শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ অপরাহ্ন

পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য : পরাজয় ও বিজয়

-আল-ইখলাছ ডেস্ক


যখন পারস্য সম্রাট সা’বূর সিরিয়া রাজ্য ও আরব উপদ্বীপের আশে পাশের শহরগুলোর উপর বিজয় লাভ করে এবং রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস পরাজিত হয়ে কনস্টান্টিনোপলে অবরুদ্ধ হন, তখন নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الٓـمّٓ – غُلِبَتِ الرُّوۡمُ -فِیۡۤ اَدۡنَی الۡاَرۡضِ وَ ہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ غَلَبِہِمۡ سَیَغۡلِبُوۡنَ – فِیۡ بِضۡعِ سِنِیۡنَ لِلّٰہِ الۡاَمۡرُ مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡۢ بَعۡدُ وَ یَوۡمَئِذٍ یَّفۡرَحُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ

‘আলিফ লাম মীম; রোমকরা পরাজিত হয়েছে। নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু তারা তাদের এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে, কয়েক বছরের মধ্যেই। পূর্বের ও পরের সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনরা খুশি হবে’ (সূরা আর-রূম : ১-৪)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রোমকদেরকে (পারস্যের নিকট) পরাজয়ের উপর পরাজয় বরণ করতে হয় এবং অতঃপর তারা (রোমকরা) বিজয় লাভ করে। রোমদের পরাজয়ে মুশরিকরা খুবই আনন্দিত হয়। কেননা তাদের মত পারস্যবাসীরাও ছিল মূর্তিপূজক। আর মুসলিমরা কামনা করত যে, রোমকরা যেন পারসিকদের উপর বিজয় লাভ করে। কেননা তারা ছিল আহলে কিতাব। রোমানরা যে আহলে কিতাব এ কথা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, রোমকরা সত্বরই বিজয় লাভ করবে। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এ খবর মুশরিকদের নিকট পেীঁছালে তারা বলে, আসুন! আপনার এবং আমাদের মধ্যে বাজি ধরি। আপনার সাথী (রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) দাবী করছেন যে, রোমানরা পারসিকদেরকে তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে পরাজিত করবে, এ বিষয়ে আপনার এবং আমাদের মাঝে বাজি ধরা হোক। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, ঠিক আছে, তা হতে পারে। এটা ছিল ঐ সময়ের ঘটনা যখন পর্যন্ত বাজি ধরা নিষিদ্ধ করা হয়নি। যা হোক, পারসিকদের উপর বিজয় লাভের পর কুরআনের বাণী সত্য প্রমাণিত হওয়ায় অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন।

রোমান কারা : রোমকরা সবাই আইয়ায ইবনু ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বংশোদ্ভূত। এরা বানী ইসরাঈলের চাচাতো ভাই। রোমকদেরকে বানু আসফারও বলা হয়। এরা গ্রীকদের (ইউনানী) মাযহাবের উপর ছিল। গ্রীকরা ছিল ইয়াফীস ইবনু নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত। এরা তুর্কীদের চাচাতো ভাই। এরা ছিল তারকা পূজারী। এরা সাতটি তারকার উপাসনা করত। এরা উত্তরমুখী হয়ে ছালাত আদায় করত। এদের দ্বারাই দামেস্ক শহরের পত্তন হয়েছিল। তারা সেখানে উপাসনালয় তৈরি করে। । ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর নবুওতের পর তিন’শ বছর পর্যন্ত রোমকরা তাদের পূর্ব মতবাদে অটল ছিল। তাদের মধ্যে যে কেউই সিরিয়া থেকে পারস্য উপসাগর এলাকার (অথবা জাযীরাহ উপদ্বীপের) বাদশাহ হত তাকেই সিজার (কাইসার) বলা হত। সর্বপ্রথম রোমকদের বাদশাহ কনস্টানটাইন ইবনু কসতাস খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। তার মা ছিল মারইয়াম হাইলানিয়্যাহ সাদকানিয়্যাহ। সে ছিল হারান এলাকার অধিবাসিণী। সেই সর্বপ্রথম খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার কথায় তার ছেলেও এই মাযহাব অবলম্বন করে। এর পূর্বে এ লোকটি ছিল দর্শনবাদে বিশ্বাসী। এ কথাও প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, সে আসলে আন্তরিকতার সাথে এ ধর্ম গ্রহণ করেনি।

