আহলিল হাদীছ, পৃ. ১৮৭)। যেহেতু ১% বা ২% ব্যতীত সমস্ত শী‘আই কুফরী আক্বীদার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই এ কথা বলা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য কখনোই এটা নয় যে, যাদের আক্বীদা ভালো তারাও কাফির। কেননা لكل قاعدة استثناء ‘প্রত্যেকটি নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম থাকে’।

দ্বিতীয়তঃ আমাদের বুঝতে হবে যে, ‘শী‘আদের কাফির কেন বলা হয়’? শুধু কি এই জন্যই যে, তারা শী‘আ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত? না!। বরং শী‘আরা কাফির তাদের কুফরী আক্বীদার জন্য। আর শুধু শী‘আরাই নয়, বরং যারাই ঐ আক্বীদাই বিশ্বাসী, তারাই কাফির হিসাবে বিবেচিত। ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী যারাই কুরআনুল কারীমকে বিকৃত মনে করে বা বিকৃত করার চেষ্টা করে অথবা হাদীছকে অস্বীকার করে অথবা নবী (ﷺ)-এর শানে বেয়াদবি করে অথবা আবু বাকর ছিদ্দীক্ব, উমার ফারুক্ব, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কিংবা অন্য কোন ছাহাবীকে গালাগালি করে অথবা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারোর ইবাদত করে তারাই কাফির। যারা এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, হতে পারে তারা শী‘আ সম্প্রদায়ের কিংবা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কিংবা অন্য কোন সম্প্রদায়ের! সে কোন্ সম্প্রদায়ের সেটা বড় বিষয় নয়! বড় বিষয় হল- সে যে কাজগুলো করছে সেগুলো কোন্ পর্যায়ের! দুর্ভাগ্যবশত প্রায় সমস্ত শী‘আই উপরিউক্ত ঈমান বিধ্বংসী কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শী‘আরা এক প্রকারের নয়। বরং তারা কমপক্ষে ২২টি দলে বিভক্ত। সকলেই কুফরী অথবা বিদ‘আতের সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে যারা তুলনামূলকভাবে সবথেকে ছোট অপরাধী তারাও ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে আবূ বাকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপর প্রাধান্য দেয় এবং ছাহাবীদের বিরোধিতা করে।

فالحاصل: أنهم ينظر في عقائدهم بالتفصيل، ولا يقال الشيعة كلهم كفار، لا، بل فيهم تفصيل، وهم أقسام كثيرة

‘সুতরাং মোদ্দাকথা হল- তাদের আক্বীদাহ সম্পর্কে বিশদভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। সকল শী‘আকে একবাক্যে কাফির বলা ঠিক হবে না। বরং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে এবং তাদের অনেক প্রকার আছে (https://binbaz.org.sa/fatwas/3129/%D8%A7%D8%B5%D9%86%)।


প্রশ্নকারী : সাকিব আহমাদ, শমশেরনগর, মৌলভীবাজার।
প্রশ্ন (১৯) : রামাযান মাসে ওমরাহ করলে হজ্জের নেকী পাওয়া যায়। এই বক্তব্য কি সঠিক?
উত্তর : উক্ত বক্তব্য ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَان تَعْدِلُ حَجَّةً

ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় রামাযানে একটি ওমরাহ একটি হজ্জের সমতুল্য’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৭৮২, ১/২৩৯ পৃ.; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৫৬)। অন্য হাদীছে বলেন, فَإِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَقْضِىْ حَجَّةً مَعِىْ ‘রামাযানে একটি ওমরাহ করা আমার সাথে একটি হজ্জ করার সমান’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৮৬৩, ১/২৫১ পৃ.; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৫৬)।


