শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
সন্তান প্রতিপালনে ইসলাম
মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান*

ভূমিকা :
মানব জীবনের সূচনালগ্নকে ‘শিশুকাল’ বলা হয়। শিশু-কিশোর বলতে আমরা বুঝি বয়সের স্বল্পতার কারণে যাদের দেহ, মন ও মগজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। পিতা-মাতার বৈবাহিক জীবনের প্রবল আকাক্সক্ষা, আবেগ-উচ্ছ্বাস ও ভালবাসার প্রতিফল স্বরূপ জন্ম হয় নেয় একটি শিশু। আমরা সকলে এক সময় শিশু ছিলাম। মহান আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য নে‘মতরাজির মধ্যে আমাদের আদরের শিশু-কিশোররা হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। সন্তান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

اَلۡمَالُ وَ الۡبَنُوۡنَ زِیۡنَۃُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا

‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৪৬)। একটি শিশু প্রাথমিক অবস্থায় কথা বলতে পারে না। নিজে খেতে পারে না, চলতে পারে না, নিজের ভাল-মন্দ কিছুই বুঝে না। এটাও আল্লাহর একটি বিশেষ রহমত। এজন্যই একজন শিশু ইংল্যান্ডে থাকলে ইংরেজী শেখে, বাংলাদেশে রাখলে বাংলা শেখে এবং আরবদেশে রাখলে সে আরবী শেখে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ

‘প্রত্যেক আদম সন্তান ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। আর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রিষ্টান অথবা অগ্নি পূজক বানায়’।[১] যে গৃহে মহান আল্লাহর এই বিশেষ নে‘মত নিষ্পাপ শিশু-কিশোরের কলকাকলি থাকে না, সে গৃহ সকল প্রকার শোভা ও সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। ধন-সম্পদ প্রাণ বাঁচানোর উপায়, আর সন্তান-সন্ততি মানব প্রজাতি রক্ষার একমাত্র মাধ্যম। তাই তাদেরকে ইসলামের আলোকে নৈতিক ও আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের অন্যতম মৌলিক সমস্যা হচ্ছে দেশীয় ও পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির সয়লাবে শিশু-কিশোর ও যুবকদের চারিত্রিক অবক্ষয়। তাই এখনই এটা প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশ, জাতি ও সমাজ অনতিবিলম্বে ডুবে যাবে অমানিশার কালো অন্ধকারে। নৈতিকতা ও ইসলামী মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সময় চার হতে সাত বছর বয়স। এ সময়ে তাদের নৈতিকতা ও ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষাই হবে ভবিষ্যতের পাথেয়। নিম্নে শিশু-কিশোরদের ইসলামের আলোকে প্রতিপালনের সংক্ষিপ্ত কিছু টিপ্স পেশ করা হল।

১. সন্তানের প্রথম শিক্ষা :
সন্তান জন্মগ্রহণের পর চারমাস বয়স থেকে পিতা-মাতার কথা বুঝতে শেখে এবং সাত-আট মাস বয়স থেকে আব্বু-আম্মু বলে ডাকতে শেখে। দু’বছর বয়সে সন্তান আল্লাহর রহমতে সুন্দরভাবে সব কথা বলা শিখে যায়। আপনার-আমার সবার প্রাণপ্রিয় সোনামণিটা প্রথম যখন আধো আধোভাবে সুমধুর কণ্ঠে কথা বলা শুরু করে, তখন আমাদের হৃদয়ের গভীরে অপূর্ব এক আনন্দের ফোয়ারা অনুভূত হয়। সেই মোক্ষম সময়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছোট ছোট শব্দ, বাক্য, তাসবীহ ও দু‘আর মাধ্যমে। এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহয় অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰہَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا- وَّ سَبِّحُوۡہُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (সূরা আল-আহযাব : ৪১-৪২)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

أَحَبُّ الْكَلَامِ إِلَى اللهِ أَرْبَعٌ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ لَا يَضُرُّكَ بَأَيِّهِنَّ بَدَأْتَ

‘আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় বাক্য ৪টি। (ক) সুবহা-নাল্লাহ (খ) আল-হামদুলিল্লাহ (গ) লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ (ঘ) আল্লাহু আকবার। তুমি এগুলোর যেকোন একটি দ্বারা শুরু করলে তোমাকে কোন ক্ষতি করবে না’।[২] অন্য বর্ণনায় এসেছে,