একদা বহু খৃষ্টান তার দরবারে একত্রিত হয়। তাদের পরস্পরের মধ্যে ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা-সমালোচনা, মতানৈক্য এবং তক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে বড় ধরণের বিভেদের সৃষ্টি হয়। ৩১৮ জন পাদরী মিলিতভাবে একখানা পুস্তক রচনা করেন যা কনস্টানটাইনকে প্রদান করা হয়। এতে বাদশাহর আক্বীদাহ ও মতাদর্শকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটাকে আমানাতে কুবরা বা বৃহত্তম সমঝোতা চুক্তি বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল খিয়ানাতে হাকীরাহ (ঘৃণ্য খিয়ানত)। এ সময় তাকে তাদের নিয়ম-নীতির কিতাব প্রদান করা হয় এবং তাতে হারাম/হালালসহ অনেক কিছু বর্ণনা করা হয়। তাদের আলেমরা মনের আনন্দে যা খুশী তাই লিখে তাতে যুক্ত করে এবং দ্বীনে মাসীহকে তারা মন খুলে কম বেশি পরিবর্তন করে। ফলে আসল দ্বীন পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যায়। তারা পূর্বদিকে মুখ করে ছালাত আদায় করা শুরু করে এবং শনিবারের পরিবর্তে রবিবারকে বড় দিন ধার্য করে। তারা ক্রসের উপাসনা শুরু করে। শুকরকে তারা হালাল করে নেয়।

বহু নতুন নতুন উৎসব তারা আবিষ্কার করে। যেমন ঈদ, ক্রুশ, নৈশভোজের উৎসব, পাম সানডে, ইষ্টার সানডে’ ইত্যাদি। তারপর তাদের আলেমদের মর্যাদার স্তর তারা নির্ধারণ করে নিয়েছে এবং তাদের একজন বড় পাদরী হয়ে থাকে। তার অধীনে ছোট ছোট পাদরীদের ক্রমিক পর্যায়ে মর্যাদার স্তর বণ্টন করে দেয়া হয়। তারা রুহানিয়্যাত ও বৈরাগ্যের নতুন বিদ‘আত আবিস্কার করে নিয়েছে। তাদের জন্য বাদশাহ বহু সংখ্যক গীর্জা ও মন্দির তৈরি করে দেয়। বাদশাহ একটি নতুন শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যে শহরের নামকরণ করা হয় কনস্টানটিনোপল। বর্ণিত আছে যে, বাদশাহ সেখানে বারো হাজার গীর্জা নির্মাণ করে। বাইতে-লাহমে তিনটি মেহরাব তৈরি করা হয়। তার মাও যিশুর নামে একটি পুন্য সমাধি (কামাকিমা) তৈরি করে দেয়। তারা সবাই বাদশাহর দ্বীনের উপর ছিল।

তারপর আসে ইয়াকূবিয়্যাহ ও নাসতূরিয়্যাহ। এরা সবাই ইয়াকুব আল আসকাফ এবং নাসতূরের অনুসারী ছিল। তাদের বহু দল সৃষ্টি হয়েছিল। খৃষ্টধর্ম অনুসরণ করে তাদের রাজত্ব ও আধিপত্য বরাবর চলে আসছিল। একের পর এক সিজার (কাইসার) হয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত হিরাক্লিয়াস সিজার (কাইসার) হন। ইনিই ছিলেন সমস্ত বাদশাহর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান। তিনি একজন বড় আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন বড় জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তি। এ ব্যাপারে তার কোন জোড়া ছিলনা। তার রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। তার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারস্য সম্রাট কিসরা উঠে পড়ে লাগে। ইরাক, খুরসানাসহ ঐ এলাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোও তার সাথে মিলিত হয়। তার নাম ছিল সাবুর যুল আখতাফ। তার রাজ্য সিজারের রাজ্য অপেক্ষাও বড় ছিল। কিসরা চিল অগ্নি উপাসক।

