বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন

পলাশী ট্রাজেডির প্রেক্ষাপট ও আজকের বাংলাদেশ

-ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ*


আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় পলাশী ট্রাজেডি। পলাশী প্রান্তরে এদেশের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটেছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। এই দিনে ভাগীরথীর তীরে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। প্রহসনের ঐ যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে, বিপন্ন হয় রাষ্ট্রীয় সত্তা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয় চরম বিপর্যস্ত অবস্থা। শাসক মুসলিমরা যাতে আর কখনো মাথা তুলতে না পারে সে জন্য সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ইংরেজ ও তার এদেশীয় এজেন্ট বর্ণহিন্দুরা। কিছু সংখ্যক নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থপর, পরগাছা হায়েনার জঘন্য ষড়যন্ত্রে বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত শস্য শ্যামল, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জনপদের এ ধরনের পরাজয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

সে যুগে ইংরেজরা বাণিজ্যের অজুহাতে এবং ছলে-বলে কৌশলে বিশ্বের নানা দেশে সার্বিক কর্তৃত্ব ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। শেষ দিকের মোঘল শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে তারা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায় ভারতে। এরপর অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতেও নাক গলাতে থাকে ইংরেজরা। তাদের ষড়যন্ত্রমূলক ও উস্কানিমূলক পদক্ষেপ ক্ষুব্ধ করেছিল স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজকে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবাব আলী ওয়ার্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার ছিল হিন্দু। ‘দেওয়ান’ ’তানদেওয়ান’ ’সাবদেওয়ান’ প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিতে হিন্দুরা ছিল। এদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছিল মীর জাফর। অপরদিকে ১৯জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮জনই ছিল হিন্দু। ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে শঠতা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্রের ও বিভেদ নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আর তাদের এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল এই হিন্দু শেঠ বেনিয়ারা।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র পনের মাস বাংলার সিংহাসনে ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর একজন অনন্য সাধারণ শাসক। তিনি নির্ভেজাল এক দেশপ্রেমিক। তিনি একজন সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক, এতে কোন সন্দেহ নেই। যে বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষিপ্রতার সাথে তিনি একযোগে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের পাশাপাশি বিদেশী বেনিয়াদের চক্রান্ত উপলব্ধি করে তাদের শায়েস্তা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাতে তাঁর সামরিক প্রজ্ঞা ও অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। সবকিছু সুসংহত করার আগেই বিশ্বাসঘাতকরা চূড়ান্ত আঘাত হানে। ফলে বাংলার আমজনতার ললাটে দীর্ঘমেয়াদী কলংকের তিলক অঙ্কিত হয়। আর্থ-সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী। একজন স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি হিসাবে তিনি বারবার ইংরেজদের হুঁশিয়ার করে দেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে ও দেশের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা যদি ব্যবস্থা করে তবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। অন্যথা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ণ করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাবের হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত তো করেইনি, বরং নানা উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে। এর কারণ সুস্পষ্ট তারা ভিতর থেকে ইন্ধন পাচ্ছিল।

খ্রিস্টীয় ১৭৫৬ সনের ২০ জুন সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের শিক্ষা দিতে ও তাদের দম্ভ কমাতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করেন। কারণ সামরিক আস্তানায় পরিণত হওয়া এ দুর্গ হয়ে পড়েছিল বাংলার স্বাধীনতার প্রতি মারাত্মক হুমকি। এ দুর্গের সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন নবাব। কিন্তু ইংরেজ তার এই আপত্তিকে অগ্রাহ্য করায় দুর্গটি দখল করতে বাধ্য হন নবাব সিরাজ। এ সময় জন জেপানিয়াহ হলওয়েল নামের এক ধূর্ত ইংরেজ ‘কোলকাতার অন্ধকূপ হত্যা’ নামের একটি আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে নবাবকে গণহত্যাকারী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই গাঁজাখুরি কাহিনীতে বলা হয় যে, ১৪৬ জন ইংরেজকে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট প্রস্থের একটি গর্তে রাখায় তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হলওয়েল নিজে ওই ঘটনায় বেঁচে যায় বলে দাবি করে। গবেষক ও ঐতিহাসিকরা এই কাহিনীকে একটি পুরোপুরি মিথ্যা কাহিনী হিসাবে অস্বীকার করে আসছেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লেখা "অহ অফাধহপবফ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ওহফরধ" শীর্ষক বইয়ে অন্ধকূপ হত্যাকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।

ব্রিটিশ প-িত ও গবেষক জে.এইচ লিটলও "ঞযব 'ইষধপশ ঐড়ষব'—ঞযব ছঁবংঃরড়হ ড়ভ ঐড়ষবিষষ'ং ঠবৎধপরঃু" বা ‘অন্ধকূপ হত্যা- হলওয়েলের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধে হলওয়েলের বর্ণিত এই কাহিনীকে ‘বড় ধরনের ধোঁকা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ভারতবর্ষে সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত তৈরি করতে ও এই লক্ষ্যে ব্রিটেনের লোকদের ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই এই কাহিনী রচনা করা হয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

