শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন

মানব মস্তিষ্ক: একটি আধ্যাত্মিক উদয়ের প্রয়াস

-শাকীরুল ইসলাম*



بسم الله الرحمن الرحيم، الحمد لله الذي بنعمته تتم الصالحات، وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه وسلم، أما بعد، فأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله

মহান আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহে মানবজাতি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির উপাধি লাভ করেছে। তাঁর সান্নিদ্ধ এবং সর্বশক্তি সহকারে, মানব মস্তিষ্কের দীপ্তি এবং উন্নতি অনুভব করা যায়। মানুষের জীবন সম্পূর্ণ সৃষ্টির একটি অদ্বিতীয় উপহার। সবকিছুতে আল্লাহর অসীম ভালোবাসা এবং করুণা দেখা যায়। তবে মানব মস্তিষ্ক এই সৃষ্টির সবচেয়ে মহাচমক, যা আল্লাহ মানুষকে দান করা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ অধ্যয়ন, যা আল্লাহ তা‘আলা যে স্বয়ং মানুষের প্রকৃত মা‘বূদ এবং তাঁর যে নির্দিষ্ট নাম ও গুণাবলী রয়েছে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির স্রষ্টা এবং সবকিছুর মালিক। তাঁর মানুষ সৃষ্টির প্রণালীর মধ্যে আল্লাহর প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং তিনি যে সকল কর্মের পরিপূর্ণ সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিস্থাপনকারী তা স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। মানব মস্তিষ্ক তার নিত্য কাজ প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত এবং এটি আমাদের অনেক অপূর্ণ উদ্যমিতা সরবরাহ করে।

প্রস্তাবনা

ইসলামী শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানব মস্তিষ্ক হল আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মানবজাতির উপর অমূল্য সৃষ্টির এক মূর্ত করুণা। ইসলামে মানব শরীরের একটি অভিন্ন অংশ হিসাবে মস্তিষ্ককে দেখা হয়, যা বিশ্ব বোঝার জন্য এবং জীবনের উদ্দেশ্য সাধনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  ইসলাম মানবজাতির মস্তিষ্কের জটিলতা বোঝার গুরুত্ব সমালোচনা করে, কারণ এটি আধ্যাত্মিক উদয়ের একটি উপায়। এই নিবন্ধে আমরা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে মানব মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে অনুসন্ধান করবো, যাতে করে জ্ঞানের খোঁজ করা, সুবিচার নেয়া এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে আরও গভীর সংযোগ গড়ে তোলার তাৎপর্য গভীরভাবে উদ্ভাসিত হয়।

মানব মস্তিষ্কের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

মানুষের মস্তিষ্ক চারটি স্তরে বিভক্ত। যথা:

  1. সেরিব্রাম (Cerebrum): মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ, সচেতন চিন্তা, স্বেচ্ছামূলক ক্রিয়া, উপলব্ধি বা সংবেদন এবং স্মৃতির জন্য দায়ী।
  2. সেরিবেলাম (Cerebellum): মস্তিষ্কের পেছনে অবস্থিত, এটি চালন আদিগতি, সমর্থন বা ভারসাম্য এবং অঙ্গবিন্যাস সমন্বয় করে।
  3. ব্রেনস্টেম (Brainstem): মস্তিষ্ককে মেরুদ-ের সাথে সংযুক্ত করে এবং শ্বাস, হৃদস্পন্দন এবং হজমের মত মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।
  4. করপাস ক্যালোসাম (Corpus Callosum): স্নায়্তুন্ত্রগুলোর একটি বান্ডিল যা বাম এবং ডান  গোলার্ধকে সংযুক্ত করে, তাদের মধ্যে যোগাযোগের সুবিধে দেয়।
মানুষের মস্তিষ্ক একটি অত্যন্ত জটিল এবং পরিশীলিত অঙ্গ, যা স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে।  এটি বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংবেদনশীল ইনপুট ব্যাখ্যা করা এবং চিন্তা, স্মৃতি, যুক্তি এবং আবেগের মত জ্ঞানীয় ফাংশনগুলোকে সক্ষম করার জন্য দায়ী।  মস্তিষ্ক কোটি কোটি স্নায়ু কোষ নিয়ে গঠিত, যা নিউরন নামে পরিচিত, যা বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক সংকেতের জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ করে।  এই জটিল কাঠামোটি মস্তিষ্ককে মৌলিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপ থেকে জটিল জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া পর্যন্ত একটি অবিশ্বাস্য পরিসরের কাজ সম্পাদন করতে দেয়।  মস্তিষ্কের ক্ষমতাগুলো এর অসাধারণ নকশা এবং জৈবিক বিবর্তনের শীর্ষস্থানের প্রমাণ।

আরেকটি সত্য রয়েছে, যা স্নায়ু কোষের বড় জটিলতা দেখায়, তা হল প্রতিটি নিউরন ফ্রন্টাল লোব এবং সেরিবেলাম ব্যতীত মস্তিষ্কের সমস্ত অংশ থেকে দশ হাজার সিন্যাপ্স (Synapses) গ্রহণ করে।  ফ্রন্টাল লোবে প্রতিটি কোষ চল্লিশ হাজার সিন্যাপস গ্রহণ করে, কিন্তু সেরিবেলামের জন্য, এর পাঁচ ধরনের কোষের এক প্রকার, যথা পুরকিঞ্জি কোষ (Purkinji Cells)- ত্রিশ মিলিয়ন কোষ- তাদের প্রত্যেকে এক মিলিয়ন সিন্যাপ্স গ্রহণ করে।