প্রশ্নকারী : তাওহীদ, দিনাজপুর।
প্রশ্ন (২০) : নবী (ﷺ) জনৈক ছাহাবীর দাফন শেষে ফিরে আসছিলেন। তখন উক্ত ‘মাইয়েতের স্ত্রী’ তাঁকে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন এবং রাসূল (ﷺ) দাওয়াত গ্রহণপূর্বক উক্ত মহিলার বাড়িতে গিয়েছিলেন। অতঃপর খাবার উপস্থিত করা হলে তিনি এবং উপস্থিত অন্যান্য লোকজন খাবার গ্রহণ করলেন। এর আলোকেই মাইয়েতকে কেন্দ্র করে খাবারের আয়োজন করা হয়। তাই উক্ত বর্ণনাটি কি ছহীহ?
উত্তর : এ ধরনের হাদীছের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এর বিপরীতে ছহীহ হাদীছ রয়েছে। রাসূল (ﷺ) কোন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে আহার করেননি, বরং তিনি মৃতের পরিবারের জন্য আহারের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু জাফর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘তোমরা জাফরের পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করো। কারণ তাদের কাছে এমন দুঃসংবাদ এসেছে যা তাদেরকে ব্যস্ত রাখবে’ (আবূ দাঊদ, হা/৩১৩২; তিরমিযী, হা/৯৯৮)।


প্রশ্নকারী : মশিউর রহমান, পাবনা সদর।
প্রশ্ন (২১) : পড়ার জন্য আমার সংগ্রহে অনেক বইয়ের পিডিএফ আছে। আমি জানি না যে, প্রকাশনী বা লেখক থেকে এগুলোর অনুমোদন আছে কি নেই। যদি না থাকে তাহলে সেগুলো পড়া বা সংগ্রহে রাখা কি গুনাহ হবে?
উত্তর : ইন্টারনেটে প্রচারিত পিডিএফ বা বই-পুস্তক ডাউনলোড করা অথবা পড়া দোষনীয় নয়। এটি দুই অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। যথা: ১- হয় সেগুলো প্রকাশনী বা মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে নেকীর আশায় প্রচার করা হয়েছে। ২- সেগুলো প্রকাশনী বা মালিকের অনুমতি ছাড়াই আপলোড করা হয়েছে। তার পরেও সেগুলো ডাউনলোড করা অথবা পড়া কিংবা ব্যক্তিগত উপকৃত হওয়া দোষনীয় নয়। এক্ষেত্রে কোন প্রকাশনী বা লেখক কাউকে জ্ঞানার্জনে বাঁধা দিতে পারে না। তবে সেগুলো ব্যবসায়িক কাজে লাগানো যাবে না। কেননা এতে প্রকাশনী বা মালিকের ক্ষতি হয়ে যাবে (ছামারাতুৎ তাদবীন, পৃ. ১৪২; লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ১৯/১৭৮ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২২৬২৩০)।

শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইন্টারনেটে ফ্রিতে সরবরাহকৃত পিডিএফ বা বই-পুস্তক পড়ে, কিংবা সংগ্রহ করে রেখে কিংবা প্রয়োজনীয় অংশ প্রিন্ট করে উপকৃত হতে কোন আপত্তি নেই। কেননা এ উদ্দেশ্যেই এগুলো ইন্টারনেটে রাখা হয়েছে। মূল বিধান হল- ঐ সকল বই-পুস্তক ও প্রোগ্রাম ডাউনলোড করা জায়েয। এখন প্রচারক ওয়েবসাইট সেগুলো যদি প্রকাশনী বা মালিকের কাছ থেকে অনুমিত না নিয়ে থাকে, তাহলে এর দায় বর্তাবে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের উপর। অন্বেষণকারী ব্যক্তির জন্য প্রত্যেকটি পিডিএফ, বই কিংবা প্রোগ্রাম আপলোড বা ডাউনলোড করার অনুমতি মালিকের পক্ষ থেকে আছে কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক নয়’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১১৬৭৮২, ৩৮৮৪৭)।