يُسَبِّحُ مِائَةَ تَسْبِيْحَةٍ فَيُكْتَبُ لَهُ أَلْفُ حَسَنَةٍ أَوْ يُحَطُّ عَنْهُ أَلْفُ خَطِيْئَةٍ

‘কেউ একদিনে ১০০ বার সুবহানাল্লাহ পাঠ করলে এক হাজার নেকী হবে অথবা এক হাজার গুনাহ মাফ করা হবে’।[৩]

শিশু শিক্ষার প্রাথমিক বিষয় সমূহ :
(ক) সন্তান প্রথম কথা বলার সাথে সাথে তাকে শিখাতে হবে আল-হামদুলিল্লাহ অর্থাৎ সকল প্রশংসা কেবল মহান আল্লাহর জন্য। (খ) সুবহানাল্লাহ তথা পবিত্রময় মহান আল্লাহ। (গ) আল্লাহু আকবার অর্থ আল্লাহ সর্বাপেক্ষা মহান। (ঘ) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন মা‘বূদ নেই। (ঙ) যে কোন ভুল-ত্রুটির জন্য আসতাগফিরুল্লাহ তথা আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি শিখানো। (চ) সকল ভাল কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করছি বলা। (ছ) বিপদ-আপদ দুঃখকষ্ট ও মৃত্যু সংবাদে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযি‘উন’ বলা (জ) ভবিষৎতের কোন কথা বা কাজের জন্য ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা (ঝ) সুন্দরভাবে কোন কার্য সম্পন্ন করার জন্য ধন্যবাদ স্বরূপ ‘মাশাআল্লাহ’ বলা। (ঞ) আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে সন্তানকে শিখাবেন কত সুন্দর এই চাঁদকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। গাছে গাছে মহান আল্লাহর সৃষ্টি অসংখ্য ফল-ফলাদি যেমন আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল ইত্যাদির দিকে তাকিয়েও ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। আপনার আদরের প্রাণপ্রিয় সোনামণিটাকে অত্যন্ত আদর ও সোহাগ করে এগুলো শিখিয়ে দিলে সে অল্প দিনের মধ্যেই অনেক কিছু শিখে ফেলবে। যার নেকী ও ছওয়াব ধারাবাহিকভাবে আপনি পেতে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

২. সহশিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত না রাখা
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে চরিত্র গঠনের নিমিত্তে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা অত্যাবশ্যক। অন্ততপক্ষে প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শিফটিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এক কথায় বলা যায় যে, আদর্শ চরিত্রবান সুসন্তান গড়তে হলে সহ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন ধরনের সম্পৃক্ত করা যাবে না। কেননা একই শ্রেণীতে একই রুমে পড়াশুনার প্রেক্ষিতে উভয়েরই লজ্জা কমে যায়, একে-অপরের সাথে বই ও নোট বিনিময় করে, একই সঙ্গে চা নাস্তা খায়, গল্প-গুজব ও খেলা-ধুলা করে মিটিং-সমাবেশে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অপরের ঘনিষ্ঠ থেকে আরও ঘনিষ্ঠতর হয়। বড় হলে পূর্ব পরিচিতির জের ধরে ছেলে-মেয়ে, ছাত্র-ছাত্রী ও নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ও মেলামেশাই তাদেরকে অবৈধ, অশ্লীল, ধর্ষণ ও হয়রানিমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পত্রিকার পাতা খুললেই অসংখ্য ধর্ষণ ও অবৈধ মেলামেশার খবর দেখা যায়, যা খুবই দুঃখজনক ও হতাশাব্যাঞ্জক।

সহ-শিক্ষার কুফল সমূহ :
(১) ছেলে ও মেয়ে উভয়ের লজ্জা কমে যায়। (২) অবাধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়। (৩) সর্বদা কল্পনার জগতে অবস্থান করে। (৪) উভয়ের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। তবে ছেলেদের ক্ষতির পরিমাণ বেশী হয়। (৫) উভয়েরই আর্থিক ক্ষতি হয়। (৬) সর্বোপরি চরম চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে। অথচ ইসলামে সহশিক্ষার সম্পূর্ণরূপে হারাম। এছাড়া মহান আল্লাহ মেয়েদেরকে পোশাকের শালীনতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ

‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুসলিম নারীদেরকে বলে দিন যে, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৯)। নারীদের চক্রান্ত অত্যন্ত শক্তিশালী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ کَیۡدَکُنَّ عَظِیۡمٌ  ‘নিশ্চয় তোমাদের (নারীদের) চক্রান্ত শক্তিশালী’ (সূরা ইউসুফ : ২৮)। ওমর (রাযিয়াল্লাহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ

