শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২৮ অপরাহ্ন

আল-কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

-আবূ ফাহিম মুহাম্মাদ*


ভূমিকা

আল-কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ন্যায় এ কুরআন কেবল মানুষের আধ্যাত্মিক দিক নিয়েই আলোচনা করে না, বরং মানব জীবনের সর্বদিকেই এ কিতাবে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সকল সমস্যার সমাধান গ্রন্থ হল আল-কুরআন, যা বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। পৃথিবীতে কুরআন একটি বিজ্ঞান গ্রন্থ হিসাবে নাযিল না হলেও এটি সকল জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই বলা যায় যে, কুরআন এমন এক আসমানী গ্রন্থ, যা অজানাকে জানার ও অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল তথ্যের এক বিপুল সমাহার। এ অর্থে বিজ্ঞান কুরআনের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সুতরাং আল-কুরআন সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস।

কোন বিষয়কে যথাযথ অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার কলাকৌশলের নাম বিজ্ঞান। অন্যভাবে বলা যায় যে, সুশৃঙ্খল, সুসংহত ও সাধারণ পদ্ধতিগত আলোচনার মাধ্যমে কোন বিষয়ের তত্ত্ব উদঘাটনই বিজ্ঞান। আর পৃথিবীতে কুরআন একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানময় গ্রন্থ, যার তথ্যাবলী কখনো কোন ধরনের সন্দেহের মাঝে পড়েনি এবং পড়বেও না। বরং বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মোট ৭৫৬টি আয়াতে বিজ্ঞান চর্চার অনুপ্রেরণা দেয়া হয়েছে। আল-কুরআনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পর্যালোচনা ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া হাদীছেও বিজ্ঞান চর্চা ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিবরণ লক্ষ্য করা যায়। মূলত আধুনিক বিজ্ঞানের মূল উৎসই হল আল্লাহ প্রদত্ত অহী তথা আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছ।

তাওহীদই হল বিজ্ঞান ও কুরআনের যোগসূত্র

আল্লাহ তা‘আলা মহাবিজ্ঞানী। তাঁর গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে অনেকগুলো নাম বিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করেছে। যেগুলোর মূলসূত্র হল আল-কুরআন। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলার নাম হিসাবে নিম্নোক্ত নামগুলো বিজ্ঞানের সাথে সরাসারি সম্পৃক্ত। যেমন, اَلْخَالِقُ ‘সৃষ্টিকারী’, اَلْبَارِئُ ‘আবিষ্কারক’, اَلْمُصَوِّرُ ‘রূপদানকারী’, بَدِيْعُ ‘অস্তিত্ব প্রদানকারী’, اَلْبَصِيْرُ ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’, اّللَّطِيْفُ ‘গভীর পর্যবেক্ষক’,  اَلْخَبِيْرُ ‘মহাবিজ্ঞ’,  حَفِيْظُ ‘মহা সংরক্ষক’, اَلرَّقِيْبُ ‘তীক্ষ্ম দৃষ্টিনিক্ষেপকারী’, اَلظَّاهِرُ ‘প্রকাশকারী’,  اَلْجَامِعُ ‘একত্রকারী, اَلْهَادِيُ ‘পথপ্রদর্শক’ এবং اَلنَّافِعُ ‘উপকারকারী’ ইত্যাদি।

সুধী পাঠক! আল্লাহ তা‘আলার উক্ত নামগুলোর মধ্যেই বিজ্ঞান নিহিত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, বিজ্ঞান চর্চা মানেই নাস্তিকতার চর্চা। প্রকৃতপক্ষে তা নয়, বরং বিজ্ঞান মানুষকে এক আল্লাহর উপর বিশ্বাসে প্রেরণা যোগায়। মূলত ইসলাম হল আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত দ্বীন আর বিজ্ঞান হল আল্লাহর বিধান ও নিয়মাবলী অধ্যয়নের নাম। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর বিধান এবং আধুনিক বিজ্ঞানকে অধ্যয়ন ব্যতীত ইসলাম ও কুরআনকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কুরআনী অনুপ্রেরণা থেকেই বিজ্ঞান চর্চার মূল উৎস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ ہُوَ الَّذِیۡ مَدَّ الۡاَرۡضَ وَ جَعَلَ  فِیۡہَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡہٰرًا ؕ وَ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ جَعَلَ فِیۡہَا زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّہَارَ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ  یَّتَفَکَّرُوۡنَ