প্রশ্নকারী : শাহজালাল আযামী, টঙ্গী, গাজীপুর।
প্রশ্ন (২২) : কেউ যদি ঠোট নাড়িয়ে ত্বালাক্বের কথা বলে কিন্তু কোন শব্দ বের না হয়, এমনকি নিজেও না শুনে, তাহলে কি ত্বালাক্ব হবে?
উত্তর : মনে মনে ত্বালাক্ব দিলে ত্বালাক্ব পতিত হবে না। যেহেতু স্বামী ত্বালাক্ব শব্দটি মুখে উচ্চারণ করেনি। আর শুধু নিয়ত ত্বালাক্ব কার্যকর হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং শব্দ উচ্চারণ বা লেখার মাধ্যমে পতিত হয়। ‘আত্বা ইবনু আবী রিবাহ্, ইবনু সীরীন, হাসান, সাঈদ ইবনু যুবাইর, শা‘বী, জাবির ইবনু যায়িদ, ক্বাতাদাহ, ছাওরী, আবূ হানীফা, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব (রাহিমাহুমুল্লাহ) একই কথা বলেছেন (ফাৎহুল বারী, ৯/৩৯৪; আল-মুগনী, ৭/১২১; উমদাতুল ক্বারী, ২০/২৫৬; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২০/২৭; ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ, ৩/২৭৯ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২০৬৬০, ৮১৭২৬)। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ আমার উম্মাতের হৃদয়ে যে খেয়াল জাগ্রত হয় তা ক্ষমা করে দিয়েছেন, যতক্ষণ না সে তা কার্যে পরিণত করে বা মুখে উচ্চারণ করে। ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মনে মনে ত্বালাক্ব দিলে তাতে কিছুই হবে না’ (ছহীহ বুখারী, হা/২৫২৮, ৫২৬৯, ৬৬৬৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৩২৭)। অনুরূপভাবে ‘ইসলাম ওয়েব’-এর আলেমগণ বলেন,

إذا لم يتلفظ به ونواه في نفسه، أو حرك شفتيه ولسانه من غير أن يتلفظ به، فلا يقع طلاقه. فذهب الحنفية والشافعية والحنابلة إلى أنه لا يكفي مجرد حركة اللسان من غير أن يسمع نفسه

‘যদি সে ত্বালাক্ব শব্দটি মুখে উচ্চারণ না করে নিজের অন্তরেই নিয়তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, অথবা মুখে উচ্চারণ না করে যদি শুধু ঠোঁট বা জিহ্বা নাড়াচাড়া করে তাহলেও ত্বালাক্ব সংঘটিত হবে না। হানাফী মাযহাব, শাফিঈ মাযহাব ও হাম্বালী মাযহাবের মতানুযায়ী শুধু ঠোঁট বা জিহ্বা নড়ানো যথেষ্ট নয়, নিজের শব্দ উচ্চারণ নিজে না শোনা পর্যন্ত যথেষ্ট হবে না’ (ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৪২৫৯৬২, ১৫১৬৩৭)।


প্রশ্নকারী : মেহেরুন, কেরানীগঞ্জ।
প্রশ্ন (২৩) : রংধনু অংকিত পাঞ্জাবী কিংবা শার্ট পরে ছালাত আদায় করা যাবে কি?
উত্তর : এ ধরনের জামা কাপড় পরিধান করতে কোন সমস্যা নেই। তবে যদি কোন ধর্মের প্রতীক হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তা ব্যবহার করা যাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে’ (আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১)।


প্রশ্নকারী : আদনান হাবীব, কুমিল্লা।
প্রশ্ন (২৪) : হজ্জের সফরে গিয়ে একাধিক ওমরা করা যাবে কি?
উত্তর : হজ্জ সফরে গিয়ে একাধিক ওমরা করার কোন দলীল পাওয়া যায় না। তামাত্তু হজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি শুরুতে ওমরা করবেন এবং হালাল হয়ে যাবেন। এরপর প্রয়োজনে জেদ্দা, ত্বায়েফ, মদীনা বা অন্য কোন শহরেও যেতে পারেন। মক্কায় ফেরার পথে তাকে আর ইহরাম বাঁধতে হবে না। মীক্বাত অতিক্রম করলেও কোন সমস্যা নেই। মক্কায় পৌঁছে নিজের অবস্থান থেকে হজ্জের ইহরাম বেঁধে মিনায় যাবেন (ফাতাওয়া উছায়মীন, ২১/৩৪৪ পৃ.)। শায়খ উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এ মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 

لَا يَلْزَمُهُ الْإِحْرَامُ، فَإِذَا أَدَّى الْمُتَمَتِّعُ الْعُمْرَةَ وَخَرَجَ مِنْ مَكَّةَ إِلَى الطَّائِفِ، أَوْ إِلَى جِدَّةَ، أَوْ إِلَى الْمَدِيْنَةِ، ثُمَّ رَجَعَ، فَإِنَّهُ لَا يَلْزَمُهُ الْإِحْرَامُ بِالْحَجِّ لِأَنَّهُ رَجَعَ إِلَى مَقَرِّهِ، فَإِنَّهُ لَمَّا جَاءَ حَاجًّا صَارَ مَقَرُّهُ مَكَّةَ، فَإِذَا سَافَرَ إِلَى الْمَدِيْنَةِ ثُمَّ رَجَعَ فَقَدْ رَجَعَ إِلَى مَقَرِّهِ؛ فَيُحْرِمُ بِالْحَجِّ يَوْمَ التَّرْوِيَةِ مِنْ مَكَّةَ