‘অবশ্যই কোন পুরুষ যখন কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হয়, তখন তৃতীয়জন হয় শয়তান’।[৪] অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

اَلْحَيَاءُ مِنَ الْإِيْمَانِ وَالْإِيْمَانُ فِى الْجَنَّةِ وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ وَالْجَفَاءُ فِى النَّارِ

‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রের স্থান জাহান্নাম’।[৫]
ছেলে আর মেয়েদেরকে নেগেটিভ আর পজেটিভ দু’টি তারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তার দু’টি যখন প্লাষ্টিক কভারের মাধ্যমে পৃথক থাকে, তখন শুধু কথ্যমূলক কাজই হয়। ঘটে না কোন দুর্ঘটনা। দু’টি তার যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে একত্রিত হয়, তখন লাইট জ্বলে, ফ্যান ঘুরে, ট্রেন চলে। অনেক ভারী মেশিন চলার মাধ্যমে অনেক কল্যাণমূলক কাজ সংঘটিত হয়। তদ্রুপ ছেলে ও মেয়েরা ছাত্রজীবনে পৃথকভাবে থেকে ভালভাবে পড়াশুনা করে উপযুক্ত বয়স হলে বৈধভাবে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমাজে বহু কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে।
সুধী অভিভাবক! আপনার আদরের সন্তানকে মাদরাসা বা স্কুলে ভর্তি করার সময় সহশিক্ষা বিহীন পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর সাধ্যমত চেষ্টা করবেন। আরও দৃষ্টি রাখা উচিত যে, সেখানে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ও জ্ঞান চর্চার সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা। কারণ শিশু-কিশোরদের মন ও মনন অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। প্রাথমিক পর্যায়ে যেদিকে সে ঝুঁকে যাবে, সেদিক থেকে ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভাল শিক্ষকদের মাধ্যমে সঠিক শিক্ষা ও বুঝ পেলে তাদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি হয়, যা পরবর্তী জীবনে চলার পথে পাথেয় হিসাবে কাজ করে। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও চাকুরীর জন্য পৃথক ক্ষেত্র তৈরির জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যরূরী। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন-আমীন!

৩. বিশুদ্ধ আক্বীদার প্রশিক্ষণ :
পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের সন্তানদের আক্বীদার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। মূলত কর্ম ছাড়া কোন বিষয়ে সন্দেহাতীত চূড়ান্ত বিশ্বাসই আক্বীদা। তাই আল্লাহকে না দেখে, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর, ক্বিয়ামত, কবরের আযাব ইত্যাদি অদৃশ্য বিষয় না দেখে শুধু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার নাম আক্বীদা।[৬] যার আক্বীদা নষ্ট, সে পথভ্রষ্ট। কেননা আক্বীদা মুসলিম জীবনের মূল সম্বল। আক্বীদা বিশুদ্ধ হলে মুসলিম জীবনের সকল আমল বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالۡاِیۡمَانِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُہٗ

‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে কুফরী করবে তার আমল নষ্ট হয়ে যাবে’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করবেন না, যদি তার জন্য তা খালেছ হৃদয়ে ও তার সন্তুষ্টির জন্য না করা হয়’।[৭] জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন,

فَأَخْبِرْنِىْ عَنِ الْإِيْمَانِ قَالَ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ

‘আমাকে ‘ঈমান’ সম্পর্কে বলুন। তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাম-লী, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস করা’।[৮]
মহান আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ শিশু-কিশোরদেরকে সুন্দর করে সরল ভাষায় শিখাতে হবে। সোনামণিদের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিখাতে হবে। অপূর্ব সুন্দর আসমান-যমীন সহ সুন্দর এ পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? চন্দ্র, সূর্য, বায়ূ, মেঘমালা, সমুদ্রের লোনা ও মিষ্টি পানির ¯্রােতধারাকে কে সৃষ্টি করেছেন? মানবজাতি সহ সমস্ত প্রাণীকুলকে কে সৃষ্টি করেছেন? এভাবে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সোনামণিদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ভুল হলে ধমক না দিয়ে রাগ না করে হাসিমুখে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলে দেখবেন আপনার সন্তানের আক্বীদা পাহাড়সম মযবুত ও লোহাসদৃশ শক্ত হবে।

