এক চলমান প্রতিষ্ঠান: শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
[শিরোনামের তাৎপর্য: সাধারণত কিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, সীমাহীন প্রচেষ্টা, প্রচুর অর্থব্যয়, উন্নত সিলেবাস, অভিজ্ঞ শিক্ষক, আদর্শ শিক্ষার্থী, অসংখ্য লেখকের লিখিত গ্রন্থ এবং বহুমুখী শিক্ষাদানের সমন্বয়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। যেখানে ধর্মনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস সহ অসংখ্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। প্রত্যেক বিভাগের বা বিষয়ের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। স্বীয় বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষক অন্য কোন বিষয় পড়াতে চান না বা পারেন না। পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মের মধ্যে এমন অগণিত কিংবদন্তী আছেন, যাঁরা নিজেরাই এক একটি চলমান ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান। যেমন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উপরে এমন কোন বিষয় নেই যে, তিনি সেই বিষয়ের উপর জ্ঞানার্জন করেননি অথবা কলম ধরেননি। প্রত্যেক বিষয়ের উপর তাঁর লেখা বিদ্যমান। অনুরূপভাবে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)। ইসলামের প্রত্যেক বিষয়ে তাঁর লেখা বিদ্যমান। কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদীছের ব্যাখ্যা, আক্বীদা, উছূলে ফিক্বহ্ ফিক্বহ, ফারায়িজ, ফাতাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এজন্যই আমরা তাঁকে ‘চলমান প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে উপস্থাপন করেছি। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বহুমুখী কার্যক্রমকে ক্ববুল করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন-আল্লাহুম্মা আমীন!] *
ভূমিকা
আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা, ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ প্রদর্শনের জন্য। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে এই ধারাবাহিকতায় মোহরাঙ্কিত করা হয়েছে। অতঃপর যুগের পরম্পরায় নবীগণের ওয়ারিশ হিসাবে উলামায়ে কিরাম এ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সৌভাগ্যবান উলামায়ে কেরাম শরী‘আতের গভীর জ্ঞানার্জন করেন এবং মানব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য উক্ত জ্ঞান বিতরণ করেন। এঁরাই নববী দাওয়াতের প্রকৃত ধারক বা বাহক। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে মানুষের সার্বিক জীবন পরিচালনার দিক-নির্দেশনা দেয়াই তাঁদের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভালো কাজে আদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ করা সব মানুষের নৈতিক এবং ঈমানী দায়িত্ব হলেও এই কাজ পূর্ণাঙ্গ নিষ্ঠার সঙ্গে আলিমরাই পালন করে চলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡہُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَہُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡہِمۡ لَعَلَّہُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ.
‘অতঃপর তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞানার্জন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে (আল্লাহর নাফরমানী হতে) ভীতি প্রদর্শন করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়’ (সূরা আত-তাওবাহ: ১২২)।
একজন আলিমকে বহুবিধ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়। প্রকৃত আলিম তিনি, যিনি আল্লাহ সম্পর্কে, তাঁর প্রেরিত জীবন-বিধান পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখেন। যিনি মানুষের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেন। যিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে জ্ঞানার্জন ও তার প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তাকেই প্রকৃত আলিম বলা হয়। দ্বীন সম্পর্কে বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ হলেন আলিম। যারা দ্বীনের সংরক্ষণ, দ্বীনী ইলম বিতরণ ও প্রচার-প্রসারের কাজ করে থাকেন। ফলে ইহকালে যেমন তারা নন্দিত ও বরিত হন, তেমনি পরকালে জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যমে সম্মানিত ও সফলতা লাভে ধন্য হবেন।
নবী-রাসূলগণ মানব সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী সর্বোত্তম মানুষ। তাই আলিমদের সবচেয়ে বড় মর্যাদা হল, রাসূল (ﷺ) তাঁদেরকে নবীগণের উত্তরাধিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন,
إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا، وَلَا دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ.