নবাব ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে মীরজাফরকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করলে নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে পুনর্বহাল করেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়। ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে ‘যুদ্ধ’ বলতে নারাজ। তার মতে, ‘নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোন অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল’। মীর মদন ও মোহন লালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উর্মিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ কুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে দু’শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।

পলাশীর প্রান্তরে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ভাগ্য বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। মীর জাফর অবশ্যই বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, তবে ইতিহাসে দেখা যায় তার চেয়ে বহুগুণ বড় ও সফল বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ধনকুবের জগৎশেঠ। মীর জাফর বিজাতি, বিদেশী ইংরেজদেরকে কখনো আপন উদ্যোগে ডেকে আনেননি। সে কাজটি করেছিলেন জগৎশেঠ গোষ্ঠী ও তাদের সঙ্গী সাথীরা। তিনি ছিলেন শিখ-ি মাত্র। ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন কূটনীতি ও কলা-কৌশলের এই পথের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিল মীর জাফর, ইয়ার লতিফ, শেঠ রূপ চাঁদ, মাহতাব রায়, রায়দুর্লভ, রাজা রাজ বল্লভ, নন্দ কুমার, উর্মিচাঁদ, দুর্লভরাম, মানিক চাঁদসহ আরো অনেকে। দেশ ও জাতির অকল্পনীয় ক্ষতির দুয়ার এরাই খুলে দেন এবং ইতিহাসের কদাকার আবর্জনায় এরা নিক্ষিপ্ত হয়। এই স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠও পিতামহের নীতি ও আদর্শের অনুসারী ছিলেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সিরাজউদ্দৌলা, মীর জাফর ও মীর কাশিমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। নবাবের উদার ছত্রছায়ায় সূদের ব্যবসায় অর্থলগ্নি করে এই স্বরূপ চাঁদ হয়েছিলেন ধনকুবের। নবাবের দরবারে সর্বগ্রাসী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠ। পাঁচ পুরুষ ধরে নবাবের দরবারে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা এবং নিজেদের ক্রমবর্ধিষ্ণু বিশ্বাসঘাতকতায় চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে অপরিমেয় বিত্তের অধিকারী জগৎশেঠই ইংরেজদেরকে বাংলার শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার কাজে তৎকালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সে সময়ে জগৎশেঠের পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪০ লাখ টাকা, যা বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রা মানে ৯০০ শ’ কোটি টাকারও বেশি। মুর্শিদাবাদের দরবারে বেসরকারী ব্যক্তিত্ব হয়েও বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠ। মুর্শিদকুলী খাঁর আমল থেকে গড়ে উঠা নব্যবণিক শ্রেণীকে ও বিদেশী বণিকদেরকে পুঁজি সরবরাহ করে সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের একক করায়ত্ত চলে আসে তার হাতে। এই সুবাদেই নবাবের দরবারে ডজন খানেক মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী ও কর্ণধার ব্যক্তি ছিলেন এই স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠ।

পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটেনের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। ভারতে নানা সময়ে ব্রিটেনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ এবং শত্রুতামূলক নানা নীতির কারণে কোটি কোটি বাঙ্গালীসহ অন্তত দশ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দেশীয় শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজ-ব্যবস্থারও হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। বিশেষ করে, মুসলমানরা হয়ে পড়ে সবচেয়ে দরিদ্র ও অনগ্রসর। অথচ তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর বাংলার মুর্শিদাবাদসহ ভারতের নানা শহরের সম্পদ লুট করে ইংরেজরা তাদের দেশকে সম্পদশালী করার নানা উপাদান সংগ্রহ করেছে। পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলা বিহার ইংরেজ ও তাদের দেশীয় দালাল বর্ণহিন্দুদের লুটপাটের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছিল। একজন মুসলিম ও পাওয়া যায়নি যে পলাশী যুদ্ধের পর সম্পদশালী হয়েছিল। অথচ পেটের দায়ে এদেশে আসা ইংরেজ ও তাদের দেশীয় সেবাদাস জগৎ শেঠরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। ইংরেজরা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্নীতি আমদানী করে ব্যাপকভাবে। ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশবছরে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এই ব্যাপক লুণ্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে (বাংলা-১১৭৬) বাংলা বিহারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কোটি মানুষ  মৃত্যের শিকারে পরিণত হয়। ‘ছিয়াত্তরের মনন্তর’ নামে পরিচিত এই মহা দুর্ভিক্ষে ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ।

