এক চলমান প্রতিষ্ঠান: শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)
- হাসিবুর রহমান বুখারী*
(৫ম কিস্তি)
[নভেম্বর’২৪ সংখ্যার পর]
তিনি ইশারা ইঙ্গিতেও দলীলবিহীন কথা বলতেন না। বিশেষ করে আক্বীদার বিষয়ে। আক্বীদার বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মানহাজকেই প্রাধান্য দিতেন। আসলে তার গ্রন্থ থেকে এগুলোই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বিশেষ করে শিক্ষা সূচনাকারীদের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাঁর গ্রন্থগুলো খুবই উপকারী ও কল্যাণকর। ভ্রান্ত মাযহাবের অনুসারীরা তাঁর গ্রন্থ সম্পর্কে খুবই আতঙ্কিত থাকত। যদিও সেই সময় মানুষের হাতে অসংখ্য তাফসীরের গ্রন্থ ছিল, কিন্তু তাঁর তাফসীর গ্রন্থের একটি অনন্য মর্যাদা ও বিশেষ স্থান ছিল। ফিক্বাহ শাস্ত্রেও শাইখের শিখন পদ্ধতি একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল, যেটা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে, গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এবং দলীলের সঙ্গে সামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে খুবই সহজ ও নিরাপদ ছিল।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শাইখ সা‘দীর বদান্যতা, উদারতা, মহানুভতা ও তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের তৎপরতা
যখন ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) শাইখ আল্লামা ইবনু সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ছাত্র ছিলেন, তখন শাইখ ইবনু সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) ছাত্রদের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল, মনোযোগী, আগ্রহী, পরিচর্যাকারী, অনুগ্রহকারী, তত্ত্বাবধায়ক, রক্ষণাবেক্ষণকারী, নিষ্ঠাবান পৃষ্ঠপোষক, উদার মনোভাব সম্পূর্ণ এবং আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। তিনি সর্বদা ছাত্রদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতেন, বিশেষ করে ক্লাসে অনুপস্থিত ছাত্রদের, তিনি ছাত্রদের ক্লাসে উপস্থিতির ব্যাপারে খুবই গুরুত্বারোপ করতেন। এই ব্যাপারে তিনি ছাত্রদের সর্বাধিক বেশি উপদেশ দিতেন। শাইখ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উপর শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কী পরিমাণ ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, মহানুভতা, উদারতা ও আগ্রহ ছিল, তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ এখানে শাইখের জীবনের দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করা হল- শাইখ আলী আশ-শাবল্ বলেন,
ঘটনা-১: যখন উনাইযাহ এলাকার অধিবাসীরা উপত্যকার জমি-জায়গা চাষবাসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা সেখানে খেজুরের বৃক্ষরোপণ করছিলেন। তারা এই ব্যাপারে খুবই আগ্রহী, যত্নশীল ও তৎপর ছিলেন। তাদের মধ্যে শাইখের বাবা এবং চাচারাও ছিলেন। আর তাদের সন্তানরা তাদের সহযোগী ছিল। তাদের মধ্যে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)ও ছিলেন। যেখানে আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উপত্যকার জমি-জায়গা চাষবাসের কাজে মোটামুটি তিন বছর পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। সুতরাং শাইখ ইবনু সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে ক্লাসে অনুপস্থিত পেলে, তিনি তার বাবাকে তার ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যেমনটা তিনি অন্যান্য ছাত্ররাও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে জিজ্ঞাসা করে থাকেন। যখন তিনি প্রকৃত খবর জানতে পারলেন যে, মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) চাষবাসের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে অনুপস্থিত থাকছে, তখন তিনি তার খালাতো ভাই শাইখ ছালিহ ইবনু সুলাইমানের কাছে খুবই মিনতিপূর্ণ ও পীড়াপীড়ি করে জোরদার আবেদন করেন যে, যেন ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে ক্লাসে উপস্থিত করার লক্ষ্যে অবশ্যই উনাইযাহ্ শহরে ফেরত নিয়ে আসা হয় এবং আল-জামি‘আতুল কাবীরাতে ক্লাসে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়।