‘আলেমগণ হলেন নবীদের উত্তরসুরি। নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান না, তারা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’।[১]
আলেমগণ নবীদের জ্ঞানে-গুণে, আদব-আখলাকে, ভদ্রতা-শিষ্টাচারে, আচার-আচরণে, ন্যায়-ইনসাফে ওয়ারিশ। মোদ্দাকথা হল নবীরা ধর্মীয়, সমাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যত ধরনের কাজ করেছেন সব ক্ষেত্রেই আলিমরা নবীদের ওয়ারিশ। নবীরা যত ধরনের কাজ করেছেন, তাঁদের অনুপস্থিতিতে আলিমরা সবগুলো পরিচালনা করবেন। সভ্যসমাজ বিনির্মাণে নবীরা যেসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, আলিমরাও সেই সব ক্ষেত্রে অবদান রাখবেন। পরিশুদ্ধ ও নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ জাতি গঠনে আলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নৈতিকতা ও আত্মা শুদ্ধতার শিক্ষা, আদর্শ জাতিগঠন ও সমাজ বিনির্মাণে মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। মুসলিম জাতিকে শিক্ষিত করতে যুগযুগ ধরে আলিমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমরা যদি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের দিকে তাকাই, তাহলে দ্বিধাহীন চিত্তে এই কথা স্বীকার করব যে, গোটা দেশে বিশেষত গরীব-অসহায় ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা আলিমদের দ্বারাই সাধিত হচ্ছে। তাঁরা তাদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। নবী (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জের সেই আদেশকে কার্যকর করছেন। তিনি বলেছিলেন, بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً ‘আমার কথা পৌঁছিয়ে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়’।[২] নবী (ﷺ)-এর বাণীকে পৌঁছানোর মাধ্যমে তাঁরা সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ আলিম তাঁর গোটা জীবনকে কোন না কোন জনসেবামূলক কাজে উৎসর্গ করেন। কিন্তু তাঁরা সেই সেবাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না বা করতে চান না। কারণ তাঁরা জনসেবা করেন ইবাদত হিসাবে। আর মানুষ দেখানো ইবাদত আল্লাহ ক্ববুল করেন না। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوْا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ.
‘দয়াশীলদের উপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। সুতরাং তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন’।[৩] জনসেবায় তাঁরা রাসূল (ﷺ)-এর এই কথাকে মূলনীতি হিসাবে মেনে চলেন। নিশ্চিতরূপে ধর্মই মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। আর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী আলিমরা সেই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের নৈতিকতার ভিত মজবুত করেন।
পৃথিবীর সকল মানুষকে কখনও না কখনও আলিমের মুখাপেক্ষী হতে হয়। আমল বাস্তবায়নের জন্য আলিমদের থেকে জ্ঞানার্জন করা অতীব যরূরী। যেমন মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ‘যদি তোমরা না জান, তাহলে আহলুয যিকির অর্থাৎ জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (সূরা আন-নাহল: ৪৩; সূরা আল-আম্বিয়া: ৭)।
উক্ত আয়াতে আলিমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ এসেছে। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘আহলুয যিকির’ হল ‘আহলুল কুরআন’ অর্থাৎ কুরআনের পারদর্শী’। কেউ কেউ বলেন, ‘আহলুুয যিরিক’ হল জ্ঞানীগণ’।[৪] আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই আয়াতে জ্ঞানীদের প্রশংসা করা হয়েছে। কেননা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করার আদেশ দেয়া হয়েছে’।[৫] আলিমদেরকে জিজ্ঞেস না করে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলে দুনিয়া ও আখিরাতে বিপদ হতে পারে। যেমন পূর্বযুগে ৯৯ জনকে হত্যাকারী ব্যক্তির ঘটনা। এজন্য আবুদ্দারদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, مثل العلماء فى الناس كمثل النجوم فى السماء يهدى بها، ‘মানুষের মধ্যে আলিমদের উদাহরণ আকাশের নক্ষত্রের মত। যার দ্বারা পথের দিশা লাভ করা যায়’।[৬]