কিভাবে সিজার (কাইসার) কর্তৃক কিসরাহ পরাজিত হয়েছিল

কিসরার সেনাপতি সিজারের বিরূদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। কিন্তু বাস্তব কথা এই যে, স্বয়ং কিসরা সিজারের (কাইসারের) মুকাবিলা করেছিল। সিজার যুদ্ধে পরাজিত হন। এমনকি তিনি কনস্টান্টিনোপলে (কুসতুনতুনিয়ায়) অবরূদ্ধ হন। দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ চলতে থাকে। খৃষ্টানরা তাকে খুব সম্মান করত। বহু দিন অবরোধ করে রাখার পরেও কিসরার সেনাবাহিনী রাজধানী দখল করতে পারলনা। কারণ ঐ শহরের রক্ষাবুহ্য ব্যবস্থা ছিল খুবই মযবূত। ঐ শহরের অর্ধাংশ সমুদ্রের দিকে ছিল। আর বাকী অংশ ছিল স্থলভাগ সংলগ্ন সামুদ্রিক পথে। খাদ্য ও রসদ সিজারের নিকট বরাবরই পৌছতে থাকে। অবশেষে সিজার এক কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি কিসরাকে বলে পাঠালেন, আপনি যা ইচ্ছা আমার নিকট হতে গ্রহণ করুন এবং যে শর্তের উপর ইচ্ছা সন্ধি করুন। আপনি অর্থ কিংবা যা চাইবেন আমি তাই দিতে প্রস্তুত আছি। কিসরা এ প্রস্তাবে সানন্দে সম্মত হল। অতঃপর সে এত বেশী স্বর্ণ, রত্ন, দাস-দাসী ইত্যাদি চেয়ে বসলো যা পৃথিবীর কোন বাদশাহ শত চেষ্টা করলেও তা সংগ্রহ করতে সক্ষম হবেনা। কিন্তু সিজার এটাও মেনে নিলেন যে, কিসরা অত্যন্ত নির্বোধ বাদশাহ। সে যে মাল চেয়েছে তা যদি তারা দু’জনে মিলে সংগ্রহ করতে চায় তবুও তাদের পক্ষে দশ ভাগের এক ভাগও জমা করা সম্ভব নয়। তিনি কিসরায় গিয়ে সময় মত এ মাল তাকে প্রদান করার ব্যাপারে সুযোগ দেয়। কিসরা তার এই আবেদন মঞ্জুর করে। সুতরাং রোম সম্রাট কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) ত্যাগ করার সময় জনগণকে একত্রিত করলেন এবং বললেন, আমি আমার কতিপয় বিশিষ্ট বন্ধুর সাথে কোথাও যাচ্ছি। যদি আমি এক বছরের মধ্যে ফিরে আসি তাহলে আমিই এ দেশের বাদশাহ থাকব। আর যদি এক বছরের মধ্যে ফিরে আসতে না পারি তাহলে ইচ্ছা করলে তোমরা আমার প্রতি অনুগত থাকতে পার অথবা তোমরা যাকে খুশী বাদশাহ নির্বাচিত করবে। তার প্রজাবর্গ উত্তরে বলল, আমাদের বাদশাহতো আপনিই, দশ বছর যাবৎও যদি আপনি ফিরে না আসেন তাহলেও আপনিই আমাদের বাদশাহ থাকবেন।

প্রাণ নিয়ে বাজি ধরে এরূপ অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি রওয়ানা হন। তিনি যখন কনস্টান্টিনোপল ত্যাগ করেন তখন ছোট্ট একটি পদাতিক বাহিনী তার সাথে নেন। কনস্টান্টিনোপলের বাইরে কিসরা তার সেনাবাহিনী নিয়ে সিজারের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে যে, কখন তিনি কিসরার জন্য ধন-রত্ন সংগ্রহ করে ফিরে আসবেন। আর ওদিকে সিজার তার ছোট্ট বাহিনী নিয়ে কিসরার এলাকা পারস্যে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে তখন খুব কম সংখ্যক সৈন্যই অবস্থান করছিল, যেহেতু সবাই কিসরার সাথে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছে সিজার যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন নবীন/যুবকদের হত্যা করলেন। এভাবে হত্যা করতে করতে তিনি মাদায়িন পৌঁছেন। ঐ স্থানই ছিল কিসরার ক্ষমতার উৎস/কেন্দ্র। সেখানে কিসরার সিংহাসন অবস্থিত ছিল। সেখানকার রক্ষীবাহিনীর উপর তিনি জয়লাভ করেন, ঐ শহরের সবাইকে হত্যা করেন এবং ওখানকার সমস্ত ধন-সম্পদ হস্তগত করেন। সেখানের সমস্ত মহিলাকে বন্দী করেন এবং যুদ্ধোপযোগী লোকদেরকে হত্যা করেন। কিসরার ছেলেকে জীবন্ত বন্দী করলেন। কিসরার অন্দরবাসিনী মহিলাদেরকেও পাকড়াও করলেন। তার ছেলের মাথা মুণ্ডন করে গাধায় চড়িয়ে মহিলাদেরসহ অবমাননাকর অবস্থায় কিসরার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে লিখে পাঠালেন, তুমি আমার কাছে যা চেয়েছিলে তা এখন গ্রহণ কর।