‘তার উপর ইহরাম ওয়াজিব হবে না। যে তামাত্তু হজ্জ করার ইচ্ছা করে ওমরা সম্পাদন করবে এবং মক্কা থেকে ত্বায়েফ, জেদ্দা কিংবা মদীনায় যাবে অতঃপর ফিরে আসবে তার জন্য হজ্জের ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব নয়। কারণ তিনি নিজের অবস্থানে ফিরে আসছেন। যখন তিনি হজ্জের জন্য এসেছেন, তখন মক্কা তার অবস্থান করার জায়গা হয়ে গেছে। তিনি যখন মদীনায় সফর করে ফিরে আসবেন তখন তিনি তার অবস্থানের জায়গায় ফিরে আসবেন। অতঃপর ৮ তারিখে মক্কায় তার অবস্থান থেকে হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন’ (ফাতাওয়া উছায়মীন, ২২/৭৮ পৃ.)। শায়খ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 

وَأَمَّا مَنْ جَاءَ لِلْحَجِّ وَأَدَّى الْعُمْرَةَ ثُمَّ بَقِيَ فِيْ جِدَّةَ أَوِ الطَّائِفِ وَهُوَ لَيْسَ مِنْ أَهْلِهِمَا ثُمَّ أَحْرَمَ بِالْحَجِّ فَهَذَا مُتَمَتِّعٌ فَخُرُوْجُهُ إِلَى الطَّائِفِ أَوْ جِدَّةَ أَوِ الْمَدِيْنَةِ لَا يُخْرِجُهُ عَنْ كَوْنِهِ مُتَمَتِّعًا؛ لِأَنَّهُ جَاءَ لِأَدَائِهِمَا جَمِيْعًا وَإِنَّمَا سَافَرَ إِلَى جِدَّةَ أَوِ الطَّائِفِ لِحَاجَةٍ ، وَكَذَا مَنْ سَافَرَ إِلَى الْمَدِيْنَةِ لِلزِّيَارَةِ كُلُّ ذَلِكَ لَا يُخْرِجُهُ عَنْ كَوْنِهِ مُتَمَتِّعًا فِي الْأَظْهُرِ

‘যে ব্যক্তি হজ্জ করার জন্য আসবে এবং ওমরা আদায় করবে অতঃপর জেদ্দা বা ত্বায়েফ অবস্থান করবে কিন্তু তারা সেখানকার বাসিন্দা নয় তারপর তিনি হজ্জের ইহরাম বাঁধবেন এটাই তামাত্তু হজ্জকারী। জেদ্দা বা ত্বায়েফ যাওয়ার কারণে তিনি তামাত্তু হজ্জকারীর হুকুম থেকে বেরিয়ে যাবেন না। কারণ তিনি হজ্জ ও ওমরা দুইটি এক সঙ্গে করার জন্য এসেছেন। তিনি জেদ্দা ও তায়েফ তার প্রয়োজনে সফর করেছে। অনুরূপ যে ব্যক্তি যিয়ারতের জন্য মদীনায় সফর করেছেন তার হুকুমও একই। মূলত কেউই তামাত্তু হজ্জকারীর হুকুম থেকে বেরিয়ে যাবে না (ফাতাওয়া ইবনে বায, ১৭/৯৬ পৃ.)। শায়খ আলবানী বলেন, ‘হজ্জের পরের হল ঋতুবতী মহিলাদের ওমরা, যারা হায়েযের কারণে হজ্জের ওমরা করতে পারেনি। যেমন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ঋতুবতী হয়েছিলেন, যা তাঁর ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। অনুরূপ অন্যান্য মহিলারাও যদি ওমরা করতে না পারে, তবে তারাও হজ্জের পর তানঈম থেকে ওমরা করতে পারবে। এটা শরী‘আত সম্মত। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ হাজী তারা বোকামি করে যে ওমরা করছে, একে আমরা শরী‘আত সম্মত মনে করি না। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর অনেক ছাহাবী তাঁর সাথে হজ্জ করেছেন, কিন্তু কেউই হজ্জের পর ওমরা করেননি। বরং আমি মনে করি এটা মহিলাদের সাথে পুরুষদের সাদৃশ্য। মনে হচ্ছে মহিলাদের মত পুরুষদেরও হায়েয হচ্ছে’ (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৮৪-এর আলোচনা দ্র.)।