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পলাশী পরবর্তীকালে ব্যাপক বিপর্যয় ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। ঐতিহাসিক ম্যাক্সমুলার উল্লেখ করেছেন যে, ইংরেজদের ক্ষমতা দখলকালে বাংলায় আশি হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতি চারশ’ লোকের জন্য তখন একটি মাদরাসা ছিল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ইংরেজ আমলে লুপ্ত হয়ে যায়। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি থেকে মুসলিম শাসকরা ‘বাংলা’ নামক যে এক প্রকার স্বাধীন রাষ্ট্র পত্তন করে বাংলা ভাষাভিত্তিক লোকগোষ্ঠী গঠনের জন্য যে অবদান রেখেছিলেন পলাশী পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের দ্বারা সে বাংলা ভাষার জন্য ধারাবাহিক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ামী ষড়যন্ত্র আর প্রাসাদপুষ্ট ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সংস্কৃত প-িতদের হাতে বাংলা ভাষার রূপ ও সাহিত্যের গতি পাল্টে গেল। ফলে বাংলা ভাষা হয়ে উঠল বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখারই নামান্তর।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে পলাশী পরবর্তীকালে কালো অন্ধকার নেমে আসে। ইংরেজ ষড়যন্ত্রে গোটা মুসলিম সম্প্রদায় কর্মহীন হয়ে পড়ে। ধর্মীয় জীবনে চরম অবক্ষয় দেখা দেয়। প্রতিবেশী ইংরেজ অনুকম্পায় উদীয়মান সম্প্রদায় হিন্দুদের প্রভাব ও অনুকরণে বহু কুসংস্কার, ইসলাম বিরোধী রসম রেওয়াজ, হিন্দু ধর্মীয় নানা আচার-আচরণ এসময় মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে। মুসলিম শাসনামলে ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবন উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক গ্রামে মুুফতী মুহতাসিব প্রভৃতি দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হত। ইংরেজরা এ পদগুলো বিলুপ্ত করে। ফলে মুসলিমরা দিক নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে।

পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সেদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোটা আর হাতের ইট-পাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি। যেকোনো কারণেই হোক সেদিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল। পলাশীর ট্রাাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতই মাঠে কৃষি কাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কী নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলো, এক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল গোটা কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের টনক নড়লো না। টনক যখন নড়লো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না। সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে একমাত্র তিনিই ছিলেন নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাঙলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।

প্রতি বছর ২৩ জুন আমাদের এই সতর্কবাণী শুনিয়ে যায় দেশের ভেতরের শত্রুরা বাইরের শত্রুর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ২৩ জুন আমাদের জাতীয় জীবনে কলঙ্কের দিন, তেমনি তা এক শিক্ষণীয় দিবসও বটে। বাংলার ইতিহাসে এই পলাশী অধ্যায় একটি ন্যক্কারজনক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমাদের জাতীয় জীবনে এর মাশুল দিতে হয়েছে দীর্ঘ ২০০ বছরের গোলামির জিঞ্জির। ২৩ জুনের পলাশীর ইতিহাস, কিছু বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারীর যোগসাজশে দেশের স্বাধীনতা বিদেশী বেনিয়াদের হাতে তুলে দেয়ার ইতিহাস। ২৩ জুনের ইতিহাস প্রকৃত সোনার বাঙালাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস। এবারও এমন এক সময়ে পলাশী ট্রাজেডি দিবস পালন হচ্ছে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। সমস্ত কিছু বিকিয়ে দিয়ে হলেও একটি শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে।

বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি এই যে, মীর জাফরেরা বার বার গোর থেকে উঠে আসে। চোখকান একটু খোলা রাখলে আজও আমাদের চারপাশে বেঈমানদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস টের পাওয়া যাবে। এদের মত কুলাঙ্গারদের কারণে যেন আর কোন দেশ ও জাতির স্বাধীনতা বিপন্ন না হয়। ক্ষমতালোভী মীর জাফর ও তার দলবল দু’দিনের নবাবীর বিনিময়ে আজীবনের জন্য পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার দুনিয়াজোড়া খেতাব, মৃত্যুর পরেও যা মুছে যায়নি। এরা নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত হিসাবেই পরিচিত হচ্ছে ও হবে চিরদিন। মীরজাফর আজ বেঈমানের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘৃণিত এই নামটি কোন মা-বাবাই সন্তানের জন্য রাখতে চান না। বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি এমনই হয়।

পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছুই। আমরা কি ২৩ জুনের বিপর্যয় থেকে আদৌ কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি? ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ কিছু শেখে না। ঐতিহাসিক এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কারণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের ঘড়যন্ত্রকে উসকে দিতে মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রায় দুর্লভদের মত দেশদ্রোহীরা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ইতিহাসের প্রত্যেকটি সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে যেমনি শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে জাগ্রত করা হয়, তেমনি ঐতিহাসিক পলাশী দিবসের শিক্ষা আমাদের প্রজন্ম ও জাতিসত্তার বিকাশে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। এ দিবসের প্রকৃত শিক্ষা ও সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে, যাতে কোনো আধিপত্যবাদী শক্তি আমাদের ক্ষতি করতে না পারে। সাথে সাথে এদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা নবাব সিরাজউদ্দৌলার আদর্শকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদেরই মঙ্গলের জন্য। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশি ও বিদেশি শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে আমাদের উচিত দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে তিলমাত্র হুমকি এলেও দুনিয়ার কোন শক্তি ও ব্যক্তিকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দেয়া হবে না, পলাশী দিবসের এ দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।



* প্রফেসর, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।




প্রসঙ্গসমূহ »: মনীষীদের জীবনী

ফেসবুক পেজ