পূর্ণবয়স্ক মানব মস্তিষ্কের গড় ওজন প্রায় ১.২১.৪ কেজি (২.৬৩.১ পাউন্ড), যা মোট শরীরের ওজনের প্রায় ২%।[১] পুরুষদের জন্য প্রায় ১২৬০ cm³ ও নারীদের জন্য প্রায় ১১৩০ cm³ ভলিউমে।[২] ব্যক্তিগত পরিমাণে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে, পুরুষদের জন্য মান (Standard Reference Range) বলতে ১,১৮০-১,৬২০ গ্রাম (২.৬০-৩.৫৭ পাউন্ড)[৩] এবং নারীদের জন্য ১,০৩০-১,৪০০ গ্রাম (২.২৭-৩.০৯ পাউন্ড)[৪] ধরা হয়। তবে, এই ওজনের পার্থক্যের মধ্যে কোনও কার্যক্ষমতা বা বুদ্ধিমত্তা এর প্রভাব প্রদর্শন করেনি।[৫] তিনটি প্রধান বিভাগ রয়েছে: সেরিব্রাম (Cerebrum), সেরিবেলাম (Cerebellum), ব্রেইনস্টেম (Brainstem)। সেরিব্রাম দু’টি সেরিব্রাল গোলার্ধ নিয়ে গঠিত যা বাইরের স্তর যাকে কর্টেক্স (ধূসর পদার্থ) বলে এবং ভিতরের স্তর (সাদা পদার্থ)। কর্টেক্সে চারটি লোব রয়েছে, ফ্রন্টাল লোব, প্যারিটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, অক্সিপিটাল লোব। 

মস্তিষ্কের লোব (Brain Lobe)

১. ফ্রন্টাল লোব (Frontal Lobe): সেরিব্রাল গোলার্ধের সামনের অংশে অবস্থিত ফ্রন্টাল লোব মানবদেহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। যেমন,

  • ক. সম্ভাব্য স্মৃতি (Prospective Memory): জ্ঞানীয় সংগঠনে অবদান রেখে এটি দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মনে রাখতে সাহায্য করে।[৬]
  • খ. বক্তৃতা এবং ভাষা (Speech and Language): ফ্রন্টাল লোবের ব্রোকা এলাকা, যা পোস্টেরিয়ার ইনফেরিয়ার ফ্রন্টাল জাইরাসে (Posterior Inferior Frontal Gyrus) পাওয়া যায়, বক্তৃতা উৎপন্ন এবং ইন্দ্রিয়গত সংবেদনশীলতা থেকে শারীরিক চঞ্চালন বা মোটর মধ্যস্থিতা প্রসারণে ভূমিকা পালন করে।
  • গ. ব্যক্তিত্ব (Personality): ফাইনাস গেজের (Phineas Gage) মত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ফ্রন্টাল লোবের ক্ষতির কারণে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন দেখায়, যার মধ্যে ভাবনামূলক (মানসিক) অতিসংবেদনশীলতা, অনুপযুক্ত আচরণ এবং প্রতিবন্ধী বিচার বা মৌলিক বিচার সম্প্রসারণের জন্য উপযুক্ত হয়ে থাকে।
  • ঘ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Decision Making): ফ্রন্টাল লোব যুক্তি, শিক্ষা এবং সৃজনশীলতায় জড়িত।  চজঙইঊ[৭] মডেল (২০১২ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় এই মডেলটি প্রস্তাব করা হয়েছিল) পরামর্শ দেয় যে, মস্তিষ্কটি বিভিন্ন আচরণশীল পদ্ধতি মূল্যায়ন করে এবং একটি পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত কৌশল নির্বাচন করে।
  • ঙ. চলন নিয়ন্ত্রণ (Movement Control): ফ্রন্টাল লোবের মোটর কর্টেক্সকে প্রাথমিক চলন এলাকা এবং অ-প্রাথমিক চলন এলাকার প্রাধান্য দিয়ে দেয়, যা স্বেচ্ছিক চলনে প্রভাবিত হয়। এই অঞ্চলগুলোর নির্ধারিত ভূমিকা এখনও চলমান তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