‘তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পর্বত নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকার ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়; তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; এতে অবশ্যই নিদর্শন আছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (সূরা আর-রা‘দ : ৩)। উক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হল যে, কুরআন একটি বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَ الۡقُرۡاٰنِ  الۡحَکِیۡمِ  ‘শপথ প্রজ্ঞাময় কুরআনের’ (সূরা ইয়াসিন : ২)।

এক্ষণে আল-কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে একটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ :

আল-কুরআন ও মানব সৃষ্টিতত্ত্ব

আধুনিক বিজ্ঞান মানব সৃষ্টি সম্পর্কে যে তত্ত্ব দিয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে তার বর্ণনা দিয়েছেন। গবেষণা করলে মানব সৃষ্টির মোট সাতটি স্তরের কথা কুরআনে পাওয়া যায়।

প্রথম ধারা : ভ্রুণ সৃষ্টি

প্রথম স্তর : سلالة ‘মাটির সার নির্যাস’ । আল-কুরআনে মানব সৃষ্টির প্রথম পর্যায় হিসাবে سُلَالَةٌ مِّنْ طِيْنِ ‘মাটির সার নির্যাস’ উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ  مِّنۡ طِیۡنٍ ‘আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির মূল উপাদান হতে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১২)। এছাড়া মানুষ যে মাটির তৈরি সে সম্পর্কে কুরআনে আরো অনেক আয়াত বর্ণিত হয়ছে।[১] প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত এই তত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানও সমর্থন করে তারা ঘোষণা করেছে যে, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা মাটির বিশেষ পদার্থ Protoplasm থেকে সৃষ্টি করেছেন।

দ্বিতীয় ধারা : ভ্রুণের ক্রমবিকাশ

দ্বিতীয় স্তর : اَلنُّطْفَةُ বা শুক্রাণু। অর্থ এক ফৌঁটা তরল পদার্থ। এই নুত্বফাহ দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ‘তিনি শুক্র হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আন-নাহল : ৪)।[২] আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে যে, মানুষের সৃষ্টি এক ফোঁটা তরল পদার্থ হতেই হয়েছে। কেননা মানুষের ভ্রুণ তৈরি করতে শুক্রাণুর একটা ক্ষুদ্র অংশ বিরাট গুরুত্বপূর্ণ রাখে। এই শুক্রাণু অবস্থায় মাতৃগর্ভে ৪০ দিন পর্যন্ত থাকে।[৩] গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, একজন পুরুষ একবারের মিলনে কয়েক ঘনসেন্টিমিটারে স্পারমাটোজোয়া (Spermatozoa) তথা শুক্র স্খলন করে থাকে। আর এক ঘনসেন্টিমিটার শুক্রে ২ কোটি ৫০ লক্ষ শুক্রকীট থাকে। এই অসংখ্য শুক্রকীটের মধ্যে মাত্র একটি শুক্রকীট গর্ভাশয়ের ডিম্বাণুর সঙ্গে মিশে গর্ভধারণ করে এবং সন্তান উৎপাদনক্ষম হয়। কুরআনের আয়াতের সাথে বিজ্ঞানের এই পরিপূর্ণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য প্রকৃতপক্ষে অকল্পনীয় ব্যাপার।

এই স্তরে অর্থাৎ শুক্রাণু ৪০, ৪২ অথবা ৪৫ দিন অতিবাহিত পর যখন তা গর্ভাশয়ে স্থিতি লাভ করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে আকৃতি দান করা, কানে শোনা, দেখা, চামড়া, গোশত ও হাড় গঠন ও দেহ সৌষ্ঠব দেয়ার জন্য একজন ফেরেশতা পাঠান। অতঃপর এ সময় সে ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তা নির্ধারণ করেন।[৪] 