ঘটনা-২: এই ঘটনার পর, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর চাচা এবং চাচাতো ভাইয়েরা ব্যবসার মাধ্যমে রুজি অন্বেষণ করার জন্য রিয়ায শহরে গমন করেন। তাদের সঙ্গে তাদের সন্তানরাও ছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীন। সুতরাং আবার শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে ক্লাসে অনুপস্থিত পেলে, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীনের বাবার কাছে আবেদন করেন যে, যেন তার পুত্র মুহাম্মাদকে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে উনাইযাহ্ শহরে রেখে যান। তিনি বলেছিলেন,
نريدًامحمدًا يبقى عندنا في عنيزة ليواصل الدراسة والطلب
‘আমরা চাই জ্ঞানার্জন ও পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে মুহাম্মাদকে উনাইযাহ শহরে আমাদের কাছে রেখে যান’। যখন তার বাবা সন্তানের ব্যাপারে শাইখ সা‘দীর এই সীমাহীন আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ্য করলেন, তখন দ্বিতীয়বারও তিনি তার এই আবেদন গ্রহণ করেছিলেন এবং পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করার জন্য ছেলেকে শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন।[১]
এর দ্বারাই তিনি সীমাহীন উপকৃত হয়েছিলেন। এটি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্রদের ব্যাপারে শিক্ষকের খোঁজ-খবর নেয়া, শিক্ষক এবং ছাত্রদের মধ্যে একে অপরের অবস্থা সম্পর্কে জানার আগ্রহ এবং তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা। এক্ষেত্রে শাইখ ইবনু সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি যেমন ছাহাবীদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন, সেই অভ্যাস অনুসরণ করেই তিনি এই পদ্ধতি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছিলেন। যেমন- মসজিদে ঝাড়ু লাগানো মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার হাদীছ। আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَجُلًا أَسْوَدَ أَوْ امْرَأَةً سَوْدَاءَ كَانَ يَقُمُّ الْمَسْجِدَ فَمَاتَ فَسَأَلَ النَّبِيُّ عَنْهُ فَقَالُوْا مَاتَ قَالَ أَفَلَا كُنْتُمْ آذَنْتُمُوْنِيْ بِهِ دُلُّوْنِيْ عَلَى قَبْرِهِ أَوْ قَالَ قَبْرِهَا فَأَتَى قَبْرَهَا فَصَلَّى عَلَيْهَا
‘একজন কালো বর্ণের পুরুষ অথবা বলেছেন কালো বর্ণের মহিলা মসজিদে ঝাড়ু লাগাত। সে মারা গেল। নবী (ﷺ) তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ছাহাবীগণ বললেন, সে মারা গেছে। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে খবর দিলে না কেন? আমাকে তার ক্ববরটা দেখিয়ে দাও। অতঃপর তিনি তার ক্ববরের নিকট গেলেন এবং তার জানাযার ছালাত আদায় করলেন’।[২]
অনুরূপভাবে ঐ হাদীছ, যেখানে রাসূল (ﷺ) খাইবারের যুদ্ধের ঝাণ্ডা দেয়ার জন্য আলী বিন আবু ত্বালীব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খোঁজ করেছিলেন। সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, খাইবারের যুদ্ধে একদা রাসূল (ﷺ) বললেন, আগামীকাল সকালে আমি এমন এক লোকের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দেব যার হাতে আল্লাহ তা‘আলা খাইবারে বিজয় দান করবেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসে এবং যাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) ভালোবাসেন। সাহল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, সমস্ত মুসলিম এই জল্পনায় রাত কাটালেন যে, তাঁদের মধ্যে কাকে ঝাণ্ডা দেয়া হবে। সকালে সবাই রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলেন, আর প্রত্যেকেই তা পাওয়ার আকাক্সক্ষা করছিলেন। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, আলী ইবনু আবূ তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কোথায়?
ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তিনি তো চক্ষুরোগে আক্রান্ত। তিনি বললেন, তার কাছে লোক পাঠাও। সে মতে তাঁকে আনা হল। রাসূল (ﷺ) তার উভয় চোখে থুথু লাগিয়ে তার জন্য দু‘আ করলেন। ফলে চোখ এমন ভাল হয়ে গেল যেন কখনো চোখে কোন রোগই ছিল না। এরপর তিনি তার হাতে ঝাণ্ডা প্রদান করলেন। তখন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তারা আমাদের মত (মুসলিম) না হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমি বর্তমান অবস্থায়ই তাদের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে হাজির হও, এরপর তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান করো, আল্লাহর অধিকার প্রদানে তাদের প্রতি যে দায়িত্ব বর্তায় সে সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত কর। কারণ আল্লাহর কসম! তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ যদি মাত্র একজন মানুষকেও হিদায়াত দেন তাহলে তা তোমার জন্য লাল রঙের (মূল্যবান) উটের মালিক হওয়ার চেয়ে উত্তম’।[৩] এছাড়াও আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সুতরাং প্রত্যেক আহলে ইলম্ তথা বিদ্বানের ও শিক্ষকের উচিত এ ব্যাপারে ছাত্রদের উপর অধিক দায়িত্বশীল ও যত্নবান হওয়া, কেননা এর প্রভাব অপরিসীম। আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে এই উদারতা ও মহানুভবতা খুবই ভাবিয়ে তুলেছিল এবং চরমভাবে আকৃষ্ট করেছিল। যার অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে এখানে কয়েকটি বর্ণনা কর হল-
১- আলী আশ-শাবল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা- ছাত্রাবস্থায় জামি‘আতে আমি কখনো কখনো তারাবীর ছালাত শাইখের সঙ্গে আদায় করতাম না। বরং আমি সেটি মধ্যরাতে অথবা তারও পরে আদায় করতাম। কিন্তু যখনই আমি তারাবীর ছালাতে অনুপস্থিত থাকতাম, শাইখ আমাকে তলব করতেন এবং তার সঙ্গে ছালাত আদায় করা থেকে পিছনে থাকার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। আমি তার যথার্থ কারণ ব্যাখ্যা করতাম এবং উপযুক্ত দলীল পেশ করে বলতাম, নিশ্চয় উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন মানুষদের একত্রিত হয়ে জামা‘আত সহকারে তারাবীর ছালাত আদায় করার আদেশ করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন,
نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ وَالَّتِيْ يَنَامُوْنَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنْ الَّتِيْ يَقُوْمُوْنَ يُرِيْدُ آخِرَ اللَّيْلِ وَكَانَ النَّاسُ يَقُوْمُوْنَ أَوَّلَهُ
‘কতই না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা! তোমরা রাতের যে অংশে ঘুমিয়ে থাক তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম যে অংশে তোমরা ছালাত আদায় কর, এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন, কেননা তখন রাতের প্রথমভাগে লোকেরা ছালাত আদায় করত’।[৪] সুতরাং একথা শুনে শাইখ সন্তুষ্ট হয়ে যেতেন এবং আমাকে আর তিরস্কার, ভর্ৎসনা বা শাস্তি দিতেন না। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন এবং তাঁকে ক্ষমা করুন।
২- অনুরূপভাবে ওয়ালীদ আল-হুসাইন -এর সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা
যখন তিনি শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে উনাইযাহ শহরে হিজরত করেছিলেন। কিন্তু তার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণের জীবনোপকরণ ছিল না। সুতরাং তিনি কাজের উদ্দেশ্যে দাম্মামে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হোন। শাইখ তার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং অতিদ্রুত তাকে ফিরে আসার আদেশ করেন। অতঃপর শাইখ নিজে তার জীবনোপকরণ ও দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।[৫] এছাড়াও আরো অনেক ঘটনা। পরবর্তীতে যথাস্থানে সেগুলো বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) যে সমস্ত গ্রন্থ ও বিষয় ইবনু সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে পড়েছেন