ফ্রন্টাল লোব হল মানসিক নিয়ন্ত্রণ এবং আচরণের কেন্দ্র এবং আমাদের ব্যক্তিত্বের একটি ঘর। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুপ্রেরণা, সত্যবাদিতা, সূচনা আচরণ, এবং পরিণতি স্বীকৃতি সহ জ্ঞানীয় ফাংশন পরিচালনার ক্ষেত্রে ফ্রন্টাল লোবের প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলকে হাইলাইট করে। এটি স্বেচ্ছাসেবী প্রেরণা এবং এমনকি আগ্রাসনের সাথে যুক্ত। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex) ডরসোল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Dorsolateral Prefrontal Cortex), অর্বিটাল ফ্রন্টাল কর্টেক্স (Orbital Frontal Cortex) এবং ভেন্ট্রাল ল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Ventral Lateral Prefrontal Cortex) নিয়ে গঠিত। নিউরোসায়েন্টিস্টগণ, ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্টগণ এবং ক্রিমিনোলজিস্টগণ দ্বারা গবেষণায় প্রকাশিত যে, এটি আবেগ বজায় রাখা (সম্প্রেক্ষিত ভাবনা), উপযুক্ত আচরণ এবং সামাজিক নিয়মানুসার অনুসরণে ভূমিকা পালন করে। প্রিফ্রন্টাল ক্ষতিগ্রস্ত রোগীরা মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখায়। যেমন ছোটখাটো বিষয়ে মেজাজ হারানো। ফ্রন্টাল লোব অপরাধের সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা করে, যেখানে অর্বিটাল ফ্রন্টাল কর্টেক্স নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা করে। কুরআনও এই আবিষ্কারগুলোর সাথে মিল খায়, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে অনৈতিক আচরণের স্থান হিসাবে প্রদর্শন করে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং কুরআনের শিক্ষার মধ্যে এই সারিবদ্ধতা উভয় ক্ষেত্রেই নিরবধি জ্ঞানের উপর জোর দেয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলছেন,

اَلَمۡ یَعۡلَمۡ بِاَنَّ اللّٰہَ یَرٰی- کَلَّا لَئِنۡ لَّمۡ یَنۡتَہِ ۬ۙ  لَنَسۡفَعًۢا بِالنَّاصِیَۃِ- نَاصِیَۃٍ کَاذِبَۃٍ خَاطِئَۃٍ

‘সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন? কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই। মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ’ (সূরা আল-‘আলাক্ব: ১৪-১৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنِّیۡ تَوَکَّلۡتُ عَلَی اللّٰہِ رَبِّیۡ وَ  رَبِّکُمۡ ؕ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ  اِلَّا ہُوَ اٰخِذٌۢ  بِنَاصِیَتِہَا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

‘আমি তো আল্লাহর উপর ভরসা করেছি, যিনি আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। ভূমিতে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার ঝুঁটি তাঁর মুঠোয় নয়। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সরল পথে রয়েছেন’ (সূরা আল-হূদ: ৫৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,

یُعۡرَفُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ بِسِیۡمٰہُمۡ فَیُؤۡخَذُ بِالنَّوَاصِیۡ وَ الۡاَقۡدَامِ

‘অপরাধীদেরকে (মুশরিক, অপরাধী, পাপী) তাদের আলামত (চেহারায় থাকবে বিষণ্ণতার ছাপ, যার রং হবে কালো) দ্বারা চেনা যাবে। তারপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে তাদের পা ও মাথার অগ্রভাগের চুল ধরে’ (সূরা আর-রহমান: ৪১)।

কুরআনের আয়াতগুলো মাথার অগ্রভাগকে (Forelock) অন্যায়ের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরে, যা আচরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ফ্রন্টাল লোবের ভূমিকা সম্পর্কে আধুনিক নিউরোসায়েন্সের বোঝার সমান্তরালভাবে। সূরাহ হুদের আয়াতটি মাথার অগ্রভাগের (Forelock) উপর আল্লাহর আঁকড়ে ধরা তার কর্ম সম্পর্কে সচেতনতার সাথে মিলে যায়। সূরা আর-রহমানের আয়াতটি মাথার অগ্রভাগকে অপরাধীদের সাথে সংযুক্ত করে। এই প্রান্তিককরণটি প্রতারণা এবং অসদাচরণে ফ্রন্টাল লোবের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কুরআনের অন্তর্দৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়, তার নিরবধি জ্ঞানের উপর জোর দেয়।

২. টেম্পোরাল লোব (Temporal Lobe): মস্তিষ্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ, সংবেদনশীল উপলব্ধি, স্মৃতি এবং ভাষা প্রক্রিয়াকরণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্শ্বীয় এবং মধ্যম পৃষ্ঠে বিভক্ত।[৮] এটি অপরিহার্য অঞ্চলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন,

পার্শ্বীয় পৃষ্ঠটি উচ্চতর টেম্পোরাল গাইরাস (Temporal Lobe), মধ্যম টেম্পোরাল গাইরাস (Middle Temporal Gyrus) এবং ইনফেরিওর টেম্পোরাল গাইরাস (Inferior Temporal Gyrus) বৈশিষ্ট্যযুক্ত। সুপিরিয়র টেম্পোরাল জাইরাস (STG) মৌলিক শ্রবণ কর্মক্ষেত্র (Primary Auditory Cortex) ধারণ করে, যেখানে শব্দ প্রসেসিং সম্পন্ন হয়। এর Herschel gyrus শব্দ টোন ব্যাখ্যা করে, যখন ডবৎহরপশব এর এলাকা ধ্বনিতাত্ত্বিক উপস্থাপনা পরিচালনা করে। মধ্য টেম্পোরাল গাইরাস (MTG) শব্দার্থিক মেমরি এবং পুনরুদ্ধারের সঙ্গে জড়িত, যখন পোস্টেরিয়র MTG সংবেদনশীল ভাষার কাজগুলোকে সহায়তা করে।