অতএব যে সমস্ত মহিলা ঋতুবতী হওয়ার কারণে ওমরা করতে পারবে না, তারাই কেবল মাসজিদে আয়েশা বা তানঈম থেকে ইহরাম বেঁধে ক্বাযা ওমরা পূরণ করতে পারবে। এছাড়া অন্য কোন নারী-পুরুষ তানঈম থেকে ইহরাম বাঁধতে পারবে না। মক্কায় বসবাসকারীরাও তানঈম থেকে ওমরা করতে পারবে না। তাদেরকে মীক্বাত থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধতে হবে (ছহীহ বুখারী, হা/১৫১৮)।

উল্লেখ্য যে, হজ্জ করতে গিয়ে বিনা প্রয়োজনে হারামের বাইরে গিয়ে ঘুরাঘুরি করা উচিত নয় (ইবনু কুদামা, আল-কাফী ফী ফিক্বহিল ইমাম আহমাদ, ১/৪৮০ পৃ.)। যেহেতু বায়তুল্লাহ দু‘আ কবুলের জায়গা, সেজন্য সেখানে অবস্থান করে বেশি বেশি নফল ছালাত আদায় করবে, কুরআন তেলাওয়াত করবে, দু‘আ করবে, যিকির-আযকার করবে সুযোগ পেলে ত্বাওয়াফ করবে (ফাতাওয়া উছায়মীন, ২২/২৬০ পৃ.)।


প্রশ্নকারী : ইকবাল, আমেরিক প্রবাসী।
প্রশ্ন (২৫) : ইলিয়াসী তাবলীগের ফাযায়েলে আমল বইয়ে বলা হয়েছে, আদম (আলাইহিস সালাম) হিন্দুস্তান থেকে পায়ে হেঁটে এক হাযার বার হজ্জ করেছেন (ফাজায়েলে হজ্জ, পৃ.দ ৪০)। উক্ত দাবী কি সঠিক?
উত্তর : উক্ত দাবী সঠিক নয়। কারণ উক্ত মর্মে যে বর্ণনা প্রচলিত আছে তা নিতান্তই দুর্বল। এর সনদে ক্বাসিম ইবনু আব্দির রহমান নামে একজন যঈফ রাবী আছে (সিলসিলা যঈফাহ, হা/৫০৯২; যঈফ তারগীব, হা/৬৯২)।

উল্লেখ্য যে, আদম (আলাইহিস সালাম) বেঁচেই ছিলেন ৯৪০ কিংবা ৯৬০ বছর (তিরমিযী, হা/৩৩৬৮ ও ৩০৭৬; মিশকাত, হা/৪৬৬২ ও ১১৮, সনদ হাসান ছহীহ)। তিনি এক হাযার বার হজ্জ করলেন কিভাবে? আর হজ্জের বিধান নাযিল হয়েছে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সময় (সূরা আল-হজ্জ: ২৭)। আদম (আলাইহিস সালাম) কিভাবে হজ্জ করলেন? তাছাড়া ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর পূর্বের নবী-রাসূলগণ হজ্জ করেছেন এ সম্পর্কে যেমন ছহীহ বর্ণনা নেই, তেমনি কা‘বা ঘর নির্মাণেরও কোন সঠিক ভিত্তি নেই (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, ১/১৮৮ পৃ.)। বরং ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-ই সর্বপ্রথম কা‘বা ঘর নির্মাণ করেছেন এবং এর ৪০ বছর পর বায়তুল মাক্বদিছ নির্মাণ করেছেন (ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৬৬)।

উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাগণ প্রথম কা‘বা নির্মাণ করেন অতঃপর আদম (আলাইহিস সালাম) করেন এবং নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর প্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায় মর্মে যত বর্ণনা রয়েছে, সবই ইসরাঈলী বর্ণনা, যার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না (আলবানী, আছ-ছামারুল মুস্তাত্বাব, পৃ. ৫১২; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৪১১-এর আলোচনা দ্র.)।