একজন কিশোরীর বিশুদ্ধ আক্বীদা
মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমার একজন বালিকা গোলাম ছিল। সে আমার ছাগলের পাল মাঠে নিয়ে চরাত। একদিন হঠাৎ করে বনের বাঘ এসে ছাগলের পাল থেকে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে গেল। ফলে আমি রাগান্বিত হয়ে তার গালে একটি থাপ্পড় মারি। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে আগমন করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি অন্যায় করে ফেলেছি (তখন ঘটনাটা খুলে বললাম)। আমি তাকে কি মুক্ত করে দিব? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে আস। তাকে নিয়ে আসা হল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন,

أَيْنَ اللهُ قَالَتْ فِى السَّمَاءِ قَالَ مَنْ أَنَا قَالَتْ أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ قَالَ أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ

‘আল্লাহ কোথায়? বালিকাটি বলল, আল্লাহ আসমানে। অতঃপর তিনি বললেন, বল তো আমি কে? বালিকাটি বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে মুমিনা মহিলা’।[৯]
আল্লাহ আমাদের ও আমাদের সন্তানদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করে সঠিক আমল করার তাওফীক দান করুন।

৪. সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা
মানব জীবনে বন্ধু বা সাথীর প্রয়োজন অপরিসীম। বন্ধু অর্থ সাথী, মিত্র, সখা, সুহৃদ, স্বজন, কল্যাণকামী। উত্তম বন্ধু সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

فَاِنۡ تَابُوۡا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ فَاِخۡوَانُکُمۡ فِی الدِّیۡنِ

‘যারা ভুল করার পর তওবা করে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, তারাই তোমার দ্বীনি ভাই বা বন্ধু’ (সূরা আত-তওবাহ : ১১)। বন্ধুছাড়া শিশু-কিশোর তথা যুবব-যুবতীরা নিজেদেরকে অসহায় মনে করে। একজন ভাল বন্ধু জীবনে অনেক উপকার করতে পারে আবার একজন খারাপ বন্ধু জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনার সময় ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এটা জীবন গড়ার সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এ সময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। একবার ভুল পথে পা বাড়ালে জীবনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা কলেজ-ভার্সিটির জীবনকে মুক্ত ও স্বাধীন বলে মনে করে। এটাও জীবনের কঠিন সময়। এ সময় নৈতিকতা, আদর্শ ও তদারকীর মধ্যে রাখতে না পারলে ৯০% যুবসমাজ খারাপের দিকে চলে যায়। তাই সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতা-মাতাও তাদের আচরণ শিষ্টাচার ও ভাল ব্যবহারের মাধ্যমে সন্তানের আদর্শ ও ভাল বন্ধু হতে পারে। বন্ধুর কাছে মনের অজান্তে হৃদয়ে লুক্কায়িত সব তথ্য অকপটে প্রকাশ করে থাকে। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর ধর্ম, মত ও পথ গ্রহণ করে থাকে। এজন্যই সন্তানকে সৎ ও ভাল বন্ধু নির্বাচন করে দিবেন অথবা নিজেরাই সন্তানের প্রকৃত বন্ধু হবেন।
কাউকে প্রকৃত বন্ধু করার পূর্বে বিয়ের পাত্র-পাত্রীর মত তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো মিলিয়ে, জেনে শুনে বুঝে একজন প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত আদর্শ বন্ধু খুঁজে বের করতে হবে। সৎ, যোগ্য, ইমানদার ও ভাল বন্ধু খুঁজে না পেলে নিঃসঙ্গ থাকাই ভাল। এটাই বন্ধুত্বের জন্য চূড়ান্ত ও শেষ উপদেশ।

অনৈসলামী অপসংস্কৃতির সয়লাব রোধ করণীয়
বর্তমান পৃথিবীতে আদর্শ-নীতি, পথ ও মতের কোন শেষ নেই। তথাকথিত বর্ণবাদী ও বৈষয়িক উন্নতির জন্য অসংখ্য মানুষ মস্তিষ্ক প্রসূত বিভিন্ন আদর্শের অনুসারী হচ্ছেন। পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির অনৈসলামিক আদর্শ গ্রহণ করে আমাদের অতি আদরের সোনার ছেলে-মেয়েরা মোবাইল, ট্যাব, ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি, ইন্টারনেট, আকাশ সংস্কৃতি, বিভিন্ন অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন ইত্যাদির অপব্যবহার ও পাঠের মাধ্যমে অধঃপতনের অতলতলে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ ইসলাম সকল নোংরামী, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফী দেখা ও ব্যবহার হারাম করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلۡ اِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّیَ الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَ مَا بَطَنَ وَ الۡاِثۡمَ