ইনফেরিওর টেম্পোরাল গাইরাস (IT) চাক্ষুষ এবং মুখের উপলব্ধিতে অংশগ্রহণ করে।[৯] মধ্যবর্তী মানব পৃষ্ঠভাগে, হিপোক্যাম্পাস (Hippocampus), এন্টরোহিনাল (Entorhinal), পেরিহিনাল (Perirhinal) এবং পারাহিপ্পোক্যাম্পাল (Para hippocampal) কর্টেক্সের মত গঠন করে, যা স্মৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সূচনামূলক মেমরির জন্য প্রয়োজনীয়। এই প্রকারের মেমরি সেমান্টিক, পরিচিতি এবং ইপিসোডিক মেমরি একত্রিত করে।

সুতরাং এখানে একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপসংহারে বলা যায়, টেম্পোরাল লোব স্মৃতি গঠন, শেখার এবং বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  এটি হিপোক্যাম্পাস ধারণ করে, স্মৃতি গঠনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো।  এটি আল্লাহ ও তাঁর শিক্ষাকে স্মরণ করার উপর কুরআনের জোরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য মুমিনদেরকে উৎসাহিত করে বলা হয়েছে: فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ  ‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো’ (সূরা আল-বাক্বারা: ১৫২)। টেম্পোরাল লোবের জটিল কার্যক্রমগুলো সক্রিয়ভাবে গবেষণা করা হচ্ছে, যা সেন্সরি অনুভূতি, স্মৃতি এবং মনোবুদ্ধিক কাজে তার গঠনগুলোর জটিল সংমিলনটি প্রকাশ করে।

এছাড়াও টেম্পোরাল লোব, একটি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের অঞ্চল, মানসিক অভিজ্ঞতা, মেজাজ উচ্চতা এবং আমাদের আত্মবোধের সাথে যুক্ত। এটি একটি ‘আধ্যাত্মিক স্মরণ স্থান (Spiritual Remembrance Spot)’ হিসাবে সন্দর্ভিত হয়েছে, যা আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করে। এই মস্তিষ্কে ধার্মিক অবস্থানের একটি ভূমিকা আছে যা জীবন পরিবর্তন করতে পারে, সম্ভবতঃ এর অধিশীলনের ফলে। গবেষণা প্রকাশ করে যে, আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপের সময় নিউরাল ক্রিয়ার পরিবর্তন হয় অর্থাৎ  মস্তিষ্কের ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে। যাইহোক, বিতর্ক উদ্ভাসিত হয়; যখন কিছু টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি (TLE) এর সাথে হাইপার-রিলিজিওসিটি যুক্ত। TLE, অস্বাভাবিক টেম্পোরাল লোব কার্যকলাপ সহ একটি অবস্থা, খিঁচুনি হতে পারে।  TLE ব্যক্তিরা ধর্মীয় হ্যালুসিনেশন এবং অতীন্দ্রিয় আভাস অনুভব করে, যা আধ্যাত্মিক সংবেদনের দিকে পরিচালিত করে।  তবুও, কেউ কেউ যুক্তি দেন যে TLE এর প্রভাব শারীরিক কারণগুলোর মধ্যে নিহিত যেমন কম অক্সিজেন বা ক্লান্তি, যেটি সরাসরি আধ্যাত্মিক সংযোগে চ্যুতি করার মুখোমুখি থাকে।[১০]

কুরআনে ‘যিকর’ ধারণার উল্লেখ করা হয়েছে, যা আল্লাহর স্মরণকে বোঝায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُہُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰہِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণ দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর (মস্তিষ্ক) সমূহ শান্তি পায়’ (সূরা আর-রা‘দ: ২৮)।

এই আধ্যাত্মিক অনুশীলনটি স্মৃতি এবং মানসিক অভিজ্ঞতায় টেম্পোরাল লোবের ভূমিকার সাথে অনুরণিত হয়। এই আয়াতের মাধ্যমে ‘আধ্যাত্মিক স্মরণ স্থান’ এরও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, আয়াতে বলা হয়েছে অন্য এক প্রতিশব্দে ‘হৃদয় তৃপ্তি’, সেটা তখনই সম্ভব যখন নিজের মস্তিষ্ক একান্ত চিত্তে আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে আবদ্ধ হয়।

৩. প্যারিয়েটাল লোব (The Parietal Lobe): যা ফ্রন্টাল এবং টেম্পোরাল লোবের মধ্যে অবস্থিত, প্যারিয়েটাল লোবে প্রাথমিক এবং পরবর্তী অঞ্চল রয়েছে। প্রাথমিক অংশে (The Anterior Part) প্রাথমিক সেন্সরি কর্টেক্স (The Primary Sensory Cortex) (SI) রয়েছে, যা স্পর্শ, অবস্থান, ব্যথা এবং আরও বিশেষ গুণ অনুবাদ করে।[১১] পরবর্তী অঞ্চলে (The Posterior Region) সুপিরিয়র প্যারিটাল লোবিউল (The Superior Parietal Lobule) বর্ণনামূলক নিয়ে চলা এবং ইনফেরিয়র প্যারিটাল লোবিউল (Inferior Parietal Lobule) সহ সেকেন্ডারি সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স (SII) দ্বারা যেসব সম্প্রসারণ বৃদ্ধি যা সেন্সরিমোটর পরিকল্পনা, শেখা, ভাষা এবং স্থানীয় চিহ্নিত পরিকল্পনা মত সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহার হয়। এটি স্টেরিওনোসিস (Stereognosis; স্পর্শের অনুভূতি ব্যবহার করে বস্তুর রূপ উপলব্ধি করার ক্ষমতা) সক্ষম করে যা আকার, আকৃতি এবং ওজন দ্বারা বস্তুকে আলাদা করে। উদাহরণস্বরূপ, SII আমাদের সাহায্য করে একটি বস্তুর গুণগত বৈশিষ্ট্য বোঝাতে, যেমন লেখার সময় একটি কলমের আকৃতি চিনতে।[১২]