প্রশ্নকারী : আনোয়ার, যশোর।
প্রশ্ন (২৬) : বর্তমানে ডিজিটাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে বিভিন্ন উপায়ে অনলাইনে টাকা ইনকাম করা যায়। যেমন: গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। সেখানে কেউ যদি সোসাল মিডিয়া মার্কেটিং বা ইউটিউব মার্কেটিংয়ের কাজ করে, তাহলে কি তা সম্পূর্ণ হারাম হবে? কারণ এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় কমবেশি মেয়েদের ছবি/ভিডিও থাকে। কাজগুলো মূলত প্রমোশনাল বেইজড। ফলোয়ার/সাবস্ক্রাইব/ভিজিটর/প্রডাক্টের সেল বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
উত্তর : কাজের উপর নির্ভর করে ডিজিটাল স্কিল বা ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট-এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা কখনো বৈধ আবার কখনো অবৈধ। একজন মুসলিমের জন্য বৈধ কাজে ব্যবহৃত ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট বা ডিজাইনের কাজ করা জায়েয। পরন্তু হারাম কাজে ব্যবহৃত ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট বা ডিজাইনের কাজ করা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। যেমন ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট, অ্যালকোহল, সিনেমা, বিপরীত লিঙ্গের চ্যাটিং ওয়েবসাইট ইত্যাদি। দু’টি শর্ত সাপেক্ষে ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট বা ডিজাইনের কাজ করা এবং তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা বৈধ। যথা (১) ঐ ওয়েবসাইট বা কোম্পানির কাজগুলো যেন বৈধ এবং শরী‘আতসম্মত কাজে ব্যবহৃত হয় এবং এর কাজগুলো যেন নিষিদ্ধ বা হারাম কাজে ব্যবহৃত না হয়। (২) এমন কাজ যেটা হারামের সঙ্গে সম্পর্কিত আপনি তেমন কোন কাজ করবেন না (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৬৯৯৫৫, ১২১২৫৯, ১০৫৩২৫)। কেননা তা অন্যায়, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও পাপাচারে সহযোগিতা করার অন্তর্ভুক্ত। আর এ সকল কাজে সহযোগিতা করতে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশনা প্রদান করেছেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ২)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন, এবং অন্যায়, অসৎ ও হারাম কাজে সাহায্য, সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন (তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/১২; তাফসীরে কুরতুবী, ৬/৪৬-৪৭ পৃ)।

দ্বিতীয়তঃ ওয়েবসাইট বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তলব অনুযায়ী শরী‘আত সম্মত কাজ করা জায়েয। এ জগতে এমন হাজার হাজার কাজ আছে, সেগুলো থেকে যদি আপনি কিছু শর্ত সাপেক্ষে হালাল কর্মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা হালাল (ছহীহ বুখারী, হা/২০৭২; ইবনু মাজাহ, ২১৩৮; আহমাদ, হা/১৬৭২৯, ১৫৭৩৯)।

তৃতীয়তঃ হারাম ও অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করা এবং তা প্রচার করে অর্থ উপার্জন করা উভয়-ই হারাম। কেননা তা অন্যায়, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও পাপাচারে সহযোগিতা করার অন্তর্ভুক্ত (সূরা আল-মায়িদাহ: ২)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং অন্যায়, অসৎ ও হারাম কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন (তাফসীর ইবনু কাছীর, ২/১২; তাফসীরে কুরতুবী, ৬/৪৬-৪৭ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৬৭১৭৩)।

চতুর্থতঃ সর্বদা হালাল-হারামের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে এবং হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে থাতে হবে  (ছহীহ বুখারী, হা/৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯৮৬)। এমনকি রাসূল (ﷺ) সন্দেহপূর্ণ বিষয় ছেড়ে দিয়ে যাতে সন্দেহের সম্ভাবনা নেই তা গ্রহণ করার আদেশ করেছেন। কেননা সত্য হল শান্তি ও স্বস্তি এবং মিথ্যা হল দ্বিধা-সন্দেহ’ (তিরমিযী, হা/২৫১৮, সনদ ছহীহ)।