তখনও কিসরা কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেই ছিল ও সিজারের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। এ সময় তার পরিবারবর্গ ও অন্যান্য লোকদেরকে অত্যন্ত অপমানজনক অবস্থায় দেখতে পেয়ে সে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হল ও কঠিনভাবে আক্রমণ করার ইচ্ছা করল। তখন সে যাইহুন নদীর দিকে অগ্রসর হল। কেননা এটাই ছিল কুসতুনতুনিয়া যাবার পথ। এ পথে সিজার বাহিনীকে বাধা দেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। সিজার এটা জানতে পেরে পূর্বেই বড় রকমের কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি তার কিছু সংখ্যক সৈন্যকে নদীর মোহনায় মোতায়েন করেন এবং বাকীদের নিয়ে নদীর উপরের দিকে চলে যান। প্রায় এক দিন এক রাত চলার পর তিনি নিজের সাথে যে খড়কুটা, জন্তুর গোবর ইত্যাদি এনেছিলেন সবই পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। এগুলো ভাসতে ভাসতে কিসরার সেনাবাহিনীর সম্মুখ দিয়ে চলতে লাগল। তখন তারা মনে করল যে, সিজার ওখান থেকে চলে গেছেন। কারণ, সে বুঝছিল যে, ওগুলো সিজারের পশুর খাদ্য, গোবর ইত্যাদির অবশিষ্টাংশ। অতঃপর সিজার আবার তার সেনাবাহিনীর নিকট ফিরে এল। এক দিকে কিসরা তার সন্ধানে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। আর অন্য দিকে সিজার যাইহুন নদী অতিক্রম করে পথ পরিবর্তন করে কনস্টান্টিনোপল পৌঁছে গেলেন।

যেদিন তিনি রাজধানীতে পৌঁছলেন সেই দিন খৃষ্টানরা অত্যন্ত আনন্দোৎসবে মেতে উঠল। কিসরা যখন এ খবর জানতে পারল তখন তার বিস্ময়কর কিংকর্তব্যমূলক অবস্থা হল। বসার জায়গাটুকুও চলে গেল এবং চলার স্থানটুকুও শেষ হয়ে গেল। না রোম বিজিত হল, না পারস্য টিকে থাকল। সুতরাং সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। রোমক জয়লাভ করল। পারস্যের নারী এবং ধন-সম্পদ তাদের অধিকারে এসে গেল। এসব ঘটনা নয় বছরের মধ্যে সংঘটিত হল। রোমকরা তাদের হারানো দেশ পারসিকদের হাত হতে পুনরুদ্ধার করে নিল। পরাজয়ের পর পুনরাপয় তারা বিজয় মাল্যে ভুষিত হল।