‘(হে নবী)! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার প্রভু প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অশ্লীলতা ও পাপকর্ম হারাম করে দিয়েছেন’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখে সে তাদেরই একজন’।[১০]
সুধী পাঠক! আমাদের সন্তানেরা আমাদের পরিবারে ও সমাজে বাস করেও অনৈসলামিক পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, কথাবার্তা ও আচার-আচরণের মাধ্যমে তাদের মগজ ধোলাই হয়ে যাচ্ছে। কারণ পিতা-মাতা ও সমাজের দায়িত্বশীলরা সন্তানদের মনের খোরাক ও সঠিক ইসলামী শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে এ সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বর্তমান মিডিয়ার জগতে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ক্রমাগত হারে বেড়েই চলেছে। যার স্রোতে ভেসেই চলেছে লক্ষকোটি শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী। পর্ণোগ্রাফী ও অশ্লীলতা তৈরিকারী, ব্যবহারকারী এবং প্রশ্রয়দানকারীদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

‘যারা পসন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার ঘটুক তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে’ (সূরা আন-নূর : ১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ

‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটে সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত লোক হল ছবি প্রস্তুতকারীরা’।[১১] অন্য হাদীছে এসেছে,

كُلُّ مُصَوِّرٍ فِى النَّارِ

‘প্রত্যেক ছবি প্রস্তুতকারী জাহান্নামী’।[১২]
সন্তানদেরকে এসব অশ্লীলতা থেকে রক্ষার উপায় ও মাধ্যম হল- (১) সন্তানকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। (২) মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। (৩) সন্তানকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা। (৪) পর্ণ ভিত্তিও এর অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করা। (৫) খেলাধূলা ও ইবাদতে অবসর সময় ব্যয় করার ব্যবস্থা করা।

উপসংহার
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সন্তানকে প্রকৃত ইসলামী আদর্শে গড়ে তুলতে হলে তাদেরকে পারিবারিকভাবে কঠোর অনুশাসন ও তদারকির আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার যথেষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সন্তানের জন্য মহান রাব্বুল ‘আলামীনের নিকট দু‘আ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে সন্তানকে গড়তে পারলে বর্তমান অমানিশার যন্ত্রণা শেষ হবে। ছোট কুঁড়েঘর থেকে সুরম্য প্রাসাদ পর্যন্ত বেদনার অশ্রু পেরিয়ে আনন্দের ফল্গুধারা নেমে আসবে। তাদেরকে এখনই যদি ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক সুদৃঢ় বন্ধনকে ধীরে ধীরে ঘুণে ধরা কাঠের আসবাব পত্রের মত শেষ করে দিবে। তাই আমরা পারিবারিকভাবে পরকালীন অনাবিল শান্তির স্থান জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদেরকে ইসলামী আদর্শে গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

* চাঁদপুর, রূপসা, খুলনা।
১. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৮।
২. ছহীহ মুসলিম, হা/২১৩৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮১১; মিশকাত হা/২২৯৪।
৩. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৮, মিশকাত, হা/২২৯৯।
৪. তিরমিযী, হা/১১৭১, ২১৬৫; মিশকাত, হা/৩১১৮; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/২৫৪৬।
৫. তিরমিযী, হা/২০০৯; ইবনু মাজাহ, হা/৪১৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৫১৯; মিশকাত, হা/৫০৭৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৪৯৫; ছহীহুল জামে‘, হা/৩১৯৯।
৬. ড. ছালেহ ফাওযান আল-ফাওযান, আক্বীদাতুত তাওহীদ, পৃ. ১।
৭. নাসাঈ, হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ।
৮. ছহীহ মুসলিম, হা/৮; আবু দাঊদ, হা/৪৬৯৫; নাসাঈ, হা/৪৯৯০; তিরমিযী, হা/২৬১০; ইবনু মাজাহ, হা/৬৪; মিশকাত হা/২।
৯. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৩৭; আবূ দাঊদ হা/৯৩০, ৩২৮৪; মিশকাত হা/৩৩০৩।
১০. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।
১১. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/২১০৯।
১২. ছহীহ মুসলিম, হা/২১১০; মিশকাত, হা/৪৪৯৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: শিশু-কিশোর

ফেসবুক পেজ