নবী (ﷺ)-এর আগমনের পর শত বিরোধিতা ও বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিরক ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটন করে তাওহীদ ও রিসালাত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জাহিলিয়্যাত ও অন্ধকারের বেড়াজাল থেকে মানুষকে মুক্ত করে উজ্জ্বল আলোর দিশা দিয়েছিলেন। মূর্তিপূজা, ক্ববর পূজা, পাথর পূজা, বৃক্ষ পূজা ও ব্যক্তি পূজাসহ বহুত্ববাদের সমস্ত জড় উৎখাত করে তাওহীদকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগ থেকে দ্বিতীয় খলীফা উমার ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগ পর্যন্ত ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিল আকাশচুম্বী। তাওহীদ ও রিসালাত ছিল শিরক ও বিদ‘আত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। ছাহাবীদের যুগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। অতঃপর তাবিঈদের যুগ এবং তাবি‘-তাবিঈদের যুগ অতিবাহিত হতে না হতেই দ্বীন ইসলামের মধ্যে আবারো একটু একটু করে ভেজাল প্রবেশ করতে শুরু করে। মানুষ আবারো ধর্মের নামে অধর্ম পালনে মেতে উঠে।
অটোমান বা উছমানীয় সাম্রাজ্যের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের সর্বাধিক পবিত্র নগরী খোদ মক্কা-মদীনাতেও গড়ে উঠে একাধিক ক্ববর, মাযার ও স্মৃতি সৌধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাহিলিয়্যাতের যে সমস্ত পাপাচার, দূরাচার, অধর্মচারী, অনৈসলামিক ও শরী‘আত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে ইসলাম ধর্মকে পবিত্র করেছিলেন; মানুষ আবার সেই সমস্ত পাপাচারে জড়িত হয়ে ইসলামকে কলুষিত করে ফেলেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, মানুষ ইসলাম ধর্মকে পুনরায় সেখানেই পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে কখনোই ইয়াতীম ও অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি। অহী ও নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি প্রত্যেক শতাব্দীতে একজন করে সংস্কারক পাঠিয়ে থাকেন। যেমন আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِيْنَهَا ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের জন্য প্রতি একশ’ বছরের শিরোভাগে এমন একজনের আর্বিভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মতের দ্বীনকে তার জন্য সংস্কার করবেন’।[৭]
‘সংস্কার’ বলতে কী বুঝায়?
আরবী (جَدَّدَ- يُجَدِّدُ- تَجْدِيد) জাদ্দাদা- ইউজাদ্দিদু- তাজ্দীদ অর্থাৎ নতুনকরণ, নবায়ন করা, পুনরায় করা, সংস্কার করা ইত্যাদি। কোন জিনিস পরিবর্তন হয়ে গেলে কিংবা আবর্জনা যুক্ত হয়ে গেলে তাকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়াকেই সংস্কার বলে। অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) এবং ছাহাবায়ে কিরামের যুগে যে অবস্থায় দ্বীন ছিল সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।[৮] ‘আলক্বামা (রাহিমাহুল্লাহ) ও মুহাম্মাদ শামসুল হক্ব আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সংস্কার বলতে বুঝায়, কুরআন ও সুন্নাহর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আমাল সমূহকে পুনর্জীবিত করা, সেই মোতাবেক মানুষকে আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, মানুষের মধ্যে সেগুলোকে প্রচার করা এবং সুন্নাতকে বিদ‘আতের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা’।[৯]
ইমাম মুনাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘(যিনি এই উম্মতের দ্বীনকে তার জন্য সংস্কার করবেন) অর্থাৎ তাওহীদকে শিরকমুক্ত করবেন, সুন্নাতকে বিদ‘আত থেকে পৃথক করবেন, বিদ‘আতীদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করবেন এবং বিশুদ্ধ দ্বীনের প্রচার-প্রসার করবেন’।[১০] এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, দ্বীনকে পরিবর্তন করা বা বিকৃত করা, নিজের ইচ্ছামত কিছু বিধান তৈরি করা বা কিছু বিধান বাতিল করে দেয়া। বরং এর অর্থ হল, স্বচ্ছ উৎসের দিকে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবা ও তাবিঈদের বুঝের দিকে প্রত্যাবর্তন করা।[১১]
সংস্কারের প্রয়োজন কী?
