ধর্ষণের জালে বন্দী নারী: মুক্তি কোথায়?
-ওবায়দুল্লাহ বিন মূসা*
অনলাইনে স্ক্রল করলেই শুধু ধর্ষণের নিউজ এছাড়াও দৈনন্দিন পেপার পত্রিকাতো আছেই। ধর্ষণের এই খপ্পর থেকে রেহাই পায়নি ছয় বছরের শিশু আর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীও। তবে কতদিন চলবে কুকুরের এই আচরণ? কতদিন আর হয়রানী করা হবে মা-বোনদের? কতদিন আর লজ্জিত হয়ে আত্মহত্যা করবে নারীরা? তারা কি এই আযাব থেকে নিরাপদ বা মুক্তি পাবে না? কিভাবেই বা মুক্তি পাবে ধর্ষণ নামক আযাব থেকে? নিশ্চয় রয়েছে মুক্তির পথ!*
ধর্ষণ, মানব সভ্যতার এক গভীর ক্ষত, যা যুগে যুগে নারী ও মানবতাকে কলঙ্কিত করেছে। এটি শুধু একটি শারীরিক আক্রমণ নয়, বরং একটি গভীর মানসিক ও সামাজিক সহিংসতা, যা একজন নারীর আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা এবং জীবনের মৌলিক অধিকারকে নির্মমভাবে হরণ করে। এই ঘৃণ্য অপরাধ শুধু ভুক্তভোগীর জীবনকেই ধ্বংস করে না, বরং পুরো সমাজকে বিষাক্ত করে তোলে, যেখানে নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
প্রিয় পাঠক! ধর্ষণের শিকার নারী শুধু শারীরিক যন্ত্রণাই ভোগ করেন না, বরং গভীর মানসিক আঘাত, সামাজিক লজ্জা এবং দীর্ঘস্থায়ী ভয়ের শিকার হন। এই অপরাধের প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। গত কয়েকদিন ধরেই আমরা অবলোকন করছি যে, দেশে ধর্ষণের রূপ ভয়াবহ আকারে ধারণ করেছে। এই আলোচনায় আমরা ধর্ষণ নামক কুকর্ম থেকে মুক্তি লাভের উপায় সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয়
১- শারঈ বিধান কার্যকর করা: ধর্ষণকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার জন্য একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম বিধান দিয়েছে। সর্বজনীন একটি স্বীকৃত বিষয় যে, ইসলামের বিধান যদি বাস্তবায়ন না করা হয় তাহলে এ সকল অপরাধ এবং কুকর্ম সমাজ থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব নয়। ইসলামের বিধানগুলো এত শক্ত ও জোরালোভাবে করা হয়েছে, যেন বিধানটা যদি একবার বাস্তবায়িত হয় দ্বিতীয়বার অপরাধ দমন করার জন্য আর সচেতন করতে হবে না বরং জনগণ এমনিতেই সতর্ক হয়ে যাবে। যা ইতিপূর্বে খিলাফাতের শাসনামলে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় গবেষকগণ বলেছেন, বাংলাদেশ ২০২৪ সাল পর্যন্ত যতগুলো ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেকও বিচার করা হয়নি। যা মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত তিনবছরের পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে।
ধর্ষকের শাস্তি: কেউ যদি কোন নারীকে জোর পূর্বক ধর্ষণ করে, তাহলে তাতে দু’ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়। সুতরাং তার শাস্তিও দু’প্রকার। যথা:
একটি অপরাধ হল- যিনা বা ব্যভিচার। ইসলামী ফৌজদারি আইন অনুযায়ী এর শাস্তি হল, বিবাহিত হলে রজম তথা পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা আর অবিবাহিত হলে একশ’ চাবুকাঘাত। উল্লেখ্য যে, পারস্পরিক সম্মতিতে যিনা সংঘটিত হলেও ইসলামের এই কঠিন বিধান প্রয়োগ করা হবে। অপরটি হল, অপহরণ বা শক্তি প্রয়োগ। এটি ডাকাতি পর্যায়ের অপরাধ। এর শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলে,-
اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ اَرۡجُلُہُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্ত ও পদযুগল বিপরীত দিক থেকে (যেমন ডান হাত ও বাম পা অথবা বাম হাত ও ডান পা) কর্তন করা হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৩৩)।
শরী‘আহ কোর্টের বিচারকগণ সার্বিক দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীর উপর উপরিউক্ত কুরআনের আইন বাস্তবায়ন করবেন।
উল্লেখ্য যে, ২য় আইনটির ক্ষেত্রে ব্যভিচার করা শর্ত নয়। অর্থাৎ কেউ যদি অস্ত্রের মুখে কোন নারীকে অপহরণ করে বা জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায়, তাহলে তার উপর উক্ত আইন বাস্তবায়িত হবে; ধর্ষণ হোক বা না হোক। আর ধর্ষণ হলে তখন অপরাধ দু’টি বলে গণ্য হবে এবং দু’টিরই শাস্তি কার্যকর হবে।
উল্লেখ্য, এ শাস্তি কেবল ধর্ষণকারীর উপর প্রয়োগ হবে; ধর্ষিতার উপর নয়। কেননা, ধর্ষিতা এখানে নিরপরাধ বরং সে যুল্মের শিকার।
ইসলামী আইনে ধর্ষণের শাস্তি
ধর্ষক ব্যভিচারের শাস্তির অধীন, যা বিবাহিত হলে পাথর ছুঁড়ে মারা এবং বিবাহিত না হলে একশ’টি বেত্রাঘাত এবং এক বছরের নির্বাসন। তবে কিছু পণ্ডিত তাকে মহিলার মোহরানা দিতে বলেন। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে পুরুষ কোন নারীকে ধর্ষণ করে, সে কুমারী হোক বা ধর্ষিত না হওয়া নারী হোক, সে সম্পর্কে আমাদের জন্য বিধান হল- যদি সে স্বাধীন হয়, তাহলে তাকে তার মত কারো মোহরানা দিতে হবে। আর যদি সে দাসী হয়, তাহলে তাকে তার মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দিতে হবে, এর শাস্তি ধর্ষকের উপর বর্তাবে। এই সব ক্ষেত্রে ধর্ষিত নারীর জন্য কোন শাস্তি নেই’ (আল-মুওয়াত্তা, ২/৭৩৪ পৃ.)।