তৃতীয় স্তর : اَلْعَلَقَةُ ‘জমাট রক্ত’। এটি জমাটবদ্ধ, সংলগ্ন রংক্তপিণ্ড বা কিছু আটকে থাকা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল-কুরআনে শব্দটি মোট ৫টি স্থানে ব্যব্যহৃত হয়েছে।[৫] এমনকি আল্লাহ তা‘আলা ‘আল-‘আলাক্ব বা জমাট রক্ত’ শিরোনামে আল-কুরআনের একটি সূরার নামও নির্ধারণ করেছেন। এটা জরায়ুর মধ্যে আটকে থাকা অবস্থায় রক্ত গ্রহণ করে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘লিচ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি একজি জোঁক রক্ত চুষে যে রূপ ধারণ করে তাকেও ‘আলাক্ব বা জমাটবদ্ধ রক্ত বলা হয়। মেডিকেল সাইন্স এটাকে ব্লাস্টোসিস্ট (Blastocyst) বা জমাট রক্ত বলা হয়। এই ‘আলাক্বাব জমাটবদ্ধ রক্তপি- আকারে মাতৃগর্ভে ৪০দিন পর্যন্ত থাকে।[৬] বৈজ্ঞানিক এই থিওরিকে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক্ব বা জমাট রক্ত থেকে’ (সূরা আল-‘আলাক্ব : ২)।

চতুর্থ পর্যায় : اَلْمُضْغَةٌ বা গোশত পিণ্ড। অর্থ চর্বিত গোশত পিণ্ড অর্থাৎ যে গোশতকে দাঁত দিয়ে চিবানো হয়েছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটিকে সোমাইটস (Somites) বা গোশত পিণ্ড বলা হয়। এ পর্যায়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জমাটবদ্ধ রক্তকে আল্লাহ তা‘আলা গোশত পিণ্ডের আকার প্রদান করেন, যা গোশত বৃদ্ধি পাওয়ার ভিত্তিমূল। সুবহানাল্লাহ! আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ثُمَّ  جَعَلۡنٰہُ  نُطۡفَۃً  فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ- ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً  فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً

‘তঃপর আমরা ওকে শুক্রবিন্দু রূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আঁধারে। পরে আমরা শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, অতঃপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি গোশতপিণ্ডে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১৩-১৪)।

সুধী পাঠক! মানব সৃষ্টির এই পর্যায়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, জমাটবদ্ধ রক্তপিণ্ড যখন গোশতপিণ্ডে রূপ লাভ করে, যার মেয়াদকাল ৪০ দিন পর্যন্ত।[৭]  

পঞ্চম পর্যায় : عِظَامٌ বা অস্থি বা কঙ্কাল। এই পর্যায়কে বিজ্ঞানে স্কেলেটন (Skeleton) বলা হয়। এ স্তরে প্রথমে যে অস্থিগুলো দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে উপরিভাগের কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। প্রাথমিক ৬ সপ্তাহে এই কচি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মেসেনচিম্যাল বা বাড়ন্ত সংবেদনশীল সেল বা টিস্যুগুলো কোমল অস্থিতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ অস্থির স্বচ্ছ মডেল গঠন করে। ৬ সপ্তাহের শেষের দিকে উপরের দিকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কঙ্কালের পূর্ণাঙ্গ কোমল মডেল প্রদর্শন করে। ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রুণের একটি ক্ষুদ্র পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল গঠিত হয়। যেখানে মোট ৩৬০টি জোড়া থাকে আর হাড় থাকে মোট ২০৬টি। আল্লাহ তা‘আলা এই কথায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا ‘অতঃপর আমরা গোশতপিণ্ডকে অস্থিতে রূপান্তরিত করি’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১৪)। হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِنَّهُ خُلِقَ كُلُّ إِنْسَانٍ مِنْ بَنِى آدَمَ عَلَى سِتِّيْنَ وَثَلَاثِمَائَةِ مَفْصِلٍ ‘প্রতিটি আদম সন্তানকে ৩৬০ জোড়া হাড় দ্বারা যথাযথভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[৮]

সুধী পাঠক! মানব শরীরে এই ৩৬০টি জোড়া হাড় বা গ্রন্থি মানুষকে বসতে, দাঁড়াতে, কাত হতে সহায়তা করে। এগুলোর যথাযথ কাঠামোবদ্ধতার ফলেই মানুষ হাত, পা, মাথা ইত্যাদি শরীর অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গুলো নাড়াচাড়া করতে পারে। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, যদি হাড়ের ই বৈচিত্রতা না থাকত, তাহলে কোন মানুষ দাঁড়ানো থেকে বসতে পারত না কিংবা বসলে শুতে পারত না অর্থাৎ কোন নাড়াচারা তার পক্ষে সম্ভব হত না। তাহলে মানুষের জীবন একটি জড় পদার্থ ছাড়া কল্পনাও করা যাবে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে ৩৬০ টি জোড়া হাড়ের মাধ্যমে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি। আল্লাহু আকবার!

