এক চলমান প্রতিষ্ঠান: শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)
হাসিবুর রহমান বুখারী*
(৩য় কিস্তি)
মাতৃভূমি উনাইযাহ
আল-ক্বাসীম প্রদেশে অবস্থিত তাঁর জন্মভূমি ‘উনাইযাহ’ শহরটি যদিও আয়তনে ছোট ছিল, কিন্তু সেখানে ধারাবাহিকভাবে কালক্রমে প্রসিদ্ধ, খ্যাতিমান, যশস্বী, বিচক্ষণ, উৎকৃষ্ট, শ্রেষ্ঠ ও বিদগ্ধ আলেমগণ বসবাস করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ কৃপায় সেখান থেকে অনেক প্রসিদ্ধ উলামা আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন: আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু উযাইব আত-তামিমী, যিনি উনাইযাহ শহরের বিচারক ছিলেন। আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আবা বুত্বাইন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল কারীম ইবনু শিবল। শাইখ আল্লামা ছালিহ ইবনু উছমান আল-ক্বাযী। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল আযীয ইবনু মানী‘। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন-এর উস্তাদ শাইখ আল্লামা মুফাসসির আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী। শাইখ ইবরাহীম ইবনু হাম্দ ইবনু জাসীর। শাইখ আলী ইবনু নাছির ইবনু ওয়াদী। শায়খ হাফিয আব্দুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ আল-বাসসাম (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখগণ।[১]
শাইখগণের সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জন
ইসলামের প্রথম যুগে ছাহাবায়ে কিরামগণ সরাসরি রাসূল (ﷺ)-এর সান্নিধ্যে থেকে দ্বীন শিখেছেন। ক্ষুদ্র পরিসরে মদীনায় ‘ছুফ্ফাহ’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেও বেশির ভাগ ছাহাবী নবী (ﷺ)-এর সংস্পর্শে থেকেই ইলমে দ্বীন শিখেছেন। দূর-দূরান্তে বসবাসকারী ছাহাবায়ে কিরামগণের ইলমে দ্বীন অর্জনের এটিই পদ্ধতি ছিল। তাঁরা কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করে দ্বীন শিখতেন এবং পরে ফিরে গিয়ে নিজ গোত্রের কাছে তা প্রচার করতেন।
উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য মসজিদে শিক্ষক ও লেখক নিয়োগ করা হয়েছিল এবং শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছিল। উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শিক্ষা পদ্ধতি আজও মসজিদে নববীতে চালু আছে। প্রত্যেক ছালাতের পর শিক্ষকরা মসজিদের এক একটি থাম্বা, স্তম্ভ বা খুঁটির পাদদেশে বসে বিভিন্ন প্রকার ও বয়সের ছাত্রদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।[২] ঐ যুগে নিয়মতান্ত্রিক কোন মাদরাসা ছিল না। এমনকি প্রচলিত আকৃতির কোন কিতাবও ছিল না। তাই দ্বীন শিখার একটাই পদ্ধতি ছিল, আর তা হল- যে ব্যক্তি দ্বীন শিখতে চাইতেন, সরাসরি রাসূল (ﷺ)-এর সাহচর্যে চলে আসতেন এবং মুখ থেকে মুখে, অন্তর থেকে অন্তরে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দেখা থেকে শেখার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। সুতরাং দ্বীনের গভীর ও সঠিক জ্ঞান আহরণে বিজ্ঞ আলিমের সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই।
সুতরাং পূর্ব প্রথা অনুযায়ী শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আল-কুরআনুল কারীম মুখস্থ ও কিছু বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করার পর তিনি বিভিন্ন শাইখের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সমীপ্যে থেকে জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটামুটি ১৭ বছরের কাছাকাছি।[৩] তিনি যে সমস্ত শাইখের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কারণ তিনি আরব-অনারব, দেশ-বিদেশ, আরব উপদ্বীপ অথবা অন্য কোথাও ভ্রমণ করা পসন্দ করেননি, বরং তাঁর আশে-পাশের বিশিষ্ট শাইখদেরকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেছিলেন।[৪]
সর্বপ্রথম তিনি শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) তৎকালীন সময়ের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ শিক্ষক ছিলেন। সর্বদা শিক্ষার্থীরা তাঁকে ঘিরে ধরে থাকত। তাই তিনি নিয়ম করেছিলেন যে, ছোট বা নতুন ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ বা শ্রবণ করার পূর্বে, তাঁর-ই পুরাতন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতে যে সমস্ত মেধাবী শিক্ষার্থীকে ছোট ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার জন্য নির্ধারণ করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। একটি উপযুক্ত সময় পর্যন্ত নতুন ছাত্ররা তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করত। তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা এতটা প্রাথমিক শারঈ জ্ঞান অর্জন করত যে, তারা আল-ক্বাসীম প্রদেশের খ্যাতনামা আল্লামার কাছ থেকে সরাসরি জ্ঞানার্জন করার যোগ্য হয়ে যেত।
শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) ছোট ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বড় ছাত্রদের মধ্যে হতে যে দু’জনকে নির্ধারণ করেছিলেন তাঁরা হলেন: (১) শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল আযীয আল-মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর এবং উনাইযাহ শহরের অন্যান্য অনেক উলামার স্বনামধন্য ছাত্র ছিলেন। তিনি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর গ্রন্থের প্রতি গভীর আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁকে তৃণলতার মত আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তাঁর কাছে তিনি তাওহীদ, হাদীছ, তাফসীর, ফিক্বহ্ এবং ইলমে নাহুর শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উক্ত বিষয়গুলোতে তিনি এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, শাইখ নিজে তাঁকে ছোটদের শিক্ষাদানের জন্য নির্বাচন করেন। শাইখের দেয়া দায়িত্ব তিনি খুবই দক্ষতার সাথে পালন করেন। তিনি উনাইযাহ শহরের বড় জামি‘ মসজিদে ১৩৬০ হি. থেকে ১৩৬৪ হি. পর্যন্ত শিক্ষাদান করেন।[৫]
সে সময় শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বয়স ছিল মোটামুটি ১৩ বছর। তিনি শাইখ মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিষ্য হিসাবে ছিলেন, এবং জামি‘ মসজিদে তাঁর কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।[৬] এ ব্যাপারে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আপনি কত বছর বয়স পর্যন্ত শাইখ মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, মোটামুটি ১৭ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত’[৭] এবং তিনি বলেন, كنت من نصيب الذين يقرأون على الشيخ المطوع ‘যে সমস্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা শাইখ মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, আমি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম’।[৮] যে সমস্ত গ্রন্থ তিনি শাইখের কাছে অধ্যয়ন করেছেন তা নিম্নরূপ:
১. সংক্ষিপ্ত আক্বীদাতুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ। এটিকে সংক্ষিপ্ত করেছেন শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)।
২. মিনহাজুস সালিকীন ফিল ফিক্বহী। এটিও খুবই চমৎকার গ্রন্থ। শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মধ্যে ফিক্বহী মাসআলাগুলোকে খুবই সুনিপুণভাবে সাজিয়েছেন। এটি আরম্ভকারী, সূচনাকারী বা নবীনদের জন্য খুবই উপযোগী গ্রন্থ।
৩. আল-আজুর্রুমিয়্যাহ। এটি ইলমে নাহুর উপর আল্লামা ইবনে আজুর্রুম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর লিখিত গ্রন্থ।
৪. আল-আলফিয়্যাহ। এটিও ইলমে নাহুর উপর আল্লামা ইমাম ইবনে মালিক (রাহিমাহুল্লাহ)-এর লিখিত গ্রন্থ।[৯]
অধ্যয়নের সময়
শাইখ মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ক্লাস শুরু হত এশার ছালাতের পর এবং সকালে সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে শায়খ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত (শারীতু ইবনে উছাইমীন)।
(২) শাইখ আলী ইবন হামদ আছ-ছালিহ (রাহিমাহুল্লাহ)। ফিক্বহু ইবনে সা‘দীর লেখক শাইখ সম্পর্কে বলেন, তিনি খুবই তৎপরতা ও উদ্দীপনার সাথে শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর রিসালাত, থিসিস ও পুস্তিকার প্রচার ও প্রসার করেছেন। ‘অন-নূর’ নামক তাঁর নিজস্ব একটি মুদ্রণালয় বা ছাপাখানা ছিল। তিনি ছোট বা নবাগতদের শিক্ষাদান করতেন।[১০] তিনিই শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে রিয়ায শহরে ইসলামিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট এ যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং তাঁর সর্বাধিক প্রিয় উস্তাদ শাইখ আব্দুর রহমান সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অনুমতিক্রমে তথায় ভর্তি হোন।[১১]