৪. অক্সিপিটাল লোব (The Occipital Lobe): মস্তিষ্কের কর্টেক্সের সবচেয়ে ছোট লোব, দৃষ্টিগত প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যাখ্যা পরিচালনা করে। এটি পাঁচটি ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রাথমিক ভিজুয়্যাল কর্টেক্স (V1) সর্বপ্রথম ভিজুয়্যাল ইনপুট পেয়ে থাকে। প্রক্রিয়াকৃত তথ্য তারপর বিশ্লেষণের জন্য ইনফেরিওর টেম্পোরাল লোবের মত মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হয়। এটি আমাদের বস্তু চিনতে, তুলনা করতে এবং বুঝতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, অক্সিপিটাল লোব আমাদেরকে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে শনাক্ত করতে এবং পার্থক্য করতে সক্ষম করে।[১৩]

পরিচিত কথা

ইসলামী শিক্ষা শুধু একটি শিশুর লালন-পালনের উপর জোর দেয় না বরং বিশ্ব মানবতার উপর এর গুরুত্ব প্রকাশ করেও কখনও অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সকলের প্রতি ইসলামী শিক্ষা অসীম পর্যায়ের যা ইতিবাচক মানসিকতা, চরিত্র এবং আচরণের উপর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রভাব পড়ে। যদিও নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের লোবের আলোচনা ইসলামিক উৎসগুলোতে সরাসরি সম্বোধন না থাকলেও, তবুও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি উপসংহারের মাধ্যমে গাইড নেয়া যেতে পারে। যেমন,

ক. ফ্রন্টাল লোব

    -আত্ম-নিয়ন্ত্রণ: শিশুদেরকে তাদের আবেগ ও কর্মের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংযম শেখানো। ফ্রন্টাল লোব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের সাথে যুক্ত (সূরা আশ-শূরা: ৩৭; সূরা আল-বাক্বারা: ১৮৮; সূরা আত-তাগাবুন: ১৬; সূরা আল-বাক্বারা: ১৫৩)।

   -সততা: সত্যবাদিতা এবং সততাকে উৎসাহিত করা। কারণ ফ্রন্টাল লোব নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন করে (সূরা আত-তাওবা: ১১৯)।

   -চিন্তাশীল এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা: সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং যুক্তির দক্ষতাকে উৎসাহিত করা, যাতে চিন্তাশীল মনোনিবেশ গড়ে ওঠে (সূরা আর-রূম: ৮,৩৮)।

খ. টেম্পোরাল লোব

    -ইতিবাচক প্রভাব: শিশুদের ইতিবাচক আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং যথাযথ পরামর্শদাতাদের সাথে মেলামেশা করতে উৎসাহিত করা যা মানসিক ভারসাম্য এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে (সূরা আল-কাহ্ফ: ২৮; সূরা আল-হুজুরাত: ১১)।

    -নম্রতা: শিশুদের বিনয় ও নম্রতার মূল্য শেখানো, যা ইসলামী চরিত্র বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ দিক (সূরা আর-রা‘দ: ২৮; সূরা আন-নূর: ৩০-৩১; সূরা আল-ফুরক্বান: ৬৩)।

গ. প্যারিটাল লোব

   -কৃতজ্ঞতা: শিশুদের তাদের চারপাশের আশীর্বাদ চিনতে ও উপলব্ধি করতে উৎসাহিত করে তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা জাগিয়ে তোলা (সূরা ইবরাহীম: ৭; সূরা আন-নাহল: ৫৩)।

    -সহানুভূতি: অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং দয়া শেখানো, কারণ প্যারিটাল লোব সামাজিক সচেতনতার সাথে জড়িত (সূরা আল-ফুরক্বান: ৬৩; সূরা আল-হুজুরাত: ১০)।

ঘ. অক্সিপিটাল লোব

    -সৃষ্টির উপলব্ধি: শিশুদের প্রাকৃতিক জগতের সৌন্দর্যের প্রতি উপলব্ধি গড়ে তুলতে সাহায্য করা, যা বিস্ময় ও বিস্ময়ের অনুভূতি জাগাতে পারে (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৬৪; সূরা আলে ইমরান: ১৯১)।

    -পর্যবেক্ষণ: শিশুদেরকে তাদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও চিন্তা করতে উৎসাহিত করা, কারণ অক্সিপিটাল লোব ভিজ্যুয়াল প্রক্রিয়াকরণের সাথে জড়িত (সূরা আল-গাশিয়া: ১৭-২০; সূরা আল-হাশর: ২১)।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে হয়তো বোঝা গেছে যে কেন মাথায় অর্থাৎ মুখমণ্ডলে আঘাত করা উচিত নয়।[১৪]