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) নিজের সম্পর্কে বলেন,
ثم تتلمذت على يد شيخي وأستاذي الشيخ السعدي فقرأت عليه في: التفسير، والفقه وأصوله، والفرائض، ومصطلح الحديث، والتوحيد، وشيئا من النحو والصرف
‘অতঃপর আমার শাইখ এবং আমার উস্তাদ শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর হাতে শিষ্যত্ব গ্রহণ করি এবং তাঁর কাছে তাফসীর, ফিক্বহ এবং উছূলে ফিক্বহ, ফারায়িয, মুছত্বালাহুল হাদীছ, তাওহীদ এবং নাহু ও ছরফের কিছু অংশ পাঠ করি’।[৬]
এখানে শাইখ মোটামুটিভাবে ছয়টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি শাইখের কাছে কোন্ কোন্ গ্রন্থ পড়েছেন সে কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু অন্যত্রে শাইখ কিছু গ্রন্থের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেগুলো তিনি শাইখের কাছে পড়েছেন। যেমন তিনি বলেন, অতঃপর আমরা আমাদের শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে ‘ক্বাত্বরুন নাদা ওয়া বাল্লাছ ছাদা লি ইবনে হিশাম, যাদুল মুসতাক্বনি‘ ফী ইখতিছারিল মুক্বনি‘, আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ, আল-মুনতাক্বা ফিল হাদীছ এবং অন্যান্য গ্রন্থ পড়েছি’।[৭]
যখন শাইখ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) শাইখ সা‘দীর কাছে ‘আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ’ গ্রন্থ পড়ছিলেন, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে যে জিনিস সংকলনে অনুপ্রাণিত করেছে, এটি ঘটেছিল আমাদের শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) জীবিত থাকাবস্থায়- আমরা তখন শাইখের কাছে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ)-এর গ্রন্থ ‘আল-আক্বীদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ’ গ্রন্থ পড়ছিলাম। আমি এমন একজন ছাত্র ছিলাম, যে এই গ্রন্থে বর্ণিত আয়াতগুলোর, হাদীছগুলোর এবং শাইখ ইবনু তাইমিয়্যার কথাগুলোর ব্যাখ্যা করছিলাম। আমার মনে হয়, চারটি নোটবুক বা ডায়েরী সম্পূর্ণ লিখেছিলাম, তবুও কিন্তু শেষ করতে পারিনি, এরপর আমি যখনই কিছু লিখতাম, শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দীকে দেখাতাম, আর শাইখ আমাকে এ বিষয়ে খুবই উৎসাহিত করতেন’।[৮]
শিক্ষাদানের মজলিসের সময়কাল
শাইখ সা‘দীর দারস শুরু হত সূর্যোদয়ের একঘণ্টা পর থেকে, এবং সেটি দুই ঘণ্টা পর্যন্ত জারি থাকত। অতঃপর তিনি চাশতের সময় প্রাতরাশের উদ্দেশ্যে বাড়ির দিকে রওনা দিতেন, অতঃপর তিনি পুনরায় বড়দের পাঠদানের জন্য ফিরে আসতেন। অনুরূপভাবে তিনি আছরের ছালাতের পূর্বে হাদীছের দারস দিতেন এবং মাগরিব ও এশার মধ্যখানে তিনি ইলমে নাহু আবার কখন কখন তাফসীরুল কুরআনিল কারীম পড়াতেন এবং তিনি ইলমে নাহু ও হাদীছের ক্লাসের মধ্যে কখনো কখনো কম-বেশি অথবা অদলবদল করতেন। (এটি শাইখ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কোন একজন পুরাতন ছাত্র বর্ণনা করেছেন, উনাইযার আল-ইসতিক্বামাহ ফাউন্ডেশনের রেকর্ডিং থেকে ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর জ্ঞান এবং কার্যাবলীর টেপটি দেখুন)।
অধ্যয়ন ও গবেষণার সময়কাল
أما عن مدة الدراسة فكانت طيلة الأسبوع، ما عدا يومي الثلاثاء والجمعة
পক্ষান্তরে সপ্তাহের সবকটি দিনই গবেষণার সময়কাল ছিল, শুধু মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত। এটি শাইখ ইবনু উছাইমীন সম্পর্কে আলোচনা করার সময় উস্তাদ আলী ইবনু আব্দুল্লাহ আস-সুলতান বর্ণনা করেছেন।[৯]