ধর্ষক যিনার শাস্তির আওতায় পড়বে, যদি না তাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়। যদি তাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে হুমকি দেয়া হয়, তাহলে তাকে একজন যোদ্ধা হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং মহান আল্লাহর বাণীতে উল্লেখিত শাস্তি তার জন্য প্রযোজ্য হবে। আর তা হল- ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে তাদের একমাত্র শাস্তি হলো তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ত্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটাই হবে তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি’ (সূরা আল-মায়িদাহ: ৩৩)।
শাসক এই মহান আয়াতে উল্লিখিত চারটি শাস্তি থেকে যা উপযুক্ত মনে করেন তা বেছে নিবেন এবং শাস্তি প্রয়োগ করবেন। কেননা এটা হল সমাজে নিরাপত্তার বিস্তার এবং দুর্নীতিবাজ আগ্রাসকদের প্রতিহত করার মাধ্যম।
দ্বীনের জ্ঞান ও রবের ভয় তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া
ধর্ষণের ভয়াবহতা, ধর্ষণের শাস্তি, ধর্ষণের অপকারিতা এবং এ সকল বিধি-বিধান যদি সর্বজনীন সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়, তাহলে ধর্ষণ সমাজ থেকে কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও প্রত্যেকটা মানুষের অন্তরে যদি রবের ভয় থাকে, তাহলে আর কখনো এতজঘন্য অপকর্মে মানুষ লিপ্ত হবে না। কাজেই সকলকে তাকওয়া অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে অধিক তাক্বওয়াবান (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)। রবের ভয় যদি অন্তরে না থাকে, তাহলে তাকে আরো কোন কিছু থেকে বাধা প্রদান করা যাবে না। এছাড়াও মানুষের যদি লজ্জা থাকে তাহলে খারাপ কোন কাজকর্ম থেকে সর্বদা বিরত থাকবে। নবী (ﷺ) বলেছেন إِذَا لَمْ تَسْتَحِي فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ ‘যদি তোমার লজ্জা না থাকে, তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬১২০)। আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের আদেশ দিয়ে বলেছেন,
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِہِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَہُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ.
‘(হে নবী!) মুমিন পুরুষদেরকে আপনি বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত’ (সূরা আন-নূর: ৩০)। আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক এই আদেশ থাকার পরেও পুরুষরা তা লঙ্ঘন করে ধর্ষণের মত অন্যায়ে লিপ্ত হচ্ছে। মূলত উক্ত অপরাধের কারণে যে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন সেই জ্ঞানটুকু তাদের মধ্যে নেই।
বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা
অতি প্রয়োজন ব্যতীত নারীদেরকে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে মাহরাম সঙ্গে নিয়ে এবং সৌন্দর্যতা পরিহার করে বের হতে হবে। বর্তমানে হাটবাজারে, রাস্তাঘাটে, শহর গঞ্জে মহিলাদের আগমন সবচেয়ে বেশি। প্রয়োজন ছাড়াও তারা শহর ঘাটে ঘোরাফেরা করছে, নিজের সৌন্দর্যতাকে প্রকাশ করছে। ফলে দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা তাদের লালসা পূরণের জন্য চেষ্টা করে থাকে। এজন্য নারী সমাজকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاہِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی ‘তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহিলী যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না’ (সূরা আল-আযহাব: ৩৩)।
এজন্যই ইসলামে মহিলাদেরকে অপ্রয়োজনীয় বাহিরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ঘরে থাকতে আদেশ করা হয়েছে। যা তাদের জন্য কল্যাণকর। তবে চিকিৎসার জন্য কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজনকে দেখার জন্য হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ পর্দা অনুসরণ করেই রেব হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ اِلَّا مَا ظَہَرَ مِنۡہَا ‘(হে নবী!) আপনি মুমিন নারীদেরকে বলুন, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ না করে’ (সূরা আন-নূর: ৩১)।
প্রিয় বোনেরা! আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করুন। নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করুন। শয়তানের ফাঁদে পা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহ তা‘আলা সকল মা-বোনকে ধর্ষণের হিংস্র ছোবল থেকে নিরাপদে থাকার তাওফীক্ব দিন। আমীন!
* অধ্যয়নরত, দারুল হুদা সিলামী কমপ্লেক্স, বাঘা, রাজশাহী।
প্রসঙ্গসমূহ »:
সমাজ-সংস্কার