প্রশ্নকারী মুরাদ পারভেজ, আত্রাই, নওগাঁ।
প্রশ্ন (২৭) : নবী (ﷺ)-এর ছাহাবী দাহিয়া কালবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নিজের মেয়েকে নিষ্ঠুরভাবে পর্বতে নিয়ে হত্যা করেছিল। এই বিষয়টি তিনি ইসলাম গ্রহণের পর নবী (ﷺ)-এর কাছে বর্ণনা করেন। উক্ত ঘটনাটি কি ছহীহ?
উত্তর : দাহিয়া কালবী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, জাহিলী যুগে তারা তাদের কন্যাকে জীবন্ত ক্ববর দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না (আল-ইছাবাহ লি ইবনি হাজার, ৭/৫৮২ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩২৪৩৭)।  আসলে সূরা আত-তাকভীর-এর ৮ ও ৯ নং আয়াতকে কেন্দ্র যে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে, সেটি হল- ক্বায়িস ইবনু আছিম আত-তামীমী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আয়াত দু’টি অবতীর্ণ হওয়ার পর ক্বায়িস ইবনু আছিম রাসূল (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, জাহিলী যুগে আমি আমার ৮টি কন্যাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করেছি। আমার প্রায়শ্চিত্ত কী করে হবে? রাসূল (ﷺ) বললেন, প্রত্যেক কন্যার বদলে একটি করে উঠ কুরবানী কর (বাযযার, হা/২৩৮, ১/৬০ পৃ.; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৮৬৩, ১৮/৩৩৭ পৃ.; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৬৮৬১, ৮/১১৬ পৃ.; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২৯৮)।


প্রশ্নকারী : হাবীবুর রহমান, নীলফামারী।
প্রশ্ন (২৮) : স্ত্রীর কানের দুল ও হাতের আংটি মিলে ৭ আনা স্বর্ণ আছে, যা তিনি সবসময় ব্যবহার করে থাকেন। প্রশ্ন হল- এর কি যাকাত দিতে হবে? যদি যাকাত ফরয হয়, তাহলে কত টাকা যাকাত দিতে হবে?
উত্তর : স্বর্ণের নিছাব হল- ২০ মিছক্বাল বা ৮৫ গ্রাম অর্থাৎ ৭.৫ ভরি আর রুপার নিছাব হল- ১৪০ মিছক্বাল বা ৫৯৫ গ্রাম অর্থাৎ ৫২.৫ ভরি। অতএব যখনই ঐ নিছাব পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপা একত্রিত হবে এবং তার উপর যখন এক বছর অতিবাহিত হবে, তখন যাকাত ফরয হবে (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৯/২৫৪-২৫৭ পৃ.)। রাসূল (ﷺ) বলেন, وَفِي الرِّقَّةِ رُبْعُ الْعُشْرِ ‘রৌপ্যের যাকাত চল্লিশ ভাগের এক ভাগ’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৪৫৪, ১৫৭৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমার কাছে দু’শো দিরহাম থাকলে এবং তার উপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে পাঁচ দিরহাম (যাকাত) দিবে। স্বর্ণের ক্ষেত্রে বিশ দীনারের কমে যাকাত নেই। বিশ দীনারে উপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে অর্ধ দ্বীনার যাকাত দিতে হবে। এরপর যা বাড়বে তাতে উক্ত হিসাবে যাকাত দিতে হবে (আবূ দাঊদ, হা/১৫৭৩, ১৫৭২; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৯১)। উপরিউক্ত হাদীছে রৌপ্যের যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ২০০ দিরহামে ৫ দিরহাম যাকাত লাগবে। অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা ২.৫%। আর স্বর্ণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ২০ দীনারে অর্ধ দীনার যাকাত লাগবে। অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা ২.৫%। অতঃপর উপরের দিকে যত বাড়বে তাতে উপরিউক্ত হিসাবে যাকাত দিতে হবে’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৫৬০০)। নিছাব পরিমাণ মাল হলে আপনার অলংকার বা স্বর্ণের যাকাত আদায় করা আপনার উপরই অপরিহার্য। কেননা যাকাত মালিকের উপরই ফরয। স্বামী বা সন্তানের উপর নয়। তবে আপনার স্বামী, বাবা, ভাই বা সন্তান চাইলে আপনার অনুমতি সাপেক্ষে আপনার পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে পারে’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ১৪/২৪১ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৩২০৭)।