ইকরিমা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যখন পারস্য রোমকদের উপর বিজয়ী হল। তখন ‘ফারখান’ (পারস্যের সহকারী প্রধান সেনাপতি) বসে মদ পান করলেন এবং তার সাথীকে বললেন, আমি নিজেকে দেখছি, যেন আমি কিসরার (পারস্যের সম্রাটের আসনে) চেয়ারে বসে আছি। পারস্যের সম্রাটের নিকট কথাটি পৌঁছে গেল। তিনি প্রধান সেনাপতি ‘শাহার বারাজ’ (ফারহানের ভাই)-এর নিকট চিঠি লিখে আদেশ দিলেন যে, ফারহানের মাথাটি কেটে আমার নিকট পৌঁছে দিবে। শাহার বারাজ পারস্য সম্রাটের নিকট চিঠি লিখে বললেন যে, আপনি ফারখানের মত সেনাপতি কখোনো পাবেন না। শত্রুদের মধ্যে তার বলপ্রয়োগ ও উৎপীড়ন ব্যাপক। আপনি তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিবেন না। কিসরা প্রধান সেনাপতি শাহার বারাজকে কয়েকবার ফারখানকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করেন, কিন্তু তিনি তার কোন জবাব দেননি অর্থাৎ তার নির্দেশ পালন করেননি। কিসরা পারস্যবাসীর নিকট চিঠি পাঠান এবং বলেন, আমি শাহার বারাজকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করলাম এবং ফারখানকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করলাম। অতঃপর তিনি ফারখানকে ছোট একটি চিঠি লিখলেন। ফারখান যখন সেনাপতি হলেন, তখন চিঠিটি তার ভাই শাহার বারাজকে দিলেন। তার ভাই যখন চিঠিটি পড়লেন, তখন তিনি তা মেনে নিলেন এবং তার সেনাপতির চেয়ার থেকে নেমে গেলেন এবং ফারখান সেনাপতির চেয়ারে বসলেন। পারস্য সম্রাট ফারখানের নিকট চিঠি পাঠালেন এবং শাহার বারাজের মাথা কাটার নির্দেশ দিলেন। ফারখান তার মাথা কর্তন করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। তখন তার ভাই তাকে বললেন, তুমি এ কাজ করো না; যতক্ষণ না আমি আমার ওছীয়ত না লিখি। তখন ফারখান বলল, হ্যাঁ। তখন শাহার বারাজ (ফারখানকে হত্যার) তিনটি চিঠি বের করলেন এবং বললেন, আমি প্রত্যেকটি চিঠি কিসরার নিকট ফেরত দিয়েছি। আর তুমি একটি নির্দেশ পেয়েই আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছ। ফলে ফারখান কিসরার নিকট হত্যার নির্দেশ সম্বলিত চিঠি ফেরত দিলেন। শাহার বারাজ রোমক সম্রাটের নিকট চিঠি লিখে বললেন, আপনার নিকট আমার প্রয়োজন রয়েছে। আপনি আমার সাথে পঞ্চাশ জন রোমক সৈন্য নিয়ে সাক্ষাৎ করবেন এবং আমিও পঞ্চাশ জন পারস্য সৈন্য নিয়ে সাক্ষাৎ করব। রোম সম্রাট পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে শাহার বারাজের সাথে সাক্ষাতের জন্য অগ্রসর হলেন এবং রাস্তার এদিক ওদিক নজর রাখলেন। তিনি ভয় করছিলেন যে, হয়ত শাহার বারাজ কোন কৌশল অবলম্বন করেছেন। অবশেষে তিনি দেখলেন যে, শাহার বারাজের সাথে শুধু পঞ্চাশ জন সৈন্য আছে। অতঃপর তারা দু’জন (রোমক সম্রাট ও শাহার বারাজ) একটি তাঁবুতে একত্রিত হলেন। তাদের প্রত্যেকের নিকট একটি করে ছুরি ছিল। দু’জনের জন্য দু’জন অনুবাদক ডাকা হল। শাহার বারাজ রোমক সম্রাটকে বলল, যারা আপনার শহর ধ্বংস করেছে, তারা হল আমি ও আমার ভাই। আমাদের কৌশল এবং বীরত্বের কারণে সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কিসরা আমাদের সাথে হিংসা করছে। তার ইচ্ছা, আমি যেন আমার ভাইকে হত্যা করি। কিন্তু আমি তা অস্বীকার করেছি। অতঃপর আমার ভাইকে আমাকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।

আমরা দু’ভাই তাকে পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা আপনার সাথে কিসরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছি। ফলে রোমক সম্রাট রাজি হলেন। তাদের দু’জনের (রোম সম্রাট ও শাহার বারাজ) একজন অপরকে ইশারা করল এবং বলল, أَنَّ السِّرَّ بَيْنَ اثْنَيْنِ فَإِذَا جَاوَزَ اثْنَيْنِ فَشَا ‘গোপন বিষয় দু’জনের মধ্যে। যখন দু’জন অতিক্রম করবে, তখন তা ফাঁস হয়ে যাবে’। ফলে তারা দু’জন তাদের ছুরি দ্বারা দোভাষীদেরকে হত্যা করল। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা কিসরাকে ধ্বংস করে দিলেন। আর এ খবর যখন রাসূলুল্লাহ এর নিকট পৌঁছিল তখন তিনি খুশি হলেন এবং তাঁর ছাহাবীগণও খুশি হলেন (সূরা আর-রূম-এর তাফসীর দ্র.; তাফসীরে ত্বাবারী, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৪৪৬; তাফসীরে কুরতুবী, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ৩; তাফসীরে বাগাবী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৬০; তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৯৯)।




ফেসবুক পেজ