ইসলাম চিরপ্রতিষ্ঠিত একটি ধর্ম ব্যবস্থা। দিন-কাল, সময় পরিবর্তন হয়, কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধানের একটি বিন্দুও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যদিও শত্রুরা বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছে। অথচ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে রাসূল (ﷺ) যে অবস্থায় দ্বীনকে রেখে গিয়েছিলেন সেই অবস্থাতেই দ্বীন দণ্ডায়মান। অমুসলিমরা প্রকাশ্যে দ্বীনের বিরোধিতা করে, বহুকাল থেকে মুসলিমরা তাদের বিরোধিতার মোকাবেলা করে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল- ইসলাম ধর্মের লেবাস পরিধান করে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী স্বার্থপর মানুষ সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করছে, ধর্মটাকে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে ইচ্ছামত বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছে। স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ ধর্মে ভেজাল মিশ্রিত করছে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সঠিক দ্বীন থেকে অধর্মের দিকে পরিচালিত করছে। এদের মুখোশ উন্মোচন করে সাধারণ মানুষকে সঠিক দ্বীনের দিশা দেখাতে, ধর্মকে মলিনতা থেকে পরিষ্কার রাখতে এবং বিরোধীদের কালো পাঞ্জার ছোবল থেকে দ্বীনকে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন সংস্কার ও সংস্কারকের। সেই সঙ্গে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন মাসআলা-মাসায়েলের জন্য প্রয়োজন ইজতিহাদ ও গবেষণার দ্বারকে উন্মুক্ত রাখা। যাতে করে গবেষক কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দিতে পারেন। ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, তিনি রাসূল (ﷺ)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন যে,
إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ.
‘কোন বিচারক ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য আছে দু’টি পুরস্কার। আর বিচারক ইজিতহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার’।[১২] ইমাম শাত্বিবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘প্রত্যেক যুগে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা চক্রান্ত এবং তার থেকে রক্ষামূলক, প্রতিরক্ষামূলক, সংরক্ষণমূলক বা সতর্কতামূলক কাজ কোন কালেই থেমে থাকে না’।[১৩] তবে মুজতাহিদ বা সংস্কারককে অবশ্যই জ্ঞানে, বিশুদ্ধ আক্বীদা ও সুরক্ষিত মানহাযে প্রসিদ্ধ হতে হবে। কেননা বিকৃত আক্বীদা ও ভ্রান্ত মানহাজের মানুষের নিজেরই সংস্কারের প্রয়োজন, সে আবার মনুষ্য সমাজের সংস্কার কী করবে!
সমস্ত রকমের ভ্রান্ত মতবাদ ও অপকর্ম থেকে দ্বীনকে সংরক্ষণ করতে হলে, পুনরায় ইসলামকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে সংস্কারককে অবশ্যই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের হতে হবে, যিনি নবী (ﷺ) এবং ছাহাবীদের দেখানো পথের পথিক হবেন। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِيْ مَا أَتَى عَلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ، حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلَانِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ، وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً، قَالُوْا: وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: "مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ".
‘বনী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মত হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উম্মতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বনী ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সব দলগুলোই জাহান্নামী হবে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সে দল কোন্টি? তিনি বললেন, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত’।[১৪]
উপরিউক্ত হাদীছের আলোকে একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতীয়মান হয় যে, যারাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর ছাহাবীগণের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে, বিবিধ দলসমূহের মধ্য হতে শুধু তারাই প্রকৃত ইসলামের ও হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আর তারাই সফলতা, সার্থকতা এবং পরিত্রাণ পাবে।[১৫] মুহাম্মাদ শামসুল হক্ব আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সংস্কারককে অবশ্যই দ্বীনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে, সুন্নাতের সাহায্যকারী ও বিদ‘আতের মূলোৎপাটনকারী হবে। শরী‘আতের বিষয়সমূহের উপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান না থাকলে সুন্নাতকে বিদ‘আত থেকে আর তাওহীদকে শিরক থেকে পৃথক করবে কী করে?’[১৬]