ষষ্ঠ পর্যায় : اَللَّحْمُ বা মাংসপেশি। এই পর্যায়কে আধুনিক বিজ্ঞানে মাসলস (Muscles stage) মাংসপেশি তৈরির স্তর বলা হয়। মানব কঙ্কালো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর সংবেদনশীল সেলগুলো ৭ম সপ্তাহের পর থেকে বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং অস্থিগুলো যথাযথ আকার ধারণ করে। ৮ম সপ্তাহ থেকে হাড়ের চারিপাশে পেশিতন্ত্র আবৃত হতে থাকে। ৮ম সপ্তাহ শেষ হলে নির্দিষ্ট পেশিতন্ত্র, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মাথা সৃষ্টি হয়ে উঠে। এ সময় ভ্রুণ নাড়াচাড়া করতে সক্ষম হয়। সুবহানাল্লাহ! এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ‘অতঃপর অস্থিকে পরিপূর্ণ মাংসপেশিতে (মানব আকৃতিতে) রূপান্তরিত করে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১৪)।

সপ্তম পর্যায় : اَلرُّرْحٌ বা আত্মা। মানব সৃষ্টির সর্বশেষ পর্যায় হল তার মধে রূহ বা Foetus তথা আত্মার সঞ্চার করা। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষের সেই নুতফা বা শুক্রাণুকে একটি পরিপূর্ণ মানবশিশুতে পরিণত করেন। গর্ভে থাকার পূর্ণ সময় পরে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ‘অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১৪)। ষষ্ঠ পর্যায়ে অর্থাৎ ৮ম সপ্তাহে পেশিতন্ত্র, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মাথা সৃষ্টির পর ভ্রুণটি নাড়াচাড়া শুরু করে দেয়, যা তার মধ্যে রূহ সঞ্চার হওয়ার লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ثُمَّ سَوّٰىہُ  وَ نَفَخَ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِہٖ ‘অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেন এবং তাতে রূহ সঞ্চার করেন’ (সূরা আস-সিজদাহ : ৯)।

মাতৃগর্ভে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেন। অতঃপর তার আমল, মৃত্যুকাল, রিযিক এবং সে হতভাগা না সৌভাগ্যবান সে বিষয়ে ফেরেশতা লিখে দেন।[৯]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে মানব সৃষ্টি করেছেন তা সত্যিই অকল্পনীয় ব্যাপার। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচিত হলেও এর সকল তথ্যাদি, উৎসমূল মূলত আজ থেকে দেড় হাজার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। আল-কুরআন যে বিজ্ঞানময় এবং বৈজ্ঞানিক থিওরি এবং বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্যের বিপরীত নয় বরং মূল উৎসধারা তা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ অকপটে স্বীকার করেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ। বিজ্ঞানবিমুখ মুসলিমদের এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

তথ্যসূত্র :
[১]. সূরা ছোয়াদ : ১১, ৭১-৭২; সূরা আন-নূহ : ১৭; সূরা আস-সিজদাহ : ৭; সূরা আর-রূম : ২০।
[২]. এ প্রসঙ্গে আরো আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন, সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ৩৭; সূরা আদ-দাহর : ২; সূরা আন-নূহ : ১৪; সূরা আল-মুমিনূন : ১৩-১৪ ।
[৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৩; মিশকাত, হা/৮২ ।
[৪]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৪-২৬৪৫।
[৫]. স্থানগুলো হল, সূরা আল-হজ্জ : ৫; সূরা আল-মুমিনূন : ১২-১৪; সূরা আল-মুমিন : ৬৭; সূরা আল-ক্বিয়ামাহ ; ৩৬-৪০; সূরা আল-‘আলাক্ব : ১-৩ ।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৩; মিশকাত, হা/৮২ ।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২০৮।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৭; মিশকাত, হা/১৮৯৭ ।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৩; মিশকাত, হা/৮২ ।






ফেসবুক পেজ