সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৪:৩২ অপরাহ্ন

সন্তানদের কথা বলার আদব-কায়দা

-মুহাম্মাদ আযীযুর রহমান*


সূচনা
কথা বলার শক্তি মহান আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশেষ নে‘মত। কথা যদি সুন্দর হয়, তাহলে সে কথা মধুর চেয়েও সুমিষ্ট হয়। প্রত্যেকটি ভাল, সুন্দর ও উত্তম কথা মানুষকে যাদুর মত আকর্ষণ করে। সে কথাটি মানুষের হৃদয়তন্ত্রিতে অম্লান ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। হাসিমুখে সুন্দর করে কথা বলার আকর্ষণে জীবনের চিরশত্রুও ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হয়। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুচকি হেসে মিষ্টি স্বরে মধুর ও সুন্দর ভাষায় সবার সাথে কথা বলতেন।

সন্তানদেরকে কথা বলার শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার গুরুত্ব
সুন্দরভাবে কথা বলা একটি আর্ট, শিক্ষা ও কৌশল। যা অনেক ধৈর্য ও কষ্ট করে শিখতে হয়, অর্জন করতে হয় এবং শিশু-কিশোরদের শিখাতে হয়। ধীরস্থিরভাবে ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে কথাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে বললে সে কথা সবার নিকট প্রিয় হয় এবং গ্রহণযোগ্যও হয়। আল্লাহ মুখ দিয়েছেন সবার সাথে সুন্দর করে মধুর স্বরে হাসিমুখে ভাল কথা বলার জন্য। এটি উত্তম আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর কারণেই মানুষ তাকে আজীবন ভাল মানুষ হিসাবে স্মরণ রাখে। পক্ষান্তরে মানুষের সঙ্গে রাগ করা, ধমক দেয়া, টিটকারী করা, অহংকারে মুখ ভার করে থাকার জন্য আল্লাহ সুন্দর চেহারা ও মুখ দেননি। বরং খারাপ কথা বলার জন্য মানুষ তাকে আজীবন ঘৃণার চোখে দেখে ও তার অন্তরে বিষ বাষ্পের ঝড় বয়ে যায়।

সুন্দরভাবে মিষ্টি কথা বলা ও উত্তম আচরণের জন্য সন্তানের সাথে পিতা-মাতার, শিক্ষকের সাথে ছাত্রের, প্রতিবেশী-বন্ধু-সাথীদের মধ্যে গভীর ভালবাসা ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়। ফলে পরিচ্ছন্ন সমাজের আবহ সৃষ্টি হয় ও দেশের সকল স্থানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। অন্যদিকে খারাপ কথার তেজ ও ঝালে পরিবার ও সমাজে সৃষ্টি হয় শত্রুতা, তিক্ততা, গোলমাল, মারামারি, ফেতনা-ফাসাদ এমনকি খুন-খারাবি পর্যন্ত ঘটে যায়। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। খারাপ আচরণের পূর্বে আমাদের জন্য এ কথাগুলো স্মরণ রাখা অত্যাবশ্যক। ইসলামী শরী‘আতে কথা বলার সুন্দর কিছু নীতিমালা রয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারে আয়াত নাযিল করে মহান আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, তুমি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত হয়েছিলে, তুমি যদি কর্কশ ভাষী ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে নিশ্চয় তারা তোমার সংসর্গ হতে সরে যেত’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)। অত্র প্রবন্ধে সুন্দর করে কথা বলার গুরুত্ব ও মর্যাদা বিষয়ে ৫টি পয়েন্টের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।