প্রশ্নকারী : জাহাঙ্গীর আলম, ধনবাড়ী, টাঙ্গাইল।
প্রশ্ন (২৯) : মেধা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য কী করা উচিত?
উত্তর : মেধা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য কুরআন ও ছহীহ হাদীসে সরাসরি নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি বর্ণনা নেই; তবে নিম্নোক্ত পদ্ধতিদ্বয় অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ ইলম সম্পর্কিত দু‘আগুলো নিয়মিত আমল করা। যেমন (১) رَّبِّ  زِدۡنِیۡ  عِلۡمًا ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন’ (ত্বো-হা: ১১৪)। (২)  سُبۡحٰنَکَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ ‘(হে আল্লাহ) আপনি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন (সেগুলো ছাড়া) নিশ্চয় আপনি প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৩২)। দ্বিতীয়তঃ পাপ থেকে দূরে থাকা: প্রতিনিয়ত পাপাচারের একটি প্রভাব হচ্ছে দুর্বল স্মৃতিশক্তি। পাপের অন্ধকার ও জ্ঞানের আলো কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে না। কোনো মানুষ যখন পাপ কাজ করে, এটা তাকে উদ্বেগ ও দুঃখের দিকে ধাবিত করে। সে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় এবং জ্ঞান অর্জনের মত কল্যাণকর আমল থেকে সে ছিটকে পড়ে। তাই আমাদের উচিত পাপ থেকে দূরে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কেননা ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি আমার উস্তাদ ওয়াকী‘-এর নিকট আমার মুখস্থ শক্তির দুর্বলতার অভিযোগ পেশ করলে তিনি আমাকে বর্ণনা করে বলেন যে, পাপ ছেড়ে দাও। আর তিনি আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, ইলম হল নূর। আল্লাহ তা‘আলা এই নূর বা জ্যোতিকে কোন অপরাধীকে প্রদান করেন না’ (আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ ওয়াদ দাওয়াতি ফিল আহদিল মাক্কী, পৃ. ৫৮৮)।


প্রশ্নকারী : গোলাম রাব্বী, বরিশাল।
প্রশ্ন (৩০) : ইহরাম বাঁধার পূর্বে কোন মহিলা ঋতুবতী হলে তার বিধান কি হবে?
উত্তর : ইহরাম বাঁধার পূর্বে কোন মহিলার হায়েয হলে গোসল করবেন এবং লজ্জাস্থানে কাপড় বেঁধে মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধবেন। তিনি কা‘বা ঘর ত্বাওয়াফ করা ছাড়া ওমরার অন্যান্য কাজ সম্পাদন করবেন (ছহীহ মুসলিম, হা/১২১১ ও ১২১৮; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৭৪)। হায়েয বন্ধ হওয়ার পর পবিত্র হয়ে তিনি বায়তুল্লাহ ত্বাওয়াফ করবেন (আবূ দাঊদ, হা/১৭৮৫, সনদ ছহীহ)। আর ত্বাওয়াফ শেষ করার পর যদি কারো মাসিক শুরু হয়ে যায়, তাহলে ঐ অবস্থাতেই ওমরার বাকী কাজগুলো করতে থাকবেন। ছাফা-মারওয়া সাঈ করবেন, মাথার চুলের আগা থেকে কিছু ছেঁটে ফেলবেন এবং ওমরা শেষ করবেন। কারণ ছাফা-মারওয়া সাঈ করার জন্য পবিত্রতা শর্ত নয় (সিত্তূনা সুয়ালান ফিল হায়যি, সুআল নং০৫৪)। সন্তান প্রসবকারীণি নারীর ক্ষেত্রেও একই হুকুম (ফাতাওয়া আল-লাজনা‌ আদ-দায়িমা, ১১/১৭২-১৭৩ পৃ.)।

উল্লেখ্য যে, হায়েয অবস্থায় থাকার কারণে ওমরার ত্বাওয়াফ করতে না পারলে এবং এর আগেই যদি ফ্লাইটের তারিখ চলে আসলে বা সফর শেষ করতে বাধ্য হন, তার জন্য করণীয় হল, তিনি গোসল করবেন এবং লজ্জাস্থানে শক্ত করে কাপড় বাঁধবেন অতঃপর ত্বাওয়াফ করবেন (ফাতাওয়া উছায়মীন, ১৮/১৮ পৃ.)।

প্রশ্নকারী : নাবিলা তাসনীম, রাজশাহী।




প্রসঙ্গসমূহ »: সকল প্রশ্নোত্তর

ফেসবুক পেজ