স্বাস্থ্য এবং মস্তিষ্কে প্রার্থনার (ছালাত, যিকর ইত্যাদি) প্রভাব

যিকর এবং কুরআন তিলাওয়াতের অনুশীলন মুসলিমদের জন্য গভীর তাৎপর্য রাখে, যা শান্তির পথ এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। সাম্প্রতিক গবেষণা এই অনুশীলনের নিউরোলজিক্যাল প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সন্ধি অনুসন্ধান করে। গবেষণা প্রদর্শন করে যে, যিকর এবং কুরআন তিলাওয়াতের সময় মস্তিষ্ক উচ্চতর আলফা তরঙ্গ কার্যকলাপ প্রদর্শন করে যা শিথিলকরণের সাথে যুক্ত এবং বর্ধিত ডেল্টা তরঙ্গ যা গভীর শিথিলতা এবং আধ্যাত্মিক ব্যস্ততার সাথে সংযুক্ত। এই প্রভাবগুলো মানসিক চাপ হ্রাস এবং উন্নত ভাল স্থিতির অবদান রাখে।

স্বাস্থ্যের উপর ধর্মীয় অনুশীলনের ইতিবাচক প্রভাবও স্পষ্ট।  উদাহরণস্বরূপ, প্রার্থনা (ছালাত) রক্তচাপ কমাতে, বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ দূর করতে সাহায্য করে এবং ধীরে ধীরে বার্ধক্য দেখায়। নিউরলোজিক্যাল ইমেজিং প্রকাশ করে যে মেডিটেশনের মতো প্রার্থনা (ছালাত) ফ্রন্টাল লোব অ্যাক্টিভিটি বৃদ্ধি করে এবং প্যারিটাল লোব অ্যাক্টিভিটি হ্রাস করে, যা সংযোগের অনুভূতি এবং আত্ম-সচেতনতা থেকে মুক্তিকে প্রতিফলিত করে।

মুসলিম হওয়ার ক্ষেত্রে, প্রার্থনায় (ছালাত) উত্তরণযোগ্য আন্তরিক শান্তি এবং ভালোবাসা গভীরভাবে অনুরণিত হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই সুবিধাগুলোকে শক্তিশালী করে, যা কুরআনিক শিক্ষাগুলোর সাথে মেলে যায় যে আল্লাহর স্মরণ হৃদয় নরম করে। আধ্যাত্মিক ভক্তি এবং বৈজ্ঞানিক বোধগম্যতা একসঙ্গে আমাদের ভালোবাসার প্রতি গভীর প্রভাব একটি বোধকর্মণি করে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের উপর প্রার্থনার অমূল্য প্রভাব ঘোষণা করে। কুরআনিক আয়াতের জ্ঞান পুনরাবৃত্ত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَوَیۡلٌ  لِّلۡقٰسِیَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مِّنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে কঠোর’ (সূরা আয-যুমার: ২২)। এই অন্তর্দৃষ্টি পুনরায় নিশ্চিত করে যে প্রার্থনার নিরবধি অনুশীলন আধুনিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

  • কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. লিসা মিলার (Dr. Lisa Miller) দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণায় এটি পাওয়া গেছে যে, যারা নিয়মিত প্রার্থনা করেন তাদের কর্টেক্স মোটা হয়।  স্পষ্টীকরণের জন্য, কর্টেক্সগুলো হল মস্তিষ্কের বাইরের স্তরের গঠন এবং কর্টিকাল পুরুত্ব একটি উচ্চ IQ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত পাওয়া যায়। কর্টেক্সগুলো পাতলা হয়ে গেলে মানসিক অসুস্থতা, বিশেষ করে বিষণ্ণতা হতে পারে।
  • এক গবেষণায় ড. অ্যান্ড্রু নিউবার্গ বলেছেন যে, প্রার্থনা মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ায়, যা একজন ব্যক্তিকে আরও সুখী এবং আরও শান্তিপূর্ণ মানুষ করে তোলে।
  • ব্রিটিশ জার্নাল অফ হেলথ সাইকোলজিতে প্রকাশিত ইউকে-ভিত্তিক একটি গবেষণা অনুসারে, ‘প্রার্থনা আপনার বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের ঝুঁকি কমাতে পারে’।[১৫]

স্মৃতি (Memory)

মস্তিষ্ক আল্লাহর একটি মহৎ সৃষ্টি হিসাবে মানুষকে অন্যান্য জীবের থেকে আলাদা করে এবং তাদের অসাধারণ ক্ষমতা দান করে। গড় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি ট্রিলিয়ন বাইট তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে। স্ট্যানফোর্ড স্টাডি থেকে এটি রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, শুধু সেরিব্রাল কর্টেক্সেই ১২৫ ট্রিলিয়ন সিন্যাপ্স (Synapses) রয়েছে।  অন্য একটি গবেষণায়, এটি জানানো হয়েছিল যে ১ টি সিন্যাপস ৪.৭ বিট (bits) তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে।  নিউরন হল কোষ যা মস্তিষ্কের মধ্যে বার্তাগুলোকে প্রক্রিয়া করে এবং প্রেরণ করে এবং সিনাপ্সগুলো হল নিউরনের মধ্যে সেতু যা প্রেরণ করা বার্তা বহন করে।  সংখ্যাটা এমন দাঁড়ায় - ১২৫ ট্রিলিয়ন সিন্যাপ্স - ৪.৭ বিট/সিনাপ্স, এবং প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বাইট সমান ১ টিবি (টেরাবাইট)। [১৬]