(ক) যাবতীয় কথা-বার্তা সালাম দিয়ে শুরু করা।
ইসলামের অন্যতম আকর্ষণীয় ও চমৎকার অভিবাদনের নাম ‘সালাম’। যা পরিচিত মানুষের মাঝের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে এবং অপরিচিত মানুষের মাঝে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। সালামকে বন্ধুত্বের কোমল পরশ ‘আবেহায়াত’ বলা হয়। সালামে আছে কল্যাণ-শান্তি, রহমত ও বরকতের দু‘আ। সালাম ও মুছাফাহার মাধ্যমে মনের সকল কালিমা, দূরত্ব ও অনৈক্য দূর হয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার বিনাসুতার মালায় আবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, فَاِذَا دَخَلۡتُمۡ بُیُوۡتًا فَسَلِّمُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ تَحِیَّۃً مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ مُبٰرَکَۃً طَیِّبَۃً ‘যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে, তখন নিজেদের লোকদেরকে সালাম দিবে। এটা আল্লাহর পক্ষ হতে বরকতময় ও পবিত্র অভিবাদন’ (সূরা আন-নূর : ৬১)। এছাড়াও সূরা আন-নূর : ২৭ ও সূরা আন-নিসা : ৮৬ আয়াতে সালামের গুরুত্ব, মর্যাদা ও নীতিমালা সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে।

পরিবারের মূল গার্ডিয়ান হাল পিতা ও মাতা। তাদেরই প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল সন্তানদের ছোট থেকেই সালাম প্রদানে অভ্যস্ত করা। তাহলে পরিবারের সবাই এমনিতেই সালামে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মূলত সালাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দু‘আ, যা পরিবারের সবাইকে ভালভাবে বুঝাতে হবে। সালামে কোন লজ্জা নেই, আছে দুনিয়া ও আখেরাতে সীমাহীন কল্যাণ। প্রতিদিন পরিবারের ছেলে ও মেয়েরা যদি তাদের পিতামাতার সাথে ১০ বার সাক্ষাৎ করে ও সালাম বিনিময় করে, তাহলে পরস্পরের জন্য আল্লাহর শান্তি, রহমত, বরকতের দু‘আ করা হয় সুবহানাল্লাহ। এমন সুন্দর ও আকর্ষণীয় অভিবাদন পৃথিবীর আর কোন ধর্মে নেই। এজন্যই তো ইসলাম শান্তির ধর্ম।

সালাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নির্দেশনা
সালামের ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত হাদীছ হল- জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, اَلسَّلَامُ قَبْلَ الْكَلَامِ ‘কথা বলার পূর্বেই সালাম (দিতে হবে)’।[১] আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى غِلْمَانٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ

‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতিপয় বালকদের নিকট দিয়ে গমন করলেন এবং তাদেরকে সালাম দিলেন’।[২] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছোট বড় সবাইকে সালাম দিতেন।[৩] ইসলামের সর্বোত্তম কাজ ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো ও পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া।[৪] সালাম দিয়ে মুছাফাহা করলে পৃথক হবার পূর্বেই তাদের উভয়ের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।[৫] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদেরকে সালাম দিতেন।[৬] প্রথম সালাম প্রদানকারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও কৃপণতা থেকে মুক্ত।[৭] সালাম প্রদানকারী ব্যক্তিগণ নিরাপদ থাকবে।[৮] সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে।[৯]

বর্তমানে শিশুদেরকে অভিবাদন হিসাবে এড়ড়ফ গড়ৎহরহম, এড়ড়ফ অভঃবৎহড়ড়হ, এড়ড়ফ ঊাবহরহম, এড়ড়ফ ঘরমযঃ, এড়ড়ফ নধু, ঞধঃধ, ইুঁ-নুঁ অথবা নমস্কার ইত্যাদি বলা শিক্ষা দেয়া হয়, অথচ এগুলো মুসলিমদের আদর্শ নয়। বরং এসব ইহুদী, খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের রীতিনীতি। সালাম দেয়ার সময় হাতের ইশারা করা, কপাল, বুক ও মুখে হাত মিলানো ও চুমা খাওয়া, পা ছুঁয়ে ও পায়ের ধূলা নিয়ে কদমবুসি করা এবং নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে শ্বশুর-শাশুড়ির পা স্পর্শ করে সালাম দেয়া ও দু‘আ নেয়ার নামে প্রচলিত প্রথাগুলো ইসলাম বিরোধী রীতিনীতি ও কুসংস্কার।