নিঃসন্দেহে এই ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক যুগে সংস্কারক এসেছেন, ইসলাম ধর্মের মধ্যে সংস্কার করেছেন। যেমন সর্বসম্মতিক্রমে ১৭০০ খ্রিষ্টীয় শতকের সংস্কারক ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ)। যখন সঊদী আরবের মুসলিমরা জাহিলিয়্যাতের যুগের ন্যায় পুনরায় শিরকের গভীর গহীনে হাবুডুবু খাচ্ছিল। বিদ‘আত ও কুসংস্কারের কালো মেঘে ঢাকা পড়েছিল সুন্নাতের পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন আকাশ। ঠিক তখনই শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেখানো পদ্ধতিতে আরবের বুক থেকে শিরক ও বিদ‘আতকে উৎখাত করে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক মহা বিপ্লব। অনুরূপভাবে পূর্ব নীতিমালা অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীতে আবির্ভাব ঘটে তিনজন মহান সংস্কারক ও কিংবদন্তির। তাঁরা হলেন: শাইখ আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও শাইখ আল্লামা মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)।
এই তিন কিংবদন্তির এক একজন যেন বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়্যাতের গভীর কালো আকাশে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিদ্ঘুটে ধরণির মাঝে জ্ঞানের মহাপর্বত কিংবা পথ দেখানো কোন ধ্রুবতারা। একই সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হিদায়াতের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে। মানচিত্র বা আরবের সীমান্ত ছাড়িয়ে যাদের খিদমাত ছড়িয়ে পড়েছে আরব-অনারব সহ পুরো ধরণিময়। আবার এই তিন কিংবদন্তি প্রায় একই সময় আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন। এই বেদনাদায়ক ঘটনা বেশি দিনের নয়, যাদের মৃত্যুতে কলম কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, এই ভেবে যে, হয়তো তাদের পেট থেকে আর জন্ম নেবে না মুক্তা দানার মত শব্দগুচ্ছ, হয়তো তাদের পেট থেকে আর জন্ম নেবে না হীরার মত বহু মূল্যবান শব্দমালা, যাকে পড়ার জন্য চেয়ে থাকবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। মৃত্যুর পরে সময়ের সাথে সাথে তাঁদের পরিচিতি আরো বেড়েছে, মানুষ অবগত হয়েছে তাদের রেখে যাওয়া বহুমুখী কার্যক্রমের কথা। এই কিংবদন্তিরা শুধু জ্ঞান নয়- দুনিয়াবিমুখতা, সময়ের প্রতি যত্নশীলতা, আদব-শিষ্টাচার, বৈষয়িক ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
অতএব আসুন! আমরা দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করি। সে অনুযায়ী আমল করি। নিজেদের সার্বিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী ঢেলে সাজাই। আল্লাহকৃত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জেনে সে অনুযায়ী জীবন যাপন করে আখিরাতে সম্মানিত হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন-আল্লাহুম্মা আমীন!
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৪১; তিরমিযী, হা/২৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/২২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৭১৫।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১।
[৩]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪১।
[৪]. তাফসীরে কুরতুবী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১১৪।
[৫]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ.৪৪১, সূরা আন-নাহল ৪৩নং আয়াতের তাফসীর দ্র.।
[৬]. আখলাকুল উলামা, পৃ. ৪২; নাযরাতুন নাঈম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৭৮।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৪২৯১; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামি‘, হা/১৮৭৪; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৫৯৯।
[৮]. লিসানুল ‘আরব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০২; আল-মিছবাহুল মুনীর, পৃ. ৯২; মাফহূমু তাজদীদিদ দ্বীন, পৃ. ১৫।
[৯]. ফাইযুল ক্বাদীর বি শারহিল জামিইছ^ ছাগীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪; ‘আওনুল মা‘বূদ, ১১শ খণ্ড, পৃ. ৩৯১।
[১০]. ফাইযুল ক্বাদীর, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৫৭।
[১১]. মাফহুমুত তাজদীদ ফিল ফিকরিল ইসলামী, পৃ. ১।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭১৬।
[১৩]. আল-মুওয়াফিক্বাত ফী উছূলিশ শরী‘আহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১০৪।
[১৪]. তিরমিযী, হা/২৬৪১; তাখরীজু মিশকাতিল মাছাবীহ, তাহক্বীক্ব ছানী, হা/১৬৯, ১৭১; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৩৪৮; ছহীহুল জামি‘, হা/৫৩৪৩।
[১৫]. ‘আওনুল মা‘বূদ, ১১শ খণ্ড, পৃ. ৩৯২।
[১৬]. ‘আওনুল মা‘বূদ, ১১শ খণ্ড, পৃ. ৩৯১।