এই স্টোরেজ ক্ষমতা ৭৪ টেরাবাইটের বেশি (শুধু সেরিব্রাল কর্টেক্সেই)।

হাফিয উল্লাহ আমীন এবং আমীর মালিকের গবেষণা ‘হিউম্যান মেমরি রিটেনশন অ্যান্ড রিকল প্রসেস’ জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞানের স্মৃতির ধারণাকে অন্বেষণ করে, এটিকে সংক্ষিপ্ত-সময়/কাজের মেমরি এবং দীর্ঘ-সময় মেমরিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এটি একটি কোডিং, রিটেনশন এবং রিকল প্রক্রিয়াগুলো উপযুক্ত করে এবং EEGএবং fMRI প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ  فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اَفَلَا  تُبۡصِرُوۡنَ ‘আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (নিদর্শনাবলী)। তবুও কি তোমরা চেয়ে দেখবে না?’ (সূরা আয-যারিয়াত: ২১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَ لَوۡ نَشَآءُ لَمَسَخۡنٰہُمۡ عَلٰی مَکَانَتِہِمۡ فَمَا اسۡتَطَاعُوۡا مُضِیًّا وَّ لَا یَرۡجِعُوۡنَ

‘এবং যদি এটি আমাদের ইচ্ছা হত, তবে আমরা তাদের প্রাণী বা প্রাণহীন বস্তুতে রূপান্তরিত করতে পারতাম’ (সূরা ইয়াসীন: ৬৭)।

মানব মস্তিষ্কের স্মৃতির প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে দেখলে এই দু’টি আয়াত গভীর অন্তর্দৃষ্টি ধরে রাখে। প্রথম আয়াত (সূরা আয-যারিয়াত: ২১), প্রত্যেক ব্যক্তির ভেতর অবস্থিত আল্লাহর সৃষ্টির চিহ্নগুলোর উল্লেখ করে। মানুষের মস্তিষ্ক, একটি অসাধারণ সৃষ্টি, এই লক্ষণগুলোর একটি প্রমাণ বা প্রতিশব্দ। এর নিউরন এবং সিন্যাপসের জটিল নেটওয়ার্কের মধ্যে স্মৃতির ক্ষমতা রয়েছে। মস্তিষ্কের তথ্য, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান সংরক্ষণ ও স্মরণ করার ক্ষমতা আল্লাহর প্রজ্ঞার চিহ্ন হিসাবে কাজ করে।  এই আয়াতটি মানব মস্তিষ্কের অসাধারণ প্রকৃতি এবং তা আমাদের চারপাশের বিশ্ব বুঝার ক্ষমতার উপর চিন্তা করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

দ্বিতীয় আয়াত (সূরাহ ইয়া-সীন ৩৬:৬৭), সৃষ্টির উপর সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই আয়াতটি মানব মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্কতা দেয়। আমাদের তথ্য মনে রাখার, ধারণ করার এবং পুনরুদ্ধারণ করার সক্ষমতা একটি অমূল্য উপহার। আয়াতটি পরামর্শ দেয় যে যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন, আমাদের স্মৃতিশক্তি পরিবর্তন বা হারিয়ে যেতে পারে, আমাদের জ্ঞানীয় কাজ ছাড়াই জীবে রূপান্তরিত করতে পারেন। এটি আল্লাহর হুকুমের উপর মানুষের স্মৃতিশক্তির ভঙ্গুরতা ও নির্ভরশীলতার কথা তুলে ধরে।

মানব মস্তিষ্কের স্মৃতির দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি এই আয়াতগুলো বিবেচনা করার সময়, আয়াতগুলো আমাদের মস্তিষ্কের জটিল নকশা এবং এর উৎসের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথম আয়াতে আমাদেরকে আমাদের নিজেদের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন চিনতে উৎসাহিত করে, যার মধ্যে স্মরণশক্তির অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে আমাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতার উপর আল্লাহর শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেয়, তাঁর অবিচ্ছিন্ন সমর্থন ছাড়া আমাদের স্মৃতির যে  দুর্বলতা তাকে চিত্রিত করে। উভয় আয়াতই আমাদের স্মৃতির উপহারের প্রশংসা করতে, এটিকে বুদ্ধিমানের সাথে ব্যবহার করতে এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা স্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করে।

মস্তিষ্ক গঠন এবং নতুন তথ্য শেখার নির্দেশক হিসাবে কুরআনের অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে আরও একটি আয়াত রয়েছে।

وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ وَ نَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِہٖ  نَفۡسُہٗ ۚۖ وَ نَحۡنُ  اَقۡرَبُ اِلَیۡہِ  مِنۡ  حَبۡلِ  الۡوَرِیۡدِ

‘নিশ্চয় আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমরা জানি তার আত্মা তার কাছে কি ফিসফিস করে এবং আমরা তার [তার] শিরার চেয়েও নিকটবর্তী’ (সূরা কাফ: ১৬)।

এই আয়াতটি স্বীকার করে যে আল্লাহ মানুষের চিন্তাভাবনা এবং অন্তর্নিহিত অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন, যা মস্তিষ্কে জ্ঞান শেখা এবং ধরণ করা প্রক্রিয়াও অন্তর্ভুত থাকে। কুরআনের এই অন্তর্দৃষ্টি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা কুরআনের দূরদর্শিতা এবং কালজয়ী প্রজ্ঞা প্রদর্শন করে। বিগত ৭০ বছরে বিজ্ঞান সেই সত্যগুলো উন্মোচন করেছে যা কুরআন ১৪০০ বছর আগে প্রকাশ করেছিল।

* বিএসসি (অনার্স), ৩য় বর্ষ, বায়োকেমিস্ট্রি, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।

[১]. Parent, A.; Carpenter, M.B. (1995). "Ch. 1". Carpenter's Human Neuroanatomy. Williams & Wilkins. ISBN 978-0-683-06752-1.