সুধী পাঠক! সালাম এমন একটি সুন্দর পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পিতা-মাতা, শিক্ষক, বয়স্ক মানুষ, আলেম-ওলামা ও সম্মানী ব্যক্তিদের নিকট আলাদাভাবে দু‘আ চাওয়ার প্রয়োজন হবে না। কেননা সালাম বিনিময়ের মাধ্যমেই পরস্পরের জন্য আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত কামনার দু‘আ করা হয়। কত সুন্দর ও চমৎকার ইসলামের এ অভিবাদন। অতএব হে অভিভাবকগণ! আপনার সন্তানদের এগুলো শিক্ষা দেয়ার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শিখানো পদ্ধতিতে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমেই দুনিয়াতে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে আগেই পরিবার ও সমাজে যথাযথভাবে সালাম প্রচলন করা যরূরী।

(খ) মাতা-পিতার কাছে সন্তানের প্রথম কথার অনুভূতি
মহান আল্লাহ পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে এমন অকৃত্রিম ভালবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যার অনুভূতি তুলনা করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন, اَلۡمَالُ وَ الۡبَنُوۡنَ زِیۡنَۃُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ‘ধন, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৪৬)। বৈবাহিক জীবনের স্বার্থকতার প্রতীক ছোট্ট সোনামণি যখন তার মাকে আধো আধো অস্পষ্ট আকর্ষণীয় মধুর কণ্ঠে আম্মু আম্মু বলে প্রথম ডাকা শুরু করে, তখন মায়ের মনে নারীদের পরিপূর্ণতার এক আবেগঘন ইতিহাস সৃষ্টি করে, যার অনুভূতি একমাত্র সে মা-ই অনুভব করতে পারেন। পিতা তার কলিজার টুকরা এ সন্তানকে চুমু খেতে খেতে কোলে তুলে সীমাহীন আনন্দ উপভোগ করতে থাকে। সন্তান সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, তাদের আমলনামা তখনও লিপিবদ্ধ করা হয় না। তাই সন্তানদেরকে ভালবাসা, তাদের সকল চাহিদা সর্বাগ্রে পূরণের ব্যবস্থা করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতা-মাতার সাথে সন্তানের এ ভালবাসার সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আদর ও সোহাগ দিয়ে অতি সতর্কতার সাথে এবং যত্ন সহকারে ইসলামী আদর্শ তাদের জীবনে বাস্তবায়নের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا ‘মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘হয় তোমরা ভাল কথা বলবে, না হয় চুপ থাকবে’।[১০]

পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সবই সুন্দর কথা ও আচরণ দিয়েই হয়েছে। খারাপ কথা ও আচরণ দিয়ে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সন্তানকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শে গড়তে হলে তাদের সাথে ভাল কথা ও ব্যবহার করতে হবে। এভাবেই তাদের মন জয় করে ইসলামী আদর্শের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব। সন্তানের সামান্য ভুলের জন্য অনেক পিতা-মাতা সন্তানকে শাস্তি দেয়, ধমক দেয়, রাগ করে মারপিট করে এটা কখনও উচিত নয়। শান্তভাবে ও সুস্থমনে হাসিমুখে সন্তানের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেয়াটাই পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটাই সন্তানকে ভালবাসার বাস্তব নমুনা।

(গ) কথায় ঝাল, কথায় মধু, কথায় যাদুও আছে।
ভাল কথার যেমন বহু কল্যাণ ও উপকারিতা আছে, ঠিক তেমনি খারাপ কথার অনেক ঝাল ও অপকারিতা আছে। খারাপ কথার মাধ্যমে পিতা-মাতা ও পরিবারের মধ্যে দূরত্ব ও বৈরিতা সৃষ্টি হয়, প্রতিবেশী ও বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়। এজন্য ভাল কথা ও ভাল আচরণ সন্তানকে শিক্ষা দেয়ার জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান থাকা অত্যাবশ্যক। সেখানে প্রতি ছুটির দিনে ৩ ঘণ্টা ক্লাস হবে, নোট দিবে এবং ভাল কথা ও আচরণের প্রাকটিক্যাল হবে এবং পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। যেমন দেশে গান-বাজনা সহ অন্যান্য খারাপ ও অপ্রয়োজনীয় কাজে এমন ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