ক্বাসীম শহরের আল্লামা শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর সান্নিধ্যে
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) যখন শাইখ মুত্বাওওয়া‘ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন, তখন তাঁর বয়স মোটামুটি ১৮ বছর। তিনি তখন পূর্ণাঙ্গ যুবক, বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত, সচেতন, সতর্ক, মনোযোগী, অনুভবকারী, অনুভূতিসম্পন্ন, বোধসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, মেধাবী, খ্যাতিমান, প্রতিভাবান। তিনি শিক্ষা জগতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভ্যস্ত, দক্ষ হয়ে উঠেছেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর জ্ঞান বর্ধিত হয়েছে। তিনি প্রাথমিক জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করেছেন। যার প্রারম্ভে ছিল কুরআনুল কারীম হিফয্ করা। তখন তিনি এতটা যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে ক্বাসীম শহরের আল্লামা শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) শিক্ষাদান করবেন। তিনি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও মেধাবী হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তিনি মোটামুটি ১৩৬৫ হিজরীতে শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং তাঁকে ১৩৭৬ হিজরী পর্যন্ত আঁকড়ে ধরেছিলেন অর্থাৎ প্রায় ১১ বছর।[১২]
এই মেধাবী, বিচক্ষণ ও পরিশ্রমী ছাত্র যে কোন বৈধ ও অনুমোদিত সময়ে শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছ থেকে জ্ঞানার্জন ও উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতেন, এমনকি রাস্তায় চলমান অবস্থায়। শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাকে শাইখ সা‘দীর সন্তান বলেছেন: আমার পিতাকে কেউ দাওয়াত দিলে, যখন তিনি মেজবান বা আপ্যায়নকারীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে বাহির হতেন, তখন শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আমার পিতার সঙ্গে চলতে শুরু করতেন এবং পথিমধ্যে চলমান অবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। অতঃপর যখন মেজবানের বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন তখন শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ফিরে আসতেন আবার কখনো কখনো শাইখ সা‘দীর সঙ্গে দাওয়াত বাড়িতে প্রবেশ করতেন।[১৩]
শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) দ্বারা তিনি সর্বাধিক বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন। জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। যা তাঁর জ্ঞান, আদব, আখলাক্ব, চরিত্র, দাওয়াত ও তাবলীগ, পঠনপাঠন, লেখনী, মানহাজ ও ব্যবহারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজের সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, আদব, আখলাক্ব, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইবাদত ও তাক্বওয়ায় তাঁর মত মানুষ সমসময়ে পাওয়া অসম্ভব ছিল। তিনি ছোট-বড় সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন ও উদারতার সঙ্গে মিলিত হতেন। কোন অসহায়, দরিদ্র, ফক্বীর ও মিসকীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার প্রয়োজন পূরণ করতেন। মানুষের দেয়া কষ্ট, অপমান, লাঞ্ছনা, ভৎসনা, তিরস্কার, নিন্দার মুখে পাহাড় সমতুল্য ধৈর্যধারণ করতেন।[১৪]
শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বিদগ্ধ ও বিচক্ষণ সালাফী আলিম ছিলেন। প্রসিদ্ধ মিশরীয় সালাফী আলিম শাইখ মুহাম্মাদ হামীদ বলেন, ‘আমি শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে ২০ বছরেরও অধিক সময় ধরে জানি। এই সময়কালে আমি তাঁকে একজন পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী, সূক্ষ্মদর্শী, বাস্তবায়নকারী, অনুসন্ধানকারী, গবেষণাকারী সালাফী আলিম হিসাবে জেনেছি। তিনি সর্বদা সত্য দলীল অনুসন্ধান করতেন এবং তা জনসম্মুখে উম্মোচন করতেন।[১৫]
শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর উত্তম চরিত্র, পরোপকারী মনোভাব ও বিনয়ী স্বভাব দ্বারা বিশিষ্ট ছাত্র শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় জীবনে শাইখের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, আমি তাঁর উৎকৃষ্ট চরিত্র, আদব ও আখলাক্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। অনুরূপভাবে তিনি তাঁর জ্ঞান, প্রতিভা ও ইবাদত বন্দেগীতেও অনন্য ছিলেন। তিনি ছোটদের সঙ্গে রসিকতা, ঠাট্টা-তামাশা ও মজা করতেন এবং বড়দের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা ও মস্করা করতেন। তিনি আমার দেখামতে সর্বাধিক চরিত্রবান মানুষ ছিলেন।[১৬]
শাইখ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, আমি ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর একটি স্বপ্নের ব্যাপারে শুনেছিলাম যে, তিনি শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে স্বপ্নে দেখেছেন। সুতরাং কোন এক হজ্জের মৌসুমে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, লোকমুখে শোনা যাচ্ছে আপনারা না-কি আপনাদের শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে স্বপ্নে দেখেছেন? এবং জিজ্ঞাসা করলাম যে, কোন বিষয় আপনার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক বেশী উপকারে আসবে? তিনি বললেন, ‘উত্তম চরিত্র’। আর এই স্বপ্নের কথা কী সত্য? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’, তবে এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না যে, তিনি ‘আল্লাহর তাক্বওয়া’ বলেছেন, না-কি ‘উত্তম চরিত্র’ বলেছেন। শাইখ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, কিন্তু আমি শাইখের বেশ কয়েকজন ছাত্র সম্পর্কে যে বর্ণনা শুনেছি, তারা তাতে সন্দেহাতীতভাবে বলেছেন, ‘উত্তম চরিত্র’ তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক বেশী উপকারে আসবে? শাইখ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) রিয়াযে অবস্থিত ‘মসজিদুল হারস’ নামক একটি মসজিদে বক্তব্য দেয়ার সময় ঘটনাটি উল্লেখ করেন, শিরোনাম ছিল: ‘আল্লামা ইবনে উছাইমীন সম্পর্কে ১০০টি উপকারী কথা’।[১৭]
শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পঠনপাঠনের পদ্ধতি
ইবনে উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) শাইখ সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর শিক্ষা, পঠনপাঠন, লেখনী ও শিক্ষণ পদ্ধতি দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। ইবনে উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতি, কঠিন বিষয়ের সরলীকরণ, চমৎকার উপস্থাপনা, উপযুক্ত দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ দিয়ে ছাত্রদের বুঝানো এবং সমর্থক শব্দের ব্যবহার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম।[১৮]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
[১]. আল-জামিঊ লি-হায়াতিল আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ছালিহ আল-উছাইমীন, পৃ. ৪৫-৪৭।
[২]. উছূলুত তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়্যাহ, পৃ. ১১৮।
[৩]. মাজাল্লাতুল ইয়ামামাহ্, সংখ্যা নং-৯৫৩।
[৪]. আল-জামিঊ লি-হায়াতিল আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ছালিহ আল-উছাইমীন, পৃ. ৪৮।
[৫]. ফিক্বহু ইবনে সা‘দী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৪; মাজাল্লাতুদ দা'ওয়াহ্, সংখ্যা নং-১৭৭৮।
[৬]. মাজাল্লাতুদ দা'ওয়াহ্, সংখ্যা নং-১৭৭৮।
[৭]. মাজাল্লাতুল ইয়ামামাহ্, সংখ্যা নং-৯৫৩, ১৪০৭ হি.।
[৮]. বারনামিজ ইযা‘আতুল কুরআনিল কারীম বির-রিয়ায।
[৯]. আল-হিকমাহ, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ২২।
[১০]. ফিক্বহু ইবনে সা‘দী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬২।
[১১]. উকায, হাদীছুয যিকরিয়্যাত, সংখ্যা নং-১২৫৫৬।
[১২]. আল-হিকমাহ্, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ২১।
[১৩]. মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ্, সংখ্যা নং-১৭৭৭।
[১৪]. ফিক্বহু ইবনে সা‘দী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
[১৫]. ফিক্বহু ইবনে সা‘দী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
[১৬]. মাজাল্লাতুল ইয়ামামাহ, সংখ্যা নং-৯৫৩।
[১৭]. আদ-দুররুছ ছামীন ফী তারজামাতি ফাক্বীহিল উম্মাহ আল্লামা ইবনে উছাইমীন, পৃ. ৩৩।
[১৮]. আল-মাজাল্লাতুল আরাবিয়্যাহ্, সংখ্যা নং-৪৮, ১৪২১ হি.।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মনীষী চরিত