[২]. Cosgrove, K.P.; Mazure, C.M.; Staley, J.K. (2007). "Evolving knowledge of sex differences in brain structure, function, and chemistry". Biol Psychiatry. 62 (8): 847–855. Doi:10.1016/j.biopsych.2007.03.001. PMC 2711771. PMID 17544382.

[৩]. Molina, D. Kimberley; DiMaio, Vincent J.M. (2012). ÒNormal Organ Weights in MenÓ. The American Journal of Forensic Medicine and Pathology. 33 (4): 368–372. Doi:10.1097/PAF.0b013e31823d29ad. ISSN 0195-7910. PMID 22182984. S2CID 32174574.

[৪]. Molina, D. Kimberley; DiMaio, Vincent J. M. (2015). ÒNormal Organ Weights in WomenÓ. The American Journal of Forensic Medicine and Pathology. 36 (3): 182–187. Doi:10.1097/PAF.0000000000000175. ISSN 0195-7910. PMID 26108038. S2CID 25319215.

[৫]. Hartmann P, Ramseier A, Gudat F, Mihatsch MJ, Polasek W. [Normal weight of the brain in adults in relation to age, sex, bodz height and weight]. Pathologe. 1994 Jun;15(3):165-70. [PubMed].

[৬]. Neulinger K, Oram J, Tinson H, OÕGorman J, Shum DH. Prospective memory and frontal lobe function. Neuropsychol Dev Cogn B Aging Neuropsychol Cogn. 2016;23(2):171-83. [PubMed].

[৭]. Collins A, Koechlin E. Reasoning, learning, and creativity: frontal lobe function and human decision-making. PLoS Biol. 2012;10(3):e1001293. [PubMed].

[৮]. করবৎহধহ ঔঅ. অহধঃড়সু ড়ভ ঃযব ঃবসঢ়ড়ৎধষ ষড়নব. ঊঢ়রষবঢ়ংু জবং ঞৎবধঃ. ২০১২;২০১২:১৭৬১৫৭. [চঁনগবফ].

[৯]. ঈড়হধিু ইজ. ঞযব ঙৎমধহরুধঃরড়হ ধহফ ঙঢ়বৎধঃরড়হ ড়ভ ওহভবৎরড়ৎ ঞবসঢ়ড়ৎধষ ঈড়ৎঃবী. অহহঁ জবা ঠরং ঝপর. ২০১৮ ঝবঢ় ১৫;৪:৩৮১-৪০২..

[১০]. ঋধৎড়ড়য়, অ., ্ গধমৎধু, অ. ট. ঐ. (২০২২). টহফবৎংঃধহফরহম যঁসধহ নৎধরহ: অ ৎবভষবপঃরড়হ ড়ভ ছঁৎধহ ধহফ ংপরবহপব. ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঐবধষঃয ঝপরবহপবং, ৬(ঝ৪), ৬৮০৯–৬৮১৬.

[১১]. ইবৎষঁপপযর এ, ঠধষষধৎ এ. ঞযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব হবঁৎড়ঢ়যুংরড়ষড়মু ধহফ হবঁৎড়ষড়মু ড়ভ ঃযব ঢ়ধৎরবঃধষ ষড়নব. ঐধহফন ঈষরহ ঘবঁৎড়ষ. ২০১৮;১৫১:৩-৩০.

[১২]. কষরহমহবৎ ঈগ, ডরঃঃব ঙড. ঝড়সধঃড়ংবহংড়ৎু ফবভরপরঃং. ঐধহফন ঈষরহ ঘবঁৎড়ষ. ২০১৮;১৫১:১৮৫-২০৬.

[১৩]. ঐঁভভ ঞ, গধযধনধফর ঘ, ঞধফর চ. ঝঃধঃচবধৎষং [ওহঃবৎহবঃ]. ঝঃধঃচবধৎষং চঁনষরংযরহম; ঞৎবধংঁৎব ওংষধহফ (ঋখ): ঔঁষ ২৫, ২০২২. ঘবঁৎড়ধহধঃড়সু, ঠরংঁধষ ঈড়ৎঃবী.

[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৫৯ পরিচ্ছেদ ৪৯/২০।

[১৫].ঃঃঢ়ং://নঢ়ংঢ়ংুপযঁন.ড়হষরহবষরনৎধৎু.রিষবু.পড়স/লড়ঁৎহধষ/২০৪৪৮২৮৭.

[১৬].যঃঃঢ়://িি.িপহংহবাধফধ.পড়স/যিধঃ-রং-ঃযব-সবসড়ৎু-পধঢ়ধপরঃু-ড়ভ-ধ-যঁসধহ-নৎধরহ/.




প্রসঙ্গসমূহ »: ইসলাম ও বিজ্ঞান

ফেসবুক পেজ