সুন্দরভাবে কথা বলার শক্তি আল্লাহর নে‘মত ছাড়া অন্য কিছু নয়। কথা বলাকে মুখ ও ঠোঁটের ব্যায়াম বলা হয়। চেহারা সুন্দর, পোশাক সুন্দর, যানবাহন সুন্দর হলেই সে প্রকৃতপক্ষে ভাল মানুষ নয়, প্রকৃতপক্ষে ভাল ও সুন্দর কথা বলা ও উত্তম আচার-ব্যবহারই তার প্রকৃত পরিচয় বহন করে। ইহুদী ও খৃষ্টানরা কথা বলার পূর্বে ঊীপধঁংব সব ংরৎ, ভুল হলে ঝড়ৎৎু এবং উপকার করলে ঞযধহশ ুড়ঁ ইত্যাদি তাদের কথার যাদু। আর কথা বলার পূর্বে সালাম বিনিময় করা মুসলিমদের কথা বলার অন্যতম যাদু ও মধু এবং সেরা দু‘আ।

এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা হল, ‘সবার সাথে সুন্দরভাবে কথা বল’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৮৩)। ঈমানদারগণ উত্তম কথা বলে (সূরা বানী ইসরাঈল : ৫৩)। অনর্থক ও বাজে কথা না বলা (সূরা আল-মুমিনূন : ৩)। প্রতিটি কথা রেকর্ড করা হয় (সূরা ক্বাফ : ১৮)। নরম দিলে কথা বলা (সূরা আল-ফাত্হ : ১৯)। তাই আসুন নিজেরা সবাই সুন্দর কথা বলি এবং শিশু-কিশোরদেরকে সুন্দর কথা শিখানোর চেষ্টা করি।

(ঘ) ছেলে-মেয়ে উভয়ের মাঝে মেয়েদের কথাই বেশী আকর্ষণীয়।
শিশু-কিশোর ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কথার আবেগ, অনুভূতি ও আকর্ষণ আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নে‘মত। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কথা ছন্দ, আল্পনা, বিশুদ্ধ বাক্য সংযোজন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক আবেগময়ী আবেদন। যা আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এ কারণে একই বয়সের একটি ছেলের তুলনায় একটি মেয়ে পিতা-মাতা, ভাই বোন এবং পরবর্তীতে স্বামীর নিকট তাদের কথাগুলো গুছিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও সফলভাবে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে পারে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কন্ঠস্বর অত্যন্ত চিকন, মোলায়েম, মনোরম, বিশুদ্ধভাষী ও সাবলীল বাচন ভঙ্গির অধিকারী। তাদের কথার ছন্দ, বাক্য ও আলংকার যেন মধু ও যাদু দিয়ে ভরা। আল্লাহ প্রদত্ত এ সুন্দর নে‘মতকে যেন মেয়েরা গান-বাজনা খারাপ কথা ও কাজে ব্যয় না করে বরং কুরআন পড়ে, হাদীছ পড়ে, ইসলামী সাহিত্য পাঠ করে এবং সালাম দিয়ে হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলে। তবে মেয়েদের গায়ের মাহরাম বা পরপুরুষের সাথে কথা বলা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِہٖ مَرَضٌ وَّ قُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا ‘তবে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলিও না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩২)। আসুন সকলে সুন্দরভাবে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং পরিবার ও সমাজে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিই।

(ঙ) সুন্দর কথা পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায়।
মানুষ সামাজিক জীব। চলার পথের সাথী, স্কুল, মাদরাসার বন্ধু এবং অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে কথা বলা জীবন চলার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছোট-বড় যে কেউ হোক না কেন মানুষ কখনও একাকী বসবাস করতে পারে না এবং কথা না বলে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। দৈনন্দিন জীবনে পরস্পরের সাথে উত্তম কথা বলার মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে আরও ঘনিষ্ঠতর, মযবুত ও স্থায়ী হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَ لَا تُشۡرِکُوۡا بِہٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا وَّ بِذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ الۡجَارِ ذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡجَارِ الۡجُنُبِ وَ الصَّاحِبِ بِالۡجَنۡۢبِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ وَ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ مَنۡ کَانَ مُخۡتَالًا فَخُوۡرَا

‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তার সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা দাম্ভিক ও অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (সূরা আন-নিসা : ৩৬)।

হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهِ وَخَيْرُ الْجِيْرَانِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِهِ ‘আল্লাহর নিকট সেই সঙ্গীই উত্তম, যে নিজ সাথীদের নিকট উত্তম। আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশী উত্তম, যে নিজ প্রতিবেশীর কাছে উত্তম’।[১১] আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অমুক নারী সারারাত ছালাত পড়ে, সারাদিন ছিয়াম রাখে, ভাল কাজ করে, দান-খয়রাত করে এবং নিজ প্রতিবেশীদেরকে মুখের কথায় কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামী। পুনরায় ছাহাবীগণ বললেন, অমুক নারী ফরয ছালাত পড়ে, বস্ত্র দান করে কম এবং কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সে জান্নাতী নারী’।[১২] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُوْلُ اتَّقِ اللهَ فِيْنَا فَإِنَّمَا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعْوَجَجْنَا

‘মানুষ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনীতভাবে জিহ্বাকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। আমরা তো তোমার সাথে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সোজা পথে দৃঢ় থাক, তাহলে আমরাও দৃঢ় থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও, তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য’।[১৩]

পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায়
(১) পরস্পরের সাক্ষাতে সালাম ও মুছাফাহা করা (২) হাসিমুখে সকলের সাথে সুন্দর কথা বলা (৩) পরস্পরের জন্য দু‘আ ও কল্যাণ কামনা করা (৪) হাদিয়া বা উপহার বিনিময় করা (৫) অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়া ও পথ্য দেয়া (৬) বিপদে-আপদে পরস্পরকে সহযোগিতা করা ও আপোস মীমাংসা করে দেয়া (৮) ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করা (৯) কাউকে ভালবাসলে তা প্রকাশ করে দেয়া (১০) বন্ধু ও সহপাঠীদের খেলাধূলা, শরীরচর্চা ও সমাজসেবা মূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা।

উপসংহার
নিয়ম-কানুন ও আদব রক্ষা করে সুন্দর, ভাল ও উত্তম কথা বলা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশু-কিশোর সোনামণি সহ সকলের প্রতিটি কথা হবে মার্জিত, নম্র-ভদ্রভাবে ও নিম্নস্বরে। সাথে সাথে অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় সকল কথা পরিত্যাগ ও বর্জন করতে হবে। কোথায়, কখন কী কথা বলবে তার পরিকল্পনা ও প্রাকটিস থাকা অত্যাবশ্যক। জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ ও সংযত রাখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে পরকালে নাজাত ও জান্নাত পাওয়া সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে এ যোগ্যতা অর্জনের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!


* চাঁদপুর, রূপসা, খুলনা।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/২৬৯৯; মিশকাত, হা/৪৬৫৩; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮১৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬৮; মিশকাত, হা/৪৬৩৪।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৩১; আবূ দাঊদ, হা/৫১৯৮; তিরমিযী, হা/২৭০৪; মিশকাত, হা/৪৬৩৩।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/১২, ২৮, ৬২৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৩৯; আবূ দাঊদ, হা/৫১৯৪; মিশকাত, হা/৪৬২৯।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৫২১২; তিরমিযী, হা/২৭২৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৭০৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৭২১; মিশকাত, হা/৪৬৭৯, সনদ ছহীহ।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৭৭; দারেমী, হা/২৬৩৭; মিশকাত, হা/৪৬৪৭, সনদ ছহীহ।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৯৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৩৮২; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৩৩৯২; সনদ ছহীহ লিগাইরিহি, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫২৫।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/১৩৩৪; দারেমী, হা/১৪৬০; মিশকাত, হা/১৯০৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৬৯।
[৯]. কানযুল উম্মাল, হা/২৫২৪৯; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘, হা/১০৮৮; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭০১।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১৮, ৬০১৯; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৭ ও ৪৮; আবূ দাঊদ, হা/৫১৫৪; তিরমিযী, হা/২৫০০; মিশকাত, হা/৪২৪৩।
[১১]. তিরমিযী, হা/১৯৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৬৬; মিশকাত, হা/৪৯৮৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৩।
[১২]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১১৯, সনদ ছহীহ।
[১৩]. তিরমিযী, হা/২৪০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৯২৭; মিশকাত, হা/৪৮৩৮, সনদ হাসান।




ফেসবুক পেজ