শাইখ সা‘দীকে সম্পূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরে এই বরকতময় শিক্ষা সফরের সাত বছর অতিক্রান্ত করার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জ্ঞানের যে ধনভাণ্ডার দান করেছেন তা অকল্পনীয় এবং মাঝে মাঝে জামি‘আর মধ্যে ও বাহিরে শাইখের বিভিন্ন হালাক্বায়, মজলিসে এবং তার সফর সঙ্গী হয়ে আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) পেয়েছেন মেধা, প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, মহত্ত্ব, সম্মান, মর্যাদা এবং ধর্মীয় বিধান প্রণয়নে গবেষণামূলক প্রয়াসের অনুপ্রেরণা।
শিক্ষা সফরের এই বরকতময় সময় অতিক্রম করার পর ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এতটা যোগ্য হয়েছিলেন যে, তিনি শাইখের জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৩৭১ হিজরীতে শিক্ষা আরম্ভকারী নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য পঠনপাঠন ও মজলিসের শুভ সূচনা করেন। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, এটাই সেই পদ্ধতি যে পদ্ধতি শাইখ সা‘দী তার ছাত্রদের জন্য আরম্ভ করেছিলেন। যেখানে বড় ছাত্ররা ছোট ছাত্রদের পড়াত। দেখতে দেখতে ছাত্র হিসাবে ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) শিক্ষা আরম্ভকারীদের জন্য যে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেছিলেন, শাইখ সা‘দীর তত্ত্বাবধানে আজ তিনি সেই শিক্ষা আরম্ভকারী ছাত্রদের মজলিসের একজন যোগ্য শিক্ষকে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকেনি। কেননা সেই বছরই রিয়ায শহরে ‘ইসলামিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট’-এর শুভ সূচনা হয়েছিল। তীক্ষè মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ‘ইসলামিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট’-এ ভর্তি হওয়ার চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লেন। আশে পাশের সকল বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করলেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন শাইখ ছালিহী, তিনি তাকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। অবশেষে আল্লামা ক্বাসিম শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি রিয়ায শহরের ‘ইসলামিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট’-এ উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এখান থেকেই শাইখের শিক্ষা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়। তিনি রিয়ায ও উনাইযাহ শহরের মধ্যে যাতায়াত শুরু করলেন।[১০]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত
তথ্যসূত্র:
[১]. মাজাল্লাতুদ দা‘ওয়াহ, সংখ্যা নং-১৭৭৯।
[১]. মাজাল্লাতুদ দা‘ওয়াহ, সংখ্যা নং-১৭৭৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৮, ৪৬০, ১৩৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৯৫৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪২১০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪০৬।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১০।
[৫]. মাজাল্লাতুল হিকমাহ, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ৪৭।
[৬]. উকায হাদীছুয যিকরিয়াত, ১২৫৫৬।
[৭]. বার্নামাজ লি ইযা‘আতিল কুরআনিল কারীম বির-রিয়ায।
[৮]. মাজাল্লাতুদ দা‘ওয়াহ, সংখ্যা নং-১৭৭৬।
[৯]. আল-বায়ান, সংখ্যা নং-১৬০।
[১০]. আদ-দুর্রুছ ছামীন ফী তারজামাতি ফাক্বিহিল উম্মাহ আল্লামা ইবনে উছাইমীন, পৃ. ৪৭।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